ভাষার ভিত্তিতে ভারতে রাজ্য পুনর্গঠনের উদ্যোগ ও বিতর্ক (Initiatives Undertaken and Controversies Related to Linguistic Reorganization of States):-
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট অবিভক্ত ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে । স্বাধীনতা লাভের পর নবগঠিত স্বাধীন ভারতরাষ্ট্রকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় । এই সমস্যাগুলির মধ্যে অন্যতম সমস্যা ছিল ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন । স্বাধীন ভারতে অধিকাংশ দেশবাসী ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের দাবি করেছিল । এই দাবিকে খতিয়ে দেখার জন্য ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে এস কে দারের নেতৃত্বে ভারত সরকার 'ভাষাভিত্তিক প্রদেশ কমিশন' গঠন করে । ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠিত হলে জাতীয় ঐক্য বিঘ্নিত হবে এবং প্রাদেশিক ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেবে—এই মত প্রকাশ করে কমিশন তার প্রতিবেদনে রাজ্যগুলির ভাষাভিত্তিক পুনর্গঠনের দাবির বিরোধিতা করে । কমিশনের এই মতের বিরুদ্ধে দক্ষিণের অধিবাসীরা ক্ষুব্দ হয়ে ওঠে ও তারা আগের তুলনায় আরও ব্যাপকভাবে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে । আন্দোলন প্রশমনের উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল ও পট্টভি সিতারামাইয়া -কে নিয়ে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে । এটি 'জে ভি পি' কমিটি নামে পরিচিত । 'জে ভি পি' কমিটিও ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১লা এপ্রিল তার প্রতিবেদনে জানায় যে, এই মুহূর্তে ভাষার ভিত্তিতে নতুন রাজ্য গঠন করা সম্ভব নয় ।
কিছুদিনের মধ্যেই ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের দাবিতে ক্রমশই তীব্র থেকে তীব্রতর আন্দোলন শুরু করে । মাদ্রাজ প্রদেশের তেলেগু ভাষাভাষী জনগণ পৃথক অন্ধ্ররাজ্যের দাবি তুললে তেলেগুভাষী ও তামিলভাষীদের মধ্যে মতভেদ চরমে পৌঁছোয় । তেলেগুভাষীরা পূর্বতন মাদ্রাজ প্রদেশেকে তামিল ও তেলেগু দুটি আলাদা প্রদেশে ভাগ করার দাবি তোলে । এক্ষেত্রে মাদ্রাজ শহরটি কোন ভাগে যাবে তা নিয়ে বিরোধ বাধে । তেলেগুভাষী গান্ধিবাদী নেতা পট্টি শ্রীরামালু মাদ্রাজের তেলেগুভাষী ১১টি জেলা নিয়ে পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য গঠনের দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করেন ও একটানা ৫৮ দিন অনশন করার পর ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন । তাঁর মৃত্যুর পর সারা অন্ধ্রপ্রদেশ জুড়ে তীব্র আন্দোলন ও দাঙ্গাহাঙ্গামা শুরু হয়ে যায় । শেষে কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে ডিসেম্বর অন্ধ্ররাজ্য গঠনে সম্মতি দেয় এবং ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ১লা অক্টোবর অন্ধ্রপ্রদেশ নামে আলাদা রাজ্য আত্মপ্রকাশ করে । সেই সঙ্গে তামিলভাষী মানুষদের জন্য তামিলনাড়ু আলাদা রাজ্য গঠিত হয় ।
অন্ধ্রপ্রদেশ ও তামিলনাড়ু রাজ্য গঠিত হলে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের দাবিতে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে আন্দোলন শুরু হয় । এই পরিস্থিতিতে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে কেন্দ্রীয় সরকার 'রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন' গঠন করে । এই কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১লা নভেম্বর সংসদে 'রাজ্য পুনর্গঠন আইন' পাস হয় । এই আইনের দ্বারা ১৪টি রাজ্য এবং ৬টি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল গঠিত হয় । ১৪টি রাজ্য হল — (i) অন্ধ্রপ্রদেশ, (ii) আসাম, (iii) উড়িষ্যা, (iv) উত্তরপ্রদেশ, (v) কেরালা, (vi) জম্মু ও কাশ্মীর, (vii) পশ্চিমবঙ্গ, (viii) পাঞ্জাব, (ix) বিহার, (x) বোম্বাই, (xi) মধ্যপ্রদেশ, (xii) মহীশূর, (xiii) মাদ্রাজ, (xvi) রাজস্থান এবং ৬টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হল— (i) ত্রিপুরা, (ii) আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, (iii) দিল্লি, (iv) লাক্ষাদ্বীপ, (v) মণিপুর (vi) হিমাচল প্রদেশ । হায়দ্রাবাদ রাজ্য থেকে তেলেঙ্গানা অঞ্চলকে পৃথক করে অন্ধ্রপ্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হয় । পুরাতন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির মালাবার অঞ্চলের সঙ্গে ত্রিবাঙ্কুর-কোচিন যুক্ত করে নতুন কেরল রাজ্য গঠন করা হয় । হায়দ্রাবাদের মারাঠি ভাষাভাষী অঞ্চল এবং সৌরাষ্ট্র ও কচ্ছকে বোম্বাই রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করা হয় । বিহারের পূর্ণিয়া জেলার কিছুটা অংশ এবং পুরুলিয়াকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করা হয় ।
