জাতীয় শিক্ষা দিবস ও মৌলানা আবুল কালাম আজাদের জন্মদিন

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 11/05/2019 - 07:37

১১ ই নভেম্বর জাতীয় শিক্ষা দিবস - মৌলানা আবুল কালাম আজাদের জন্মদিন ।

Celebration of National Education Day

Abul kalam Ajad১১ই নভেম্বর ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী, প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, দেশপ্রেমিক, স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিপ্লবী সাংবাদিক ও দার্শনিক প্রয়াত মৌলানা আবুল কালাম আজাদের জন্মদিবস উপলক্ষে সারা দেশে জাতীয় শিক্ষা দিবস হিসাবে পালিত হয় । শিশুর বিনা ব্যয়ে বাধ্যতামূলক শিক্ষার অধিকার আইন ,২০০৯ অনুযায়ী ৬ থেকে ১৪ বছরের প্রতিটি শিশুর প্রারম্ভিক শিক্ষা সুনিশ্চিত করা রাষ্ট্র ও অভিভাবক / অভিভাবিকাদের যৌথ নৈতিক দায়িত্ব । এই আইন ১ লা এপ্রিল ২০১০ সাল থেকে কার্যকরী হয়েছে । ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট ভারতবর্ষ ভাগ যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারতের জন্ম হয় । মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এই দেশ বিভাগের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন । তিনি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলেও, তাঁর দেশপ্রেম ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে তাঁকে বিশেষ মর্যাদার আসনে বসিয়েছে । শিক্ষা তথা বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর স্পষ্ট মতামত, তাঁর সততা ও সাহসকে যথাযত সম্মান প্রদর্শন ও স্মরণ করার উদ্দেশ্যে মৌলানা আবুল কালাম আজাদের জন্মদিনটিকে (Birth anniversary day of Moulana Abul Kalam Azad) ভারতের জাতীয় শিক্ষা দিবস (National Education Day) হিসাবে উদযাপন করা হয় । জাতির জনক (Father of the nation) মহাত্মা গান্ধী তাঁর সম্বন্ধে বলেছেন “Maulana is the Emperor of learning. I consider him as a person of the calibre of Plato, Aristotle and Pythagorus.”

মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ১৮৮৮ সালে ১১ ই নভেম্বর মক্কায় এক সমভ্রান্ত রক্ষনশীল মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন । তাঁর আসল নাম আবুল কালাম মহিউদ্দিন আহমেদ । তাঁর পিতা মৌলানা খয়রুদ্দিন সেকালে আরব, পারস্য ও ভারতবর্ষে ধর্মগুরু হিসেবে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন । তিঁনি ১৮৯০ সালে বসবাসের জন্য কোলকাতায় ফিরে আসেন । মৌলানা আবুল কালাম আজাদ একজন ভারতীয় লেখক, সাংবাদিক, এবং শিক্ষাবিদ ছিলেন । তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম সংগঠক । তরুণ বয়সে তিনি তার ছদ্মনাম আজাদ ধারণ করেন । তার জনপ্রিয় নাম হল মাওলানা আজাদ । তরুণ বয়সে আজাদ দর্শণ ও ধর্মের উপর উর্দুতে কবিতা লিখতেন ।  তিনি মূলত ব্রিটিশ রাজত্ব ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উপর লিখতেন । খিলাফত আন্দোলনের সাথে যুক্ত হবার সময় থেকেই আজাদ মহাত্মা গান্ধীর সংস্পর্শে আসেন । আজাদ গান্ধীর অহিংস আন্দোলন-এর এক চরম ভক্ত হয়ে উঠেন । আজাদ মহাত্মা গান্ধীর 'স্বদেশী আন্দোলনের' সমর্থন করেন এবং বিদেশী পণ্য বর্জন করতে মানুষকে আহব্বান জানান । মাওলানা আজাদ মহম্মদ আলী জিন্নাহ্‌র দ্বি-জাতি তত্ত্ব সমর্থন করেন নি এবং দেশ বিভাগের পর ভারতে থেকে যান । তিনি ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন ।

