ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রসার

Submitted by avimanyu pramanik on Fri, 04/20/2012 - 22:00

ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রসার :

১৭৯৯ ও ১৮১৮ সালের মধ্যে মহীশূর ও মারাঠা শক্তির অবসান ঘটলে দক্ষিণ ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সম্প্রসারিত হয় । ভুপাল, মালব, বুন্দেলখন্ড, এমকি জয়পুর, যোধপুর, উদয়পুরের রাজারা ইংরেজদের অধীনতা স্বীকার করে বার্ষিক করদানে স্বীকৃত হন । উত্তর ভারতের গোর্খারা ও মধ্য ভারতের পিন্ডারী দস্যুদল এইসময় ব্রিটিশ শাসককে উদ্বিগ্ন করে রেখেছিল । নেপাল ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে কোনো সুস্পষ্ট সীমারেখা না থাকায় উভয়ের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ লেগে থাকত । ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে লর্ড হেস্টিংস গোর্খাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন । এই যুদ্ধ ১৮১৪ থেকে ১৮১৬ সাল পর্যন্ত দুই বছর স্থায়ী হয়েছিল । অক্টারলোনির নেতৃত্বে ইংরেজ সেনাবাহিনী গোর্খাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে গোর্খাদের পরাজিত করেন । গোর্খা সেনাপতি অমর বাহাদুর ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন ও ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে সগৌলির সন্ধি স্বাক্ষর করেন । 

সগৌলির সন্ধি (Treaty of Sagauli)

নেপাল যুদ্ধের পর ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে নেপালের রাজা ও ইংরেজ কোম্পানির মধ্যে এই সগৌলির সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় । উত্তর ভারতের গোর্খারা ব্রিটিশ শাসককে উদ্বিগ্ন করে রেখেছিল । নেপাল ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে কোনো সুস্পষ্ট সীমারেখা না থাকায় উভয়ের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ লেগে থাকত । ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে লর্ড হেস্টিংস গোর্খাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন । এই যুদ্ধ ১৮১৪ থেকে ১৮১৬ সাল পর্যন্ত দুই বছর স্থয়ী হয়েছিল । অক্টারলোনির নেতৃত্বে ইংরেজ সেনাবাহিনী গোর্খাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে গোর্খাদের পরাজিত করেন । গোর্খা সেনাপতি অমর বাহাদুর ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন ও ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে এই সন্ধি স্বাক্ষর করেন । সগৌলির সন্ধির শর্ত অনুসারে ইংরেজ কোম্পানি সিমলা, কুলু, মানালি, মুসৌরি, আলমোড়া, নৈনিতাল, রানিখেত, কৌসানি প্রভৃতি রমণীর পার্বত্য শৈলাবাস অঞ্চল লাভ করে এবং নেপালের রাজধানী কাটমান্ডুতে একজন ইংরেজ রেসিডেন্ট রাখার ব্যবস্থা করা হয় । অর্থাৎ এই সন্ধির ফলে ব্রিটিশ পক্ষের রাজ্য ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায় ।

প্রথম ব্রহ্ম যুদ্ধ (First Anglo-Burma War)

লর্ড ময়রা পিন্ডারী দস্যুদলকে দমন করে খ্যাতি লাভ করেন । তিনি মারকুইস অফ হেস্টিংস নামে পরিচিত হয়েছিলেন । তাঁর আমলে বর্মীরা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে রাজ্যসীমা বৃদ্ধির চেষ্টা করেন । ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্মদেশের রাজা ইংরেজদের কাছ থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, মুর্শিদাবাদ, এবং কাশিমবাজার দাবি করেন । ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে বর্মীসেনা আসাম অধিকার করে ও পরে চট্টগ্রামে এসে উপস্থিত হলে সমগ্র বাংলার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় । এসময়ে হেস্টিংস স্বদেশে ফিরে যান ও লর্ড আমহার্স্ট তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন । লর্ড আমহার্স্টের আমলে ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে রাজা থিবোর মধ্যে প্রথম ব্রহ্ম যুদ্ধ হয় । ইংরেজ সেনা আরাকান ও মণিপুর দুদিক থেকে অগ্রসর হয়ে বর্মীসেনাদের পরাজিত ও ছত্রভঙ্গ করে দেন । ইংরেজ সেনাপতি ক্যাম্বেল ইয়ান্দাবু নামক স্থানে উপস্থিত হন । এই অবস্থায় ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্মরাজ ইংরেজদের সঙ্গে ইয়ান্দাবু সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন ।