রাজ্য পুনর্গঠন আইন দ্বারা বোম্বাই প্রদেশে বসবাসকারী মারাঠি ও গুজরাটি ভাষাভাষীদের জন্য পৃথক রাজ্য গঠিত না হওয়ায় বোম্বাই প্রদেশের মারাঠি ও গুজরাটি ভাষাভাষীরা পৃথক রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে । ভরত সরকারের তরফে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, বোম্বাই প্রদেশকে ভাষার ভিত্তিতে দুটি আলাদা রাজ্যে ভাগ করা হবে এবং বোম্বাই শহরকে কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক রাজ্য হিসেবে গঠন করা হবে । মারাঠি-ভাষী ও গুজরাটি ভাষীরা এই সিদ্ধান্তের তীব্র আপত্তি জানায় । এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে মারাঠি অঞ্চলে গঠিত 'সংযুক্ত মহারাষ্ট্র সমিতি' এবং গুজরাটি অঞ্চলে গঠিত 'মহাগুজরাট জনতা পরিষদ' পৃথক রাজ্যের দাবিতে আন্দোলনকে তীব্রতর করে তোলে । উভয় সংগঠনের নেতৃত্বে পাঁচ বছর আন্দোলন চলে । অবশেষে ভারত সরকার ভাষার ভিত্তিতে বোম্বাই প্রদেশকে দুটি ভাগে ভাগ করে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের ১লা মে মারাঠি ভাষীদের নিয়ে 'মহারাষ্ট্র' রাজ্য ও গুজরাটি ভাষীদের নিয়ে 'গুজরাট' রাজ্য গঠন করে । বোম্বাই বর্তমানে মুম্বাই শহরকে মহারাষ্ট্র রাজ্যের রাজধানী ও আমেদাবাদ শহরকে গুজরাট রাজ্যের রাজধানী করা হয় ।
পাঞ্জাবেও মূলত পাঞ্জাবি ও হিন্দি ও পাহাড়ি ভাষীদের মধ্যে ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠন নিয়ে ভাষাভিত্তিক আন্দোলন গড়ে ওঠে । পাঞ্জাবি ভাষীরা ছিল শিখ আর হিন্দি ভাষীরা ছিল হিন্দু । আকালী দলের নেতৃত্বে শিখরা ও জনসংঘ দলের নেতৃত্বে হিন্দুরা ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে । ইন্দিরা গান্ধির সরকার ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১লা নভেম্বর পাঞ্জাবকে পাঞ্জাবি, হিন্দি ও পাহাড়ি এই তিন অঞ্চলে ভাগ করে পাঞ্জাব রাজ্য, হরিয়ানা রাজ্য ও হিমাচল প্রদেশ পুনর্গঠিত করে । পাঞ্জাব, হরিয়ানা দুটি পৃথক রাজ্য হলেও চন্ডিগড় এই দুটি রাজ্যেরই রাজধানী হয় । স্বাধীনতার পরে ভাষার ভিত্তিতে ভারতে এইভাবে বিভিন্ন রাজ্য পুনর্গঠিত হয় ।
স্বাধীনতা আন্দোলনকালে জাতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষার বদলে মাতৃভাষার দাবি ওঠে । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে জওহরলাল নেহরু সকলেই মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দিতে বলেন । স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় হিন্দি ও ইংরেজি ভাষাতেই ভারতের বক্তব্য প্রকাশিত হত । এর মধ্যে কোন ভাষাটি রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পাবে তা নিয়ে সংবিধান সভায় বিতর্ক হয় । তাই সংবিধান প্রণেতারা হিন্দি ভাষার সঙ্গে ইংরেজি ভাষাকেও যোগাযোগের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন । পরে এক কমিটি গঠন করে সিদ্ধান্ত হয়, ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে হিন্দি সরকারি ভাষার মর্যাদা পাবে এবং তার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাও বহাল থাকবে । এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক হলে ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে অনির্দিষ্ট সময়কালের জন্য দ্বি-ভাষিক রাষ্ট্রভাষা স্বীকৃত হয় ।
স্বাধীনতা লাভের পর ভারতের ১২০ কোটিরও অধিক জনগণ প্রায় ১৬৫২টি ভাষায় কথা বলেন । ভারতের মোট জনসংখ্যার ৪৫% হিন্দি এবং হিন্দির সঙ্গে জড়িত উর্দু ও হিন্দুস্তানি ভাষায় কথা বলেন । সংবিধান প্রণেতাগণ এই ভাষাগুলির মধ্যে কয়েকটিকেই সবিধানের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন এবং সংবিধানের প্রবর্তনকালে অর্থাৎ ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি মোট ১৪টি ভাষা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয় । এগুলি হল— (i) অহমিয়া, (ii) বাংলা, (iii) গুজরাটি, (iv) হিন্দি, (v) কন্নড়, (vi) কাশ্মীরি, (vi) মালয়ালম, (vii) মারাঠি, (viii) ওড়িয়া, (ix) পাঞ্জাবি, (x) সংস্কৃত, (xi) তামিল, (xii) তেলেগু ও (xiv) উর্দু । ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই ১৪টি ভাষা সংবিধানে স্বীকৃত হয় । ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ২১তম সংশোধনীতে সিন্ধি ভাষাকে স্বীকৃত দিয়ে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হলে মোট সাংবিধান স্বীকৃত ভাষার সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫টি । এইভাবে ক্রমাগত সংবিধান সংশোধন করে কোঙ্কনি, নেপালি, মণিপুরি, বোডো, ডোগরি, মৈথিলি ও সাঁওতালি ভাষাকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে বর্তমানে মোট ২২টি সংবিধান স্বীকৃত ভাষা হয়েছে ।
*****