তিনি “ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম” বইটি রচনা করেছিলেন । এই বইটি মৌলানা আবুল কালাম আজাদের আত্নজীবনীমূলক রচনা হলেও, ভারতীয় ইতিহাসের পাতায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে । ব্রিটিশদের হাত থেকে ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে মৌলানা আজাদের অন্যতম প্রধাণ ভূমিকা ছিল । এই গ্রন্থে তিনি ভারত-ভাগের পটভূমিসহ ১৯৩৫-৪৮ সাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনাবলীর অত্যন্ত নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা দিয়েছেন । অনেক ইতিহাসবিদের কাছেই বইটি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি নির্ভরযোগ্য দলিল হিসেবে অনন্য স্থান দখল করে নিয়েছে ।

মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ছিলেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, ভারতীয় উপমহাদেশের আধুনিক সংবাদপত্র ধারার রূপকার, কবি, দার্শনিক ও শিক্ষা-সংস্কারক । ১৯২৩ সালে মাত্র ৩৫ বছরে তিনি নিখিল ভারত কংগ্রেসের কনিষ্ঠতম সভাপতি নির্বাচিত হন । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্রান্তিকালীন সময়ে ১৯৩৯-৪৬ সাল পর্যন্ত নিখিল ভারত কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে নেতৃত্ব দিয়ে ভারতকে নিয়ে গেছেন স্বাধীনতার বন্দরে । চিরন্তন অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী মৌলানা আজাদ আমৃত্যু হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন । মহম্মদ আলী জিন্নাহ কতৃক প্রস্তাবিত দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ভারত-ভাগকে তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি । তিনি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছেন ভারত-ভাগ ঠেকানোর । কারন, তিনি বিশ্বাস করতেন এর ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানরাই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাঁরা উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে বিভাজিত হয়ে আরো সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে, সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র দুইটিতে বজায় থাকবে চিরকালীন অশান্তি, উভয় দেশেই বার্ষিক বাজেটের উন্নয়ন বরাদ্দ কমে গিয়ে সামরিক বরাদ্দ বাড়বে যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ জনগণ । ভারত-ভাগের এত বছর পরে, তাঁর আশঙ্কাই যেন আজ এই উপমহাদেশের জন্য চির বাস্তবতা ।

রক্ষণশীল পরিবারের সদস্য হওয়ায় মৌলানা আজাদকে বাড়িতে বসেই সাবেকি পদ্ধিতে শিক্ষাগ্রহণের ব্যবস্থা করা হয় । মাত্র ১৫ বছর বয়সেই তিনি আরবী ও ফার্সী ভাষায় বিশেষ দখল অর্জন করেন । তিঁনি আরবীতে দর্শন, জ্যামিতি, গণিত ও বীজগণিতের উপর শিক্ষালাভ করে সাবেকি পদ্ধতিতে শিক্ষা অর্জনের সমস্ত ধাপ সমাপ্ত করেন এবং শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন । রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে উঠে মৌলানা আজাদের মন মুক্তির আশায় ছটফট করতে থাকে । অল্প কিছুদিনের মধ্যে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের লেখা তাঁর নজরে আসে । তিনি আধুনিক দর্শন, বিজ্ঞান ও সাহিত্য সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে উঠেন । এজন্য তিনি তৎকালীন প্রাচ্য শিক্ষা পাঠক্রমের প্রধাণ পরীক্ষক মৌলবী মহম্মদ ইউসুফ জাফরীর কাছে ইংরেজী শিখেন । মৌলানা আজাদ পারিবারিক কক্ষপথ ছেড়ে সত্যের সন্ধানে নিজস্ব পথে বেরিয়ে পড়েন । তিনি এ সম্পর্কে বলেছেন, “প্রথমে যে জিনিসটা আমাকে ফাঁপরে ফেলল, সেটা হল মুসলমানদের নানা গোষ্ঠীর মধ্যকার প্রভেদ নিয়ে শোরগোল । তারা দাবি করে যে, তাদের সকলেরই উৎসস্থল এক; তাহলে কেন তারা একে অন্যের পরিপন্থী, সেটা আমার ঢুকতো না । যেভাবে চোখ বুঝে কোনোরকমে ভাবনা চিন্তা না করে এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়কে ভ্রান্ত আর অবিশ্বাসী বলে দাগিয়ে দিত, তার সঙ্গে আমি নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছিলাম না । গোঁড়া ধর্মবিশ্বাসীদের এই ভেদবুদ্ধি ক্রমশ ধর্ম জিনিসটার ওপরই আমার মনে সন্দেহ ধরাতে থাকে । ধর্ম যদি বিশ্বজনীন প্রকাশ হয়, তাহলে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এত কেন চুলোচুলি আর ঠোকাঠুকি ? প্রত্যেকটি ধর্মই বা কেন নিজেকে সত্যের একমাত্র আধার বলে দাবি করবে এবং কেনই বা অন্য সব ধর্মকে নস্যাৎ করবে ?  এই সময় নাগাদ আমি ‘আজাদ’ বা ‘মুক্ত’ এই ছদ্মনাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিই । এই নামের সাহায্যে আমি বোঝাতে চেয়েছিলাম যে আমি আর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বিশ্বাসের বন্ধনে বাধা নই ।”

