ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন ও আদিবাসী জনগণের প্রতিক্রিয়া

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 12/22/2020 - 11:01

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন ও আদিবাসী জনগণের প্রতিক্রিয়া (Colonial Forest Law and the reaction of tribal communities) : ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে আদিবাসী জনগোষ্ঠী অরণ্যের কাঠ, ফলমূল ও বনজ সম্পদ সংগ্রহ, পশুপাখি শিকার প্রভৃতির মাধ্যমে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করত । কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা বনভূমি পরিষ্কার করে অনুর্বর পতিত জমি উদ্ধার করে সেখানে চাষবাস শুরু করে । ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দের পর কোম্পানির নৌবাহিনীতে জাহাজ নির্মাণের জন্য ওক কাঠের প্রয়োজন দেখা দিলে অবিভক্ত ভারতের বিপুল পরিমাণ বনজ সম্পদের ওপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নজর পড়ে । তা ছাড়া উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়কাল থেকে ভারতে রেলপথ নির্মাণ ও তার বিস্তার শুরু হয় । রেললাইনের স্লিপারের জন্য প্রচুর পরিমাণে কাঠের তক্তার প্রয়োজন পড়ে । এই সমস্ত প্রয়োজনীয়তা বিচার করে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার বনজ সম্পদ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয় । ভারতের অরণ্যগুলিতে বসবাসকারী উপজাতিরা যাতে যথেচ্ছভাবে গাছ কাটতে না পারে সেদিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয় । ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ডালহৌসি ভারতে 'অরণ্য সনদ' (Charter of Indian Forest) পাস করে এবং এর দ্বারা অরণ্যের কাঠ সংগ্রহ ও কাঠের ব্যবসার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে বনজ সম্পদ সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের জীবন-জীবিকায় হস্তক্ষেপ করে । এই সমস্ত দেখভাল করার জন্য ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার একটি বনবিভাগ গঠন করে ।

১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয় অরণ্য আইন (ইন্ডিয়ান ফরেস্টস অ্যাক্ট) পাস করে এদেশের অরণ্য সম্পদের ওপর ভারতীয়দের অধিকার খর্ব করে এবং অরণ্যকে সংরক্ষণের আওতায় এনে সেখানে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করে । পরবর্তীকালে ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় 'অরণ্য আইন' পাস করে অরণ্যের ওপর নিজেদের অধিকার আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করে । ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের অরণ্য আইন অনুযায়ী অরণ্যকে দু-ভাগে ভাগ করা হয়— (i) 'সংরক্ষিত অরণ্য' (Reserved Forest), (ii) 'সুরক্ষিত অরণ্য' (Protected Forest) । ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতের প্রায় শতকরা ২০ ভাগ অরণ্যঅঞ্চল অরণ্য প্রশাসনের অধীনস্থ হয় । কোম্পানি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কাঠ উৎপাদনের লক্ষ্যে বন সংরক্ষণ করলে উপজাতীয় কৃষক শ্রেণি তাদের একচেটিয়া বনজ সম্পদ ব্যবহারের প্রথাগত অধিকার হারায় । ব্রিটিশ সরকার বেআইনিভাবে অরণ্যের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবিকার মূল উৎস বন্ধ করে দেয় ।

ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে অপর একটি 'অরণ্য আইন' পাস করে । এই আইন অনুযায়ী ভারতের বিপুল পরিমাণ বনভূমিকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়, যথা— (i) 'সংরক্ষিত অরণ্য' (Reserved Forest), (ii) 'সুরক্ষিত অরণ্য' (Protected Forest) এবং (iii) অ-শ্রেণিবিভক্ত অরণ্য' (Unclassified Forest) । সংরক্ষিত অরণ্যের ওপর পূর্ণ আধিপত্য কায়েম করে ব্রিটিশ সরকার এই ধরনের অরণ্যে গাছ কাটা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করে । সুরক্ষিত অরণ্য থেকে প্রথাগত অধিকার-বলে উপজাতি গোষ্ঠী নিজেদের ব্যক্তিগত দরকারে কাঠ জোগাড় করতে পারত, কিন্তু সেই সমস্ত কাঠ তাদের বিক্রি করার অধিকার ছিল না ।

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন চালু হওয়ার পর প্রথমদিকে অরণ্যবাসী উপজাতি গোষ্ঠী বিনা পয়সায় কাঠ সংগ্রহ করতে পারত । পরবর্তীকালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকার বনজ সম্পদ ব্যবহারের ওপর কর আরোপ করে । পরবর্তীকালে করের হার আরও অনেকগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয় । অরণ্যবাসীদের মধ্যে শিকারীরা এবং উপজাতী কৃষকদের মধ্যে ঝুম চাষিরা সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় । বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বন সংরক্ষণ এবং সেই বন সংরক্ষণের লক্ষ্যে যে সমস্ত আইনকনুন প্রয়োগ করা হয় তার ফলে অরণ্য সম্পদের ওপর নির্ভরশীল আদিবাসী গোষ্ঠীর জীবিকা অর্জনের পথ বন্ধ হয়ে যায় । ফলে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে এই অরণ্য আইনের বিরুদ্ধে আদিবাসী উপজাতি গোষ্ঠী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শুরু করে ।