ইয়ান্দাবু সন্ধির শর্তানুসারে ব্রহ্মরাজ 

(১) আরাকান ও টেনাসেরিম ইংরেজদের হাতে ছেড়ে দেন,

(২) আসাম, কাছাড় ও জয়ন্তিয়ায় হানা না দেবার প্রতিশ্রুতি দেন 

(৩) মনিপুরের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেন এবং যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ এক কোটি টাকা দিতে স্বীকৃত হন ।

প্রথম আফগান যুদ্ধ (First Anglo-Afgan War)

১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে ইয়ান্দাবুর সন্ধির ফলে আসাম, কাছাড়, মণিপুর ইংরেজদের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয় । লর্ড আমহার্স্টের পরবর্তী দুই গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেণ্টিঙ্ক ও চার্লস মেটকাফের আমলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বেশি বিস্তার লাভ করে নি । মেটকাফের পরবর্তী গভর্নর জেনারেল লর্ড অকল্যান্ডের সময় ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম আফগান যুদ্ধ হয় । এই যুদ্ধে আফগানদের হাতে ইংরেজদের শোচনীয় পরাজয়ে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্মান ও প্রতিপত্তি দুইই ক্ষুন্ন হয়েছিল । আফগানদের হাতে ইংরেজদের শোচনীয় পরাজয়ের পর লর্ড অকল্যান্ড স্বদেশে ফিরে যান ও লর্ড এডেনবরা তাঁর জায়গায় গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হয়ে আসেন । লর্ড এডেনবরা আফগানদের বিরুদ্ধে বিশাল বাহিনী পাঠিয়ে কাবুল পুনর্দখল করেন ও আফগানদের উপর পরাজয়ের চরম প্রতিশোধ নেন । তবুও কিন্তু আফগানদের পুরোপুরি দমন করা সম্ভব হয় নি । তখন দোস্ত মহম্মদকে পুনরায় সিংহাসনে স্থাপন করে ইংরেজরা আফগানিস্তান থেকে সরে আসেন । আফগানিস্তানে ব্যর্থতার পর ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড এডেনবরা ইংরেজ সেনাপতি চার্লস নেপিয়ারের সহায়তায় সিন্ধুদেশের আমীরদের পরাজিত করে সিন্ধুপ্রদেশ অধিকার করেন ।            
 

ইঙ্গ-শিখ সম্পর্ক (Anglo-SIkh Relationship)

দশম শিখ গুরু গোবিন্দ সিং -এর আমলে শিখগণ এক সামরিক জাতিতে পরিণত হয়েছিল । গুরু গোবিন্দ সিংহের মৃত্যুর পর বান্দা বাহাদুর নামে এক বিশ্বস্ত নেতা সংঘবদ্ধ শিখদের নিয়ে মোগলদের বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রাম চালিয়ে যান । কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি ১৭১৬ খ্রিস্টাব্দে মোগল সম্রাট ফারুকশিয়ারের হাতে পরাজিত ও নিহত হন । তাঁর মৃত্যুর পর শিখরা উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে আবার ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় । শিখরা সমগ্র শিখ অঞ্চলটি বারোটি মিসল বা দলে ভাগ করে নিয়ে এক একটি মিসল -এর নায়ক হয়ে বসেন । এরূপ একটি মিসল সুকেরচকিয়ার নায়ক ছিলেন মহাসিংহ । পিতা মহাসিংহের অকাল মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রঞ্জিত সিংহ মাত্র বার বছর বয়সে রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ করেন । কাবুলের রাজা জামান শাহ আবদালী ভারত আক্রমণ করলে তাঁকে সাহায্যের পুরস্কার স্বরূপ রঞ্জিত সিংহকে লাহোরের শাসন কর্তা নিযুক্ত করেন ও তাঁকে 'রাজা' উপাধি দেন । তখন ইংরেজরা রঞ্জিত সিংকে সম্মান জানিয়ে ইউসুফ আলিকে লাহোরে পাঠান । এরপর রঞ্জিত সিংহ মীরওয়াল ও নারওয়াল স্থান দুটি অধিকার করে জম্মুতে অভিযান করেন । জম্মুর রাজা রঞ্জিতের বশ্যতা স্বীকার করে তাঁকে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ প্রচুর অর্থ দান করেন । ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি অমৃতসর শহর অধিকার করলে তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায় । ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে 'লাহোরের সন্ধি' দ্বারা ব্রিটিশরা শিখবিরোধী কোনো কাজ না করার কথা বলেন । কিন্তু রঞ্জিত সিং -এর শক্তি বৃদ্ধিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে ফরাসি ভীতির মিথ্যা অজুহাতে লর্ড মিন্টো চার্লস মেটকাফকে পাঠিয়ে ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দ রঞ্জিত সিং কে 'অমৃতসরের সন্ধি' স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন । আর্মহাস্টের আমলে ইঙ্গ-শিখ সম্পর্ক ঠিক থাকে । কিন্তু বেন্টিঙ্ক ও অকল্যান্ডের আমলে এই সম্পর্কে চিড়  ধরেছিল ।                  

