উনিশ শতকে দেশীয় শিল্পের অবক্ষয়ের কারণগুলি ব্যাখ্যা কর এবং এই অবক্ষয়ের অর্থনৈতিক ফলাফল কী হয় ?

Submitted by avimanyu pramanik on Thu, 01/06/2022 - 22:23

প্রশ্ন:- উনিশ শতকে দেশীয় শিল্পের অবক্ষয়ের কারণগুলি ব্যাখ্যা কর এবং এই অবক্ষয়ের অর্থনৈতিক ফলাফল কী হয় ?

উনিশ শতকে ভারতীয় শিল্পসমূহের অবক্ষয়ের কারণ হিসাবে রমেশচন্দ্র দত্ত, রজনীপাম দত্ত, নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ, বিপিন চন্দ্র, অমিয় বাগচী প্রমুখ ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন যেমন—

(১) দেশীয় শিল্পী ও কারিগরদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রাজন্য শ্রেণির অবক্ষয় : পলাশির যুদ্ধের পর ভারতের রাজা, জমিদারসহ অভিজাত শ্রেণির অবক্ষয় ও ক্রম-অবলুপ্তি ভারতীয় কুটিরশিল্পের ওপর চরম আঘাত হানে । কারণ এতদিন পর্যন্ত তারাই ছিলেন ভারতীয় কুটির শিল্পের প্রধান পৃষ্ঠ পোষক । যেমন দেশীয় রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতের কারখানাতেই সামরিক অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করা হত । কিন্তু ইংরেজ সরকার ভারতে তৈরি অস্ত্রশস্ত্র কেনার বদলে তