ভারতের ইতিহাসে ভৌগোলিক উপাদানের প্রভাব (Influence of Geographical factors on Indian History)
ভারতবর্ষের উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা থেকে দক্ষিণে তিন দিক থেকে সমুদ্রবেষ্টিত শস্যশ্যামলা সমভূমি, বালুকাময় প্রান্তর, মালভূমি, গহন অরণ্য, আর অসংখ্য নদনদী । একটি দেশের ভূপ্রকৃতি ও আবহাওয়া সে দেশের মানুষের দৈহিক ও মানসিক গঠনের ওপর বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করে । সাধারণভাবে শীতপ্রধান দেশের মানুষ কঠোর পরিশ্রমী. কষ্টসহিষ্ণু ও অনুকুল পরিবেশে জীবনধারণ করতে অভ্যস্ত হয় । তুলনামূলকভাবে নাতিশীতোষ্ণ দেশের মানুষ অপেক্ষাকৃত কম কঠোর পরিশ্রমী, কষ্টসহিষ্ণু ও প্রতিকুল পরিবেশে জীবনধারণে অভ্যস্ত হয় । নদীমাতৃক ভারতের কৃষির অনুকুল জলবায়ু, উর্বর জমি, অপেক্ষাকৃত কম কঠোর পরিশ্রমে পর্যাপ্ত কৃষিপণ্য উৎপাদনের ফলে ভারতের অর্থনীতি হয়েছে মূলত কৃষিভিত্তিক ।
(ক) ভারতের ইতিহাসে হিমালয় পর্বতের প্রভাব (Influence of the Mountain on Indian History)
(i) হিমালয় পর্বতমালা ভারতের উত্তর সীমান্তে দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে থেকে ভারতীয় উপমহাদেশকে মধ্য এশিয়া থেকে ধেয়ে আসা হিমশীতল বায়ুপ্রবাহকে প্রতিহত করে দেশের জলবায়ুকে নাতিশীতোষ্ণ করেছে ।
(ii) হিমালয় পর্বতমালা বাহিরের শত্রুর আক্রমণ থেকে ভারতকে রক্ষা করেছে । ফলে বহির্জগত থেকে বিছিন্ন হয়ে নিজস্ব সভ্যতা ও সংকৃতি গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে ।
(iii) সারা বছর ধরে হিমালয় পর্বতে সঞ্চিত বরফরাশি গলে উত্তর ভারতের নদীগুলিকে পুষ্ট করেছে । নদী বাহিত পলিমাটি জমিকে উর্বর ও শস্য শ্যামলা করে তোলে । এইভাবে হিমালয় ভারতবাসীর ক্ষুধা নিবৃত্তি এবং নিরাপত্তা দান করেছে ।
(iv) হিমালয় পর্বতমালা দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুকে ভারতবর্ষে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত ঘটাতে সাহায্য করে ।
এই সব দিক বিচার করে ভারতবর্ষকে 'হিমালয়ের দান' (Gift of the Himalayas) বলা হয় । যেমন— মিশরকে বলা হয় 'নীলনদের দান' (Gift of the Nile) ।
(খ) ভারতের ইতিহাসে হিমালয় পর্বতের বিভিন্ন গিরিপথের প্রভাব (Influence of the Mountain-defile on Indian History) :
হিমালয় পর্বতের উত্তর-পশিম ও উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত খাইবার পাস , জোজিলা পাস ও নাথুলা পাস প্রভৃতি গিরিপথগুলি দিয়েই যুগে যুগে আর্য, গ্রিক, শক, হুন, তুর্কি, মুঘল প্রভৃতি জাতি ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার ও লুটপাট চালানোর জন্য ভারতে প্রবেশ করেছে । এই সব বিদেশি আক্রমণকারীর দল একদিকে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে অশান্তি ও অত্যাচারের আগুন জালিয়েছে, অন্যদিকে তারা বহির্বিশ্বের সঙ্গে মৈত্রী-স্থাপনে সাহায্য করেছে । হিমালয়ের এই সব গিরিপথ দিয়ে যেমন বিদেশি যোদ্ধার দল ভারতে প্রবেশ করেছে, তেমনি এসেছে বণিক, ধর্মপ্রচারক ও তীর্থযাত্রীর দল । ভারতীয় সভ্যতায় নিজেদের বিলীন করে দিয়ে এই সমস্ত আগত বিদেশির দল ভারতীয় সভ্যতাকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলেছে ।