অমৃতসরের সন্ধি (Treaty of Amritsar)

পাঞ্জাবের বিবাদমান ছোটো মিসল গুলির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে পাঞ্জাবে এক শক্তিশালী শিখ রাজ্য গড়ে তোলাই ছিল রঞ্জিত সিংহের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য । এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তিনি ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে অমৃতসর দখল করে শতদ্রু নদীর পূর্ব তীরের শিখ রাজ্যগুলি অধিকার করতে উদ্দ্যোগী হন । এতে ওই সমস্ত শিখ রাজ্যের নায়ক গণ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ইংরেজদের শরণাপন্ন হন । ইংরেজ গভর্নর জেনারেল লর্ড মিন্টো রঞ্জিত সিংহের সঙ্গে বোঝাপড়ার জন্য চার্লস মেটাকাফকে তাঁর দরবারে পাঠান । ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবের মহারাজা রণজিৎ সিংহ এবং ইংরেজদের পক্ষে গভর্নর-জেনারেল লর্ড মিন্টোর প্রতিনিধি হিসাবে চার্লস মেটকাফ -এর মধ্যে অমৃতসরের সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় । অমৃতসরের সন্ধির শর্ত অনুসারে ঠিক হয় যে, শতদ্রু নদীর পূর্বদিকে রণজিৎ সিংহ আর রাজ্যবিস্তার করতে পারবেন না । অর্থাৎ তাঁকে পশ্চিম পাঞ্জাবের নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যেই রাজ্যবিস্তার সীমাবদ্ধ রাখতে হবে । অমৃতসরের সন্ধির মাধ্যমে ইংরেজরা শতদ্রু নদীর পূর্বতীরে রণজিৎ সিংহের রাজ্যবিস্তার সম্পূর্ণভাবে রোধ করে ছিল । এই সন্ধির ফলে রণজিৎ সিংহের মর্যাদাহানি হয় এবং ব্রিটিশ পক্ষের রাজ্য ও প্রভাব বৃদ্ধি পায় । অমৃতসরের চুক্তির ফলে রণজিৎ সিংহের পক্ষে শতদ্রু নদীর পূর্বতীরে রাজ্য বিস্তারের আর কোনো সুযোগ রইল না । যাই হোক, অমৃতসরের সন্ধির পরবর্তী সময়ে তিনি মুলতান, ঝঙ্গ, কাশ্মীর, ডেরা ইস্‌মাইল খাঁ, ডেরা গাজি খাঁ ও পেশোয়ার অধিকার করেন । যার ফলে তাঁর সাম্রাজ্য লাহোর থেকে সিন্ধু পর্যন্ত বিস্তৃত হয় ।

অমৃতসরের সন্ধির শর্তগুলি ছিল-

১) শতদ্রু নদীকে রণজিৎ সিংহের রাজ্যের পূর্ব সীমারেখা বলে স্থির হয়  ।

২) শতদ্রু নদীর পূর্ব তীরের রাজ্যগুলির ওপর ইংরেজদের আধিপত্য স্বীকার করে নেওয়া হয় ।