১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বৃটিশরাজের শাসন সুবিধার্থে বঙ্গভঙ্গ করলে ভারত বিশেষ করে বাংলায় চরম ক্ষোভ দেখা দেয় । তারা ব্রিটিশরাজ থেকে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য স্বদেশী আন্দোলনে উদ্ধুধ হয়ে বিপ্লবী দল গঠন করেন । এ সময় মৌলানা আজাদ বিপ্লবী শ্রী অরবিন্দ ঘোষ ও শ্রী শ্যামসুন্দর চক্রবর্তীর সংস্পর্শে আসেন এবং বিপ্লবীদের দলে নাম লেখান । বিপ্লবীদলগুলোকে মৌলানা আজাদ একক প্রচেষ্টায় বাংলা থেকে সমগ্র ভারতবর্ষে ছড়িয়ে দেন । দেশব্যাপী জনমত গড়ে তোলার উদ্দ্যেশে তিনি ১৯১২ সালের জুন মাসে ‘আল-হিলাল’ পত্রিকা প্রকাশ করেন । "উর্দু সাংবাদিকতার ইতিহাসে ‘আল-হিলাল’ প্রকাশ এক যুগান্তকারী ঘটনা । অল্প সময়ের মধ্যে এই কাগজ অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল । লোকে এর প্রতি আকৃষ্ট হল শুধু এর উন্নত ধরনের ছাপা আর সৌকর্যের জন্যই নয়, বরং তার চেয়েও বেশি এর প্রচারিত বলিষ্ঠ জাতীয়তাবাদের অভিনব সুরের জন্য” ।

১৯২০ সালে মৌলানা আজাদ তুরস্কের খিলাফৎ ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ভারতীয় মুসলমানদের উদ্বেগকে সামনে রেখে তাদেরকে সংগঠিত করেন, গড়ে তোলেন খেলাফত আন্দোলন । ততদিনে ভারতীয় রাজনীতিতে মহাত্না গান্ধীর আবির্ভাব হলেও, মৌলানা আজাদ জেলে অন্তরীন থাকায় তাঁর সাথে সাক্ষাত হয় নি । গান্ধীজী, লোকমান্য তিলকসহ কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতারা খেলাফত প্রশ্নে ভারতীয় মুসলমানদের মনোভাব সমর্থন করেন । ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশনে গান্ধীজী স্বরাজলাভ এবং খেলাফত সমস্যার সন্তোষজনক মীমাংসার জন্য অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচী গ্রহন করেন । এই সময় গান্ধীজী এবং মৌলানা আজাদ সারা ভারতবর্ষে ব্যপকভাবে সফর করে অসহযোগ আন্দোলনের জন্য জনসমর্থন আদায় করেন । ১৯২০ সালের ডিসেম্বর মাসে নাগপুরে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়  এবং এই অধিবেশনেই মহম্মদ আলী জিন্নাহ চূড়ান্তভাবে কংগ্রেস ত্যাগ করেন ।