(গ) ভারতের ইতিহাসে বিন্ধ্য পর্বতের প্রভাব (Influence of the Vindhyas on Indian History) :
(i) বিন্ধ্য পর্বতমালার অবস্থান ভারতকে আর্যাবর্ত ও দাক্ষিণাত্য দুভাগে ভাগ করেছে । প্রাচীন ও মধ্য যুগে আর্যাবর্ত ও দাক্ষিণাত্যের মধ্যে সহজ যোগাযোগ ও যাতায়াতের পথে একটা বড় বাধা ছিল এই বিন্ধ্য পর্বত । আর এর জন্যই উত্তর ভারতের মত বার বার বিদেশী আক্রমণে দক্ষিণ ভারতকে বিধ্বস্ত হতে হয়নি । যার ফলে দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য তার নিজস্ব গতিতে বাধাহীন ভাবে প্রসার লাভ করার সুযোগ পেয়েছে ।
(ii) বিন্ধ্য পর্বতের অবস্থানের জন্যই আর্য সাংস্কৃতির বিস্তারের যুগেও দাক্ষিণাত্যের দ্রাবিড় সংস্কৃতি তার নিজস্ব আঙ্গিকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে । সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য, স্থাপত্য, শিল্পকলা প্রভৃতিতে দক্ষিণের নিজস্ব ভাবটি পরিস্ফুট হয়েছে ।
(iii) উত্তর ভারতের কয়েকজন সম্রাট ও বাদশাহ দক্ষিণ ভারতের বিরাট অংশ জয় করে সাম্রাজ্য বিস্তার করলেও এই বিন্ধ্য পর্বতের অবস্থানের জন্যই কেউই সমগ্র দক্ষিণ ভারত জয় করে সারা ভারতকে রাজনৈতিক দিক থেকে এক সুত্রে বাঁধতে পারেন নি ।
(ঘ) ভারতের ইতিহাসে নদনদীর প্রভাব (Influence of the Rivers on Indian History) :
সিন্ধু, গঙ্গা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ও হিমালয় থেকে নির্গত নদ-নদীসমূহ দেশকে প্লাবিত করে নদীবাহিত পলিমাটি জমিকে উর্বর করে । হিমালয়ে সঞ্চিত বরফরাশি গলে উত্তর ভারতের নদীগুলিকে পুষ্ট করে ও দেশের কৃষিকাজের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে । প্রাচীনযুগে পথঘাটের স্বল্পতা হেতু নদীগুলি যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে দেশের এক অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের মানুষের সাথে পরিচয় ঘটিয়েছে । ভারতের অধিকাংশ তীর্থস্থান নদীতীরে অবস্থিত । বিভিন্ন পর্ব ও অনুষ্ঠানে সারা ভারতের মানুষ তীর্থস্থানে একত্রিত হয় ও নিজেদের সাংস্কৃতির আদান-প্রদান ঘটিয়ে এক মহামিলনের সূত্র সুদৃঢ় করেছে । দক্ষিণ ভারতের জনজীবনে তুঙ্গভদ্রা, গোদাবরী, কাবেরী ও কৃষ্ণা নদীগুলির প্রভাব বিশেষ ভাবে পরিলক্ষিত হয় ।
(ঙ) ভারতের ইতিহাসে সমভূমির প্রভাব (Influence of the Plains on Indian History) :
ভৌগোলিক বিশেষত্ব ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনুসারে ভারত ভুখন্ডকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে— (১) আর্যাবর্ত ও (২) দাক্ষিণাত্য ।
(১) আর্যাবর্ত : হিমালয়ের দক্ষিণে অবস্থিত বিস্তীর্ণ ভুখন্ডের নাম আর্যাবর্ত । এই ভুখন্ড দক্ষিণে বিন্ধ্য ও সাতপুরা পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত । অপেক্ষাকৃত কম কঠোর পরিশ্রমে পর্যাপ্ত কৃষিপণ্য উৎপাদনের ফলে আর্যাবর্তের মানুষ অনেকটাই নিশ্চিন্ত জীবনযাপন করতেন । আর এই নিশ্চিন্ত জীবনই আর্যাবর্তের প্রাচীন অধিবাসীদের কলা ও শিল্পে পারদর্শী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মাচরণ, সাহিত্য রচনা এবং দার্শনিক ও মননশীল চিন্তাধারার সুযোগ করে দিয়েছিল । যুগে যুগে যা মৌর্য, গুপ্ত, কুষাণ, সুলতানী, মোগল প্রভৃতি সভ্যতার মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে ।