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনের বিরুদ্ধে আদিবাসী জনগণ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় । মধ্য ভারতের বৈগা, হায়দরাবাদের পাহাড়ি রেড্ডি এবং বাস্তার অঞ্চলের বিসন মারিয়া উপজাতি গোষ্ঠীর জনগণ অরণ্য আইনকে অমান্য করে । কোম্পানির সরকার ঝুম চাষ বন্ধের চেষ্টা করলে বৈগা উপজাতি গোষ্ঠী ঝুমচাষ বন্ধের সরাসরি বিরোধিতা না করলেও তারা কর দিতে অস্বীকার করেন । গঞ্জাম এলাকার সাওড়া উপজাতি গোষ্ঠী সরকারি বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে কারাবরণ করে । অন্ধ্রপ্রদেশের গুডেম ও রম্পা পাহাড়ি অঞ্চলে কোয়া এবং কোণ্ডা ডোরা উপজাতি গোষ্ঠী কোম্পানির অরণ্য আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় । প্রথমে এরা খামার মালিকদের নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করে । কোম্পানির পুলিশি আস্তানা এবং বহিরাগত ব্যবসায়ী ঠিকাদাররা বিদ্রোহীদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে । বিদ্রোহীরা পাহাড়ি এলাকাকে বহিরাগতদের হাত থেকে মুক্ত করতে সচেষ্ট হয় ।

ঔপনিবেশিক আমলে দেশীয় রাজ্যের স্থানীয় শাসকরাও ঝুমচাষ বন্ধের জন্য বিধিনিষেধ আরোপ করতে থাকে । হায়দ্রাবাদের বাস্তার অঞ্চলে মারিয়া ও মুরিয়া উপজাতি গোষ্ঠী কোম্পানির পুলিশি আস্তানাগুলিতে আক্রমণ চালায় । ত্রিবাঙ্কুরের উপজাতীয় কৃষকরা বনদফতরের কর্মীদের সঙ্গে অসহযোগিতা শুরু করে । মহারাষ্ট্র উপকূলীয় এলাকার থানে জেলার উপজাতীয় কৃষকরা হিংসার আশ্রয় গ্রহণ করে । অবিভক্ত বাংলার জঙ্গলমহলে সাঁওতাল কৃষক শ্রেণি গ্রাম্য এলাকার বাজারে ও মাছের ভেড়িগুলিতে লুটপাট শুরু করে । বর্তমান উত্তরাখণ্ডের তেহরি গাড়োয়ালের কৃষকরা এবং ব্রিটিশ শাসিত কুমায়ুন অঞ্চলের স্থানীয় কৃষকরা কাঠ চুরি, সম্পত্তি নষ্ট, এমনকি সংরক্ষিত বনজ সম্পদে আগুন লাগিয়ে দিয়ে তারা অরণ্য আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ব্রিটিশ অরণ্য আইনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে । পাঞ্জাবের অরণ্য অঞ্চলের উপজাতি গোষ্ঠীও একইভাবে সহকারি বনবিভাগ কর্তৃপক্ষের অগোচরে গাছ কেটে নিত এবং বনে আগুন লাগিয়ে দিত । আদিবাসী জনগণ এইভাবে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রবর্তিত অরণ্য আইনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে তাদের প্রতিক্রিয়া জানায় ।

****

Comments

Related Items

নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের উদ্দেশ্য কী ছিল ? এই সময়ের দুটি ব্যঙ্গাত্মক বাংলা নাটকের নাম কর । নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া কী ছিল ?

প্রশ্ন:- নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের উদ্দেশ্য কী ছিল ? এই সময়ের দুটি ব্যঙ্গাত্মক বাংলা নাটকের নাম কর । নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া কী ছিল ?

বাংলায় সমাজ সংস্কার ও শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কার্যাবলি উল্লেখ কর ।

প্রশ্ন:-  বাংলায় সমাজ সংস্কার ও শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কার্যাবলি উল্লেখ কর ।

প্রার্থনা সমাজের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন ? জ্যোতিবা ফুলে কেন স্মরণীয় ? উনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলনগুলি সমাজে কী প্রভাব বিস্তার করে ?

প্রশ্ন:- প্রার্থনা সমাজের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন ? জ্যোতিবা ফুলে কেন স্মরণীয় ? উনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলনগুলি সমাজে কী প্রভাব বিস্তার করে ?

প্রার্থনা সমাজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ডঃ আত্মারাম পান্ডুরঙ্গ ।

উনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য কী ছিল ? ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা কে ? ব্রাহ্মসমাজের সমাজ সংস্কারের লক্ষ্য কী ছিল ?

প্রশ্ন:- উনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য কী ছিল ? ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা কে ? ব্রাহ্মসমাজের সমাজ সংস্কারের লক্ষ্য কী ছিল ?

উনিশ শতকের সমাজ-সংস্কার আন্দোলনগুলির প্রধান লক্ষ্য ছিল—

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে চার্লস উডের প্রতিবেদনে কী কী সুপারিশ করা হয়েছিল ?

প্রশ্ন:- ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে চার্লস উডের প্রতিবেদনে কী কী সুপারিশ করা হয়েছিল ?

শিক্ষা সংক্রান্ত নানা সমস্যার সমাধান করার জন্য ১৮৫৪ সালে চার্লস উডের নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয় । এই কমিশনের সুপারিশগুলি ছিল—