১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে, ভারতীয় রাজনীতি নতুন দিকে মোড় নেয় । কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব এ যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা কী হবে তা নিয়ে মত-বিরোধে জড়িয়ে পড়ে । গান্ধীজী খোলাখুলিভাবেই যুদ্ধে জড়ানোর বিরুদ্ধে মত দেন, এমনকি এর বিনিময়ে ভারত স্বাধীনতা পেলেও । “আন্তর্জাতিক দৃশ্যপটে ঝড়-ঝঞ্ঝা যত ঘনিয়ে আসছিল, ততই ঘোরতর বিষাদে গান্ধীজীর মন ভরে উঠছিল । ইউরোপ আর আমেরিকার নানা সমিতি আর ব্যাক্তিবর্গ তাঁর কাছে ব্যগ্রতা জানাচ্ছিলেন, আসন্ন যুদ্ধ ঠেকাবার জন্যে তিনি কিছু করুন । এইসব আবেদন তাঁর ব্যক্তিগত দুঃখ আরও ভারাক্রান্ত করে তুলেছিল । সারা দুনিয়ার শান্তিবাদীরা শান্তিরক্ষার কাজে তাঁকেই স্বাভাবিকভাবে তাদের নেতা হিসেবে দেখেছিল । গান্ধীজী গভীরভাবে এ বিষয়ে ভেবে শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির কাছে প্রস্তাব করেন যে, আসন্ন যুদ্ধে ভারত কোনোক্রমেই যোগ দেবে না, এমনকি তা যদি ভারত স্বাধীনতা লাভ করে, তাহলেও নয়, এই ছিল গান্ধীর মত” । জওহরলাল নেহুরু ও মৌলানা আজাদ ভিন্নমত প্রকাশ করেন । ইউরোপ ও আমেরিকার গণতান্ত্রীক রাষ্ট্রগুলো আক্রান্ত হওয়ায় নেহুরু তাঁদের পাশে দাঁড়াতে পারছেন না দেখে, ভিতরে ভিতরে খুব অশান্তিবোধ করেন ও বিচলিত হয়ে পড়েন । মৌলানা আজাদ ভারতের স্বাধীনতাপ্রাপ্তী সাপেক্ষে নাৎসীবাদ ও ফ্যাসীবাদ শক্তির বিরুদ্ধে গণতান্ত্রীক শক্তির পক্ষে যুদ্ধে অংশ গ্রহনের প্রস্তাব করেন ।

৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯ বৃটেন জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোকে যুদ্ধ ঘোষণা করতে আহ্বান জানায় । ডমিনিয়নের পার্লামেন্টগুলো বসে যুদ্ধ ঘোষণা করলেও, ভারতের ক্ষেত্রে স্বয়ং বড়লাট লর্ড লিনলিথগো কারো সাথে আলোচনা না করেই জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ভারতকে যুদ্ধে ভিড়িয়ে দেয় । এতে গান্ধীজী মানসিকভাবে খুবই ভেঙে পড়েন । “ভারতকে যখন অভদ্রভাবে যুদ্ধে টেনে নামানো হল, গান্ধীজীর মানসিক অশান্তি প্রায় সহ্যের সীমা ছাড়াল । যুদ্ধে ভারতের যোগ দেওয়ার ব্যাপারটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি ।  গান্ধীজী দেখতে পাচ্ছিলেন যে, যুদ্ধে বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এবং তা রোধ করার আর কোনো ক্ষমতা নেই । তাঁর মর্মপীড়া এমন পর্যায়ে পৌছেছিল যে, তিনি বেশ কয়েকবার এমন কি আত্নহত্যা করার কথাও বলেছিলেন । আমাকে তিনি বলেছিলেন যে, যুদ্ধজনিত দুঃখযন্ত্রণা ঠেকানোর ক্ষমতা যদি তাঁর না থাকে, তাহলে অন্তত তাঁর জীবনের অবসান ঘটিয়ে এ জিনিস চোখে দেখার দায় থেকে রেহাই পেতে হবে” ।