৩) উভয় পক্ষ ‘স্থায়ী মৈত্রী’ বজায় রাখতে স্বীকৃত হন ।

পূর্বদিকে রাজ্যবিস্তারে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে রঞ্জিত সিংহ পশ্চিম দিকে রাজ্য বিস্তারে সচেষ্ট হন । ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি আফগানদের পরাস্ত করে আটক অধিকার করেন । ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি মুলতান, কাশ্মীর ও পেশোয়ার জয় করে তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত করেন । ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইংরেজদের সঙ্গে রঞ্জিত সিংহের সদ্ভাব বজায় থাকলেও নানা বিষয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে মন কষাকষি চলছিল । ইতিমধ্যে রাশিয়া পারস্যে অধিকার বিস্তার করলে ভারতের নিরাপত্তা সম্পর্কে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ আশঙ্কিত হন । এছাড়া সিন্ধুদেশের রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব সম্পর্কে ইংরেজরা ক্রমে আগ্রহী হয়ে উঠছিলেন । এমতাবস্থায় তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্ক রাশিয়ার অগ্রগতি রোধ করার উদ্ধেশ্যে রঞ্জিত সিংহ ও সিন্ধুর আমীরদের প্রতি ঘনিষ্টতা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন । এর ফলশ্রুতিতে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে কাবুলের সিংহাসনচ্যুত রাজা শাহসুজা, রঞ্জিত সিংহ ও ইংরেজদের মধ্যে 'ত্রিশক্তি মৈত্রী চুক্তি' স্বাক্ষরিত হয় । ওই বছরই রঞ্জিত সিংহের জীবনাবসান হয় ।  

ত্রিশক্তি মৈত্রী চুক্তিঃ আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে রণজিৎ সিংহ অত্যন্ত কূটনৈতিক চাতুর্যের পরিচয় দেন । ইংরেজদের পরোক্ষ সহযোগিতায় সাময়িকভাবে আফগানিস্তানের উপর নিজের আধিপত্য কায়েমে সক্ষম হলেও ইংরেজদের হস্তক্ষেপের ফলে ১৮৩৯ সালে শাহসুজা, ইংরেজ ও রণজিৎ সিংহের মধ্যে 'ত্রিশক্তি মৈত্রী চুক্তি' স্বাক্ষরিত হয় । অবশেষে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে রণজিৎ সিংহের মৃত্যু হয় । এইভাবে প্রতিটি ব্যাপারেই ইংরেজদের সঙ্গে আপসের মাধ্যমে রণজিৎ সিংহ নিজের অস্তিত্বকে বজায় রেখে চলেছিলেন । কারণ সমসাময়িক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে রণজিৎ সিংহ সঠিকভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন যে, অমিতশক্তিশালী ব্রিটিশ শক্তির সঙ্গে লড়াইয়ে তিনি কোনোদিনই জয়লাভ করতে পারবেন না । তাই বাস্তবোচিত নীতি গ্রহণ করে তিনি নিজের বুদ্ধিদীপ্ততা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন ।

মূল্যায়নঃ ইংরেজদের সঙ্গে রণজিৎ সিংহের সম্পর্ক কেমন ছিল তা বিশ্লেষণ করেত গিয়ে প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ডঃ নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ বলেছেন যে, ‘ইঙ্গ-শিখ মৈত্রীর ক্ষেত্রে রণজিৎ সিংহ ছিলেন ঘোড়া এবং ইংরেজরা ছিলেন সেই ঘোড়ার চালক’ । বস্তুত রণজিৎ সিংহ ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে শিখ রাজ্যের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা করে যেতে পারেননি ।

প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ (First Anglo-SIkh War)

মহারাজ রঞ্জিত সিংহের মৃত্যুর পর পাঞ্জাবে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে রণজিৎ সিংহের স্ত্রী রানী ঝিন্দন তাঁর নাবালক পুত্রকে সিংহাসনে বসিয়ে নিজে তার অভিভাবিকা রূপে রাজ্যশাসন করতে শুরু করেন । কিন্তু রাজ শক্তির দুর্বলতার সুযোগে খালসা সৈন্যদল বিদ্রোহী হয়ে উঠে ।  তখন রানী উপায়ন্তর না দেখে তাদের ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করেন । এই ব্যবস্থা অমৃতসর চুক্তির পরিপন্থী ছিল । ফলসরূপ প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ শুরু হয় । শিখরা পর পর কয়েকটি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের সঙ্গে লাহোরের সন্ধি করতে বাধ্য হন । সন্ধির শর্তানুসারে পাঞ্জাবের একাংশ এবং কাশ্মীর রাজ্যটি ইংরেজদের ছেড়ে দিতে হয় । দলীপ সিং -এর অভিভাবক হন লাল সিং আর ঝিন্দন চুনার দুর্গে বন্দি হন ।

দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ (Second Anglo-SIkh War)