(২) দাক্ষিণাত্য : বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর এবং ভারত মহাসাগর এই তিন সমুদ্র তিন দিক থেকেই দাক্ষিণাত্যকে বেষ্টন করে থাকায় দক্ষিণ ভারতের পশ্চিম উপকূলের বহু বন্দরের সঙ্গে পশ্চিম এশিয়ার এবং রোমান সাম্রাজ্যের ঘনিষ্ট বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল । আর্যাবর্তের তুলনায় অপ্রশস্ত হওয়ায় দাক্ষিণাত্যে কোনও বিশেষ একটি কেন্দ্রীভূত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার বদলে একাধিক শক্তির উত্থান-পতন বেশি দেখা যায় ।
(চ) ভারতের ইতিহাসে সমুদ্রের প্রভাব (Influence of the Seas on Indian History) :
ভারতবর্ষের তিন দিকে সমুদ্র ও উত্তরে হিমালয় থাকায় ভারতবর্ষ সারা বিশ্বের থেকে কিছুটা বিছিন্ন ছিল আর এই বিচ্ছিন্নতা ভারতকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে, ফলে ভারতীয় সভ্যতা তার নিজস্ব আঙ্গিকে গড়ে উঠেছে । সমুদ্রতীরবর্তী রাজ্যসমূহের বণিকরা তাদের বাণিজ্যসম্ভার নিয়ে সুদুর সুমাত্রা, জাভা, বালি, চম্পা প্রভৃতি দেশে পাড়ি দিয়েছে ও সেই সঙ্গে ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতি ওই সব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে । ভারতের পশ্চিম উপকুলের বন্দরগুলির সাথে আরব, পারস্য, ও আফ্রিকার দেশসমূহের বাণিজ্য চলত । ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে পোর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা তার বাণিজ্যতরী নিয়ে ভারতের পশ্চিমে কালিকট বন্দরে এসে পৌঁছায় । ইউরোপীয় বণিকরা ভারতের সাথে বাণিজ্য করতে এসে এদেশে তাদের উপনিবেশ গড়ে তোলে । যার অনিবার্য্য পরিণতি স্বরূপ ভারতের শাসনভারও চলে যায় ইংরেজদের হাতে অর্থাৎ ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে ।
(ছ) ভারতের ইতিহাসে জলবায়ুর প্রভাব (Influence of the Climate on Indian History) :
একটি দেশের ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ু সে দেশের ইতিহাস ও মানুষের দৈহিক ও মানসিক গঠনের ওপর বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করে । ভারতবর্ষ নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলে অবস্থিত । পাঞ্জাব, রাজস্থান ও উত্তর প্রদেশের কিছু অংশ বাদে ভারতের জলবায়ু কোথাও চরমভাবাপন্ন নয় । চরম আবহাওয়ায় দেশের মানুষকে জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকার জন্য কঠোর পরিশ্রমী, কষ্টসহিষ্ণু ও সংগ্রামী হতে হয় । নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের মানুষের ততটা প্রয়োজন হয় না । ভারতবাসী কিছুটা শ্রমবিমুখ । ধর্ম, দর্শন, কাব্য, সাহিত্য চর্চায় নিজেদের নিয়োগ করেছে । রাজস্থান, পাঞ্জাবে ঠিক তেমনটি হয় নি । চরম আবহাওয়ার সাথে সংগ্রাম করে তাদের মধ্যে সংগ্রামী মনোভাব গড়ে উঠেছে ।
*****
- 8045 views