১৯৪২ সালের শুরুতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে পড়লে, যুদ্ধে ভারতীয় জনগণের সার্বিক সমর্থন ও অংশগ্রহণ লাভের আশায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের অনুরোধে ভারতীয় সমস্যা সম্পর্কে বৃটিশ সরকার মনোভাব বদল করে । বৃটিশ সরকারের যুদ্ধকালীন মন্ত্রীসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস কমিশন ভারতীয় সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করতে ভারতবর্ষে আসেন । তার প্রস্তাব ছিল, “ বৃটিশ সরকার তখনই এই মর্মে ঘোষণা করবে যে, যুদ্ধ মিটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করা হবে । ঘোষণায় এই মর্মে আরও একটি ধারা যুক্ত থাকবে যে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের ভেতর থাকা না থাকার বিষয়টি ভারত স্বাধীনভাবে স্থির করতে পারবে । যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের জন্যে একজিকিউটিভ কাউন্সিল পুনর্গঠিত হবে এবং তার সদস্যরা মন্ত্রীর পদমর্যাদা পাবে । বড়লাট থাকবেন নিয়মতান্ত্রিক প্রধান হিসেবে । এইভাবে এটা হবে প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতা হস্তান্তর, তবে এই হস্তান্তর আইন মোতাবেক হতে পারবে কেবল যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর” ।  প্রথম থেকেই গান্ধীজী যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিপক্ষে ছিলেন, তাই তিনি এই প্রস্তাব সমর্থন করেন নি্, কিন্তু কংগ্রেসের শীর্ষনেতৃত্বকে ভারতের মঙ্গলের স্বার্থে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছিলেন । ২৯ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল, ১৯৪২ একটানা কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির অধিবেশনে দিনের বেলায় ক্রিপসের প্রস্তাবগুলো আলোচিত হয় এবং সন্ধ্যায় মৌলানা আজাদ ও জওহরলাল নেহেরু ক্রিপসের সাথে কথা বলেন । কংগ্রেস যুদ্ধের পরে ভারতকে স্বাধীনতা প্রদান করা হবে, একজিকিউটিভ কাউন্সিল মন্ত্রীসভার ন্যায় ক্ষমতাভোগ করবেন, যুদ্ধ একজন ভারতীয় মন্ত্রীর অধীনে পরিচালিত হবে ও বড়লাট থাকবেন নিয়মতান্ত্রিক প্রধান এই মর্মে লিখিত ঘোষণা চাইছিল । স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস শেষ পর্যন্ত তাঁর পূর্ব অবস্থান থেকে সরে এলে, এই মিশন ব্যর্থ হয়ে যায় ।