শিখগণ লাহোর সন্ধির অপমানজনক শর্তের কথা ভুলতে না পেরে দ্বিতীয়বার বিদ্রোহী হয়ে ওঠলে দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ শুরু হয় । লর্ড ডালহৌসি কাল বিলম্ব না করে শিখদের বিরুদ্ধে ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে চিলিয়ানওয়ালা [Battle of Chilianwala] ও গুজরাটের যুদ্ধে লিপ্ত হন । এই যুদ্ধে তিনি শিখদের সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করে পাঞ্জাবের নাবালক রাজা দলীপ সিংহকে অপসারিত করে পাঞ্জাব অধিকার করে নেন । সেই সঙ্গে লাহোরে একজন ব্রিটিশ প্রতিনিধি নিযুক্ত হন । এর ফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সীমা উত্তর-পশ্চিমে আফগান সীমান্ত পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয় ।    

গুজরাটের যুদ্ধ ফল :-

(১) এই যুদ্ধে শিখরা চুড়ান্তভাবে পরাজিত হয়;

(২) শিখ খালসা বাহিনী ভেঙে দেওয়া হয়;

৩) শিখ মহারাজা দলীপ সিংহ সিংহাসনচ্যুত হয়ে লন্ডনে নির্বাসিত হন ।

৪) রণজিৎ সিংহের প্রতিষ্ঠিত শিখরাজ্যের পতন ঘটে;

৫) সমগ্র পাঞ্জাব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাম্রাজ্যভুক্ত হয় এবং ভারতীয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আফগানিস্থানের সীমান্ত পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়।

দ্বিতীয় ব্রহ্মযুদ্ধ: পূর্বদিকে ব্রহ্মরাজ থিবো ইয়ান্দাবুর সন্ধি অমান্য করে ব্রহ্মদেশে ইংরেজ বণিকদের ওপর উৎপীড়ন শুরু করলে লর্ড ডালহৌসি ক্ষতিগ্রস্থ ইংরেজ বণিকদের জন্য ক্ষতিপূরণ ও দক্ষিণ ব্রহ্মদেশ দাবি করলে ব্রহ্মরাজ সে দাবি প্রত্যাখ্যান করেন । ফলে ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ব্রহ্মযুদ্ধ শুরু হয় । এই যুদ্ধে ব্রহ্মরাজ পরাজিত হয়ে প্রোম ও পেগু ইংরেজদের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন । এভাবে পূর্বে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যসীমা সালাউইন নদী পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয় । লর্ড ডাফরিনের সময় ১৮৮৫-১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় ইঙ্গ-ব্রহ্ম যুদ্ধে ব্রহ্মরাজ মিন্ডনকে পরাস্ত করে সমগ্র ব্রহ্মদেশ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়  ।

*****

Related Items

ভারতের সংবিধানের চারটি মূল বৈশিষ্ট্য উল্লেখ কর ।

প্রশ্ন:-  ভারতের সংবিধানের চারটি মূল বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো ।

১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি ভারতের সংবিধান প্রকাশ করা হয় । ভারতীয় সংবিধানের চারটি উল্লেখযোগ্য প্রধান বৈশিষ্ট্য হল—

মুসলিম লিগ কবে প্রতিষ্ঠিত হয় ? স্যার সৈয়দ আহম্মদ খাঁ মুসলমানদের কংগ্রেসে যোগ না দিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন কেন ? মুসলিম লিগ কেন ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ পালন করে ?

প্রশ্ন:-  মুসলিম লিগ কবে প্রতিষ্ঠিত হয় ? স্যার সৈয়দ আহম্মদ খাঁ মুসলমানদের কংগ্রেসে যোগ না দিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন কেন ? মুসলিম লিগ কেন ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ পালন করে ?

‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ কী ? ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে এই তত্ত্বের প্রভাব উল্লেখ কর ।

প্রশ্ন:- ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ কী ? ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে এই তত্ত্বের প্রভাব উল্লেখ কর ।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নৌ-বিদ্রোহের গুরুত্ব কী ? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতে ছাত্র আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও ।

প্রশ্ন:-  ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নৌ-বিদ্রোহের গুরুত্ব কী ? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতে ছাত্র আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও ।

আজাদ হিন্দ ফৌজের লক্ষ্য কতদূর পরিপূর্ণ হয় ? আজদ হিন্দ ফৌজের বিচার ভারতীয় জনগণের ওপর কী প্রভাব বিস্তার করে ?

প্রশ্ন:- আজাদ হিন্দ ফৌজের লক্ষ্য কতদূর পরিপূর্ণ হয় ? আজদ হিন্দ ফৌজের বিচার ভারতীয় জনগণের ওপর কী প্রভাব বিস্তার করে ?