১৯৪২ সালের জুনে জাপান কর্তৃক ভারত আক্রমণ বিশেষ করে বাংলা দখলের আশঙ্কা, ভারতীয় রাজনীতিতে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে । করণীয় নির্ধারণে কংগ্রেস নেতৃত্ব দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে । যুদ্ধের শুরুর দিকে মৌলানা আজাদ বিভিন্নভাবে গান্ধীজীকে বৃটিশের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে আন্দোলনের কথা বললেও তিনি নির্লিপ্ত ছিলেন, কিন্তু জাপানী বাহিনীর ভারত আক্রমণের আশঙ্কাকে কেন্দ্র করে গান্ধীজী নতুন করে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের কথা বলেন । মৌলানা আজাদ ও জওহরলাল নেহুরু গান্ধীজীর এই মতকে সমর্থন করতে পারেন নি । মৌলানা আজাদের আশঙ্কা ছিল, ভারতীয় সীমান্তে যখন শত্রুপক্ষ দাঁড়িয়ে, বৃটিশ সে সময়ে সংঘবদ্ধ কোনো আন্দোলন সহ্য করবে না, সব কংগ্রেস নেতাকে গ্রেপ্তারসহ প্রয়োজনে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে আন্দোলন দমন করবে । “গান্ধিজী ধারণা করেছিলেন যে যুদ্ধ ভারতের সীমান্তে এসে যাওয়ায় আন্দোলন শুরু হওয়া মাত্র বৃটিশ কংগ্রেসের সঙ্গে একটা রফা করে নেবে । যদি তা নাও হয় তবু জাপানীরা যখন ভারতের দোরগোড়ায় তখন কোনো চরম পথ নিতে বৃটিশ ইতস্তত করবে না । তিনি ভেবেছিলেন এর ফলে কংগ্রেস একটি সার্থক আন্দোলন গড়ে তোলার সময় এবং সুযোগ পাবে” । ১৯৪২ সালের ১৪ জুলাই মৌলানা আজাদ ও জওহরলাল নেহুরুর সমর্থন ছাড়াই কংগ্রেস ব্রিটিশ বিরোধী অহিংস বিপ্লব “ভারত ছাড়” আন্দোলন ঘোষণা করে এবং পরবর্তীতে মৌলানা আজাদের আশঙ্কাই সত্যি হয় । সরকার গান্ধীজীসহ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করে দীর্ঘ সময়ের জন্য জেলে পাঠায় এবং “ভারত ছাড়” আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যায় ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে বৃটিশ সরকার পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় । ভারত-সচিব লর্ড পেথিক লরেন্স, বোর্ড অব ট্র-এর সভাপতি স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এবং ফাস্ট লর্ড অব অ্যাডমিরালটি মিঃ এ. ভি. আলেক্সান্ডারের সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্য বিশিষ্ট ক্যাবিনেট মিশন আলোচনার উদ্দেশ্যে ২৩ মার্চ, ১৯৪৬ ভারত আসেন । ভারতের স্বাধীনতা প্রদানের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় ভারতের সাম্প্রদায়িক সমস্যা । মুসলমানরা তিনটি প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও সামগ্রিকভাবে ভারতে তারা সংখ্যালঘু । ১৯৩৯ সালে জিন্নাহর দ্বি-জাতিতত্ত্ব ঘোষণা, ১৯৪০ সালে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোতে পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত লাহোর প্রস্তাব, পরবর্তীতে সংশোধিত পাকিস্তান প্রস্তাবের মাধ্যমে মূলত মুসলমানরা বিচ্ছিন্নতাবাদের পথে অগ্রসর হয় । এ সময় মুসলমানদের মন থেকে হিন্দুদের আধিপত্যের ভয় দূর করার বাস্তব উপায় খুঁজতে থাকেন মৌলান আজাদ । তিনি প্রস্তাব করেন, ভারতের সাম্প্রদায়িক সমস্যা দূর করার একমাত্র উপায় ভারতের সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন, কেন্দ্রিয় সরকারের হাতে থাকবে শুধু প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ ও পররাষ্ট্র, বাকি সব বিষয় থাকবে প্রদেশগুলোর হাতে । এভাবে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে তাদের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা ধরে রেখে সর্বভারতীয় সরকারে আলাদা ভূমিকা রাখতে পারবেন । তাঁর এই প্রস্তাব গান্ধীজীসহ শীর্ষ কংগ্রেস নেতৃত্ব সমর্থন করেন । পরবর্তীতে ১৬ মে ক্যাবিনেট মিশন সেই প্রস্তাব অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহন করে সমগ্র ভারতকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করেন, ‘ক’ অংশে পড়ে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল, ‘খ’ অংশে পাঞ্জাব, সিন্ধু প্রদেশ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বৃটিশ বালুচিস্তান এবং ‘গ’ অংশে বাংলা ও আসাম । এই পরিকল্পনা মুসলীম লীগ মেনে নিলে ভারত-ভাগের প্রধান বাধা সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান হয় । কিন্তু ইতিহাসের দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায় তখনও অপেক্ষায় ছিল । জওহরলাল নেহুরু ১০ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের উত্তরে বলে বসেন, “কংগ্রেস ‘বোঝাপড়ার কোনোরকম বাঁধন না মেনে এবং সব সময় অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা গ্রহণের স্বাধীন মনোভাব নিয়ে’ গণপরিষদে প্রবেশ করবে । সংবাদপত্রের প্রতিনিধিরা আরও জিজ্ঞেস করেন, এর মানে এটা কিনা যে, ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনার হেরফের করা যাবে । এর উত্তরে জওহরলাল জোর দিয়ে বলেন যে, কংগ্রেস রাজী হয়েছে শুধু গণপরিষদে যোগ দিতে এবং মনে করে যে, তেমন বুঝলে কংগ্রেস অবাধে ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনার রদবদল বা ইতরবিশেষ করতে পারে” । নেহুরুর এই ঘোষণার পরে জিন্নাহ কংগ্রেসের মনোভাব নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন । দেশ স্বাধীন হবার আগেই কংগ্রেস মত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিলে, পরবর্তীতে মুসলমানরা কতটুকু নিরাপদ হতে পারে, এই ভাবনা থেকেই জিন্নাহ ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা বিষয়ে মুসলীম লীগের পূর্ববর্তী সমর্থন প্রত্যাহার করে স্বাধীন পাকিস্তানের দাবী পুনর্ব্যক্ত করেন । ফলশ্রুতিতে ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায় ।

বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী মিঃ এটলি লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ১৯৪৮ সালের ৩০ জুনের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়সীমা বেধে দিয়ে শেষ ভাইসরয় করে পাঠান ।  মৌলানা আজাদ লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সাথে বেশ কয়েকবার দেখা করে ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাব অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী জানান । কিন্তু মাউন্টব্যাটেন পাকিস্তান প্রস্তাবকে সামনে রেখে অগ্রসর হন । এক্ষেত্রে তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বল্লবভাই প্যাটেল ও জওহরলাল নেহুরুকে পাশে পান । জওহরলাল নেহুরু প্রথম দিকে ভারত-ভাগের বিরোধী ছিলেন । কিন্তু লেডী মাউন্টব্যাটেনের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকায়, তিনি মত বদল করে ফেলেন । “জওহরলালের ভোল বদলের পেছনে একটা কারণ লেডি মাউন্টব্যাটেন । ভদ্রমহিলা যেমন অতীব বুদ্ধিমতি তেমনি ভারী মায়াবী আর বন্ধুভাবাপন্ন । তিনি ছিলেন তাঁর স্বামীর খুব গুনগ্রাহী এবং বহুক্ষেত্রে তাঁর স্বামীর সঙ্গে যাদের গোড়ায় মতের অমিল হত তাদের কাছে তিনি স্বামীর বক্তব্য ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন” । গান্ধীজীও প্রথম দিকে ভারত ভাগের বিরোধী ছিলেন । মৌলানা আজাদ ভারত-ভাগ ঠেকানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে গান্ধীজীর শরনাপর্ন হয়ে বলেন, “যেমন এতদিন, তেমনি এখনও আমি দেশভাগের বিরুদ্ধে । বরং দেশভাগের বিরুদ্ধে আমার মনোভাব আগের চেয়েও কড়া । এখন আপনিই আমার একমাত্র ভরসা । আপনি যদি দেশভাগের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, এখনও আমাদের শেষ রক্ষার আশা আছে । তবে আপনি যদি চুপ করে থাকেন তো আমার ভয়, ভারতের ভরাডুবি হবে” । গান্ধীজী প্রতি উত্তরে বলেন, দেশভাগ হলে আমার মৃতদেহের উপর দিয়ে হবে । কিন্তু প্যাটেল ও নেহুরু বুঝিয়ে সুঝিয়ে শেষ পর্যন্ত তাদের পক্ষে নিয়ে আসেন । মৌলানা আজাদ গভীর দুঃখ নিয়ে বলেন, “প্যাটেলকে আজ জিন্নার চেয়েও দ্বিজাতিতত্ত্বের বড় সমর্থক হতে দেখে আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম । দেশ ভাগের পতাকা জিন্না তুলে থাকলেও তার প্রকৃত পতাকাবাহক এখন প্যাটেল” ।

১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ই আগস্ট ভারতবর্ষ ভাগ যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারতের জন্ম হয় । মৌলানা আজাদ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলেও, তাঁর দেশপ্রেম ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে তাঁকে বিশেষ মর্যাদার আসনে বসিয়েছে । বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর স্পষ্ট মতামত, তাঁর সততা ও সাহসকে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ নতুন করে প্রশংসা করতে বাধ্য হবে । তিনি ১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মারা যান ।

***

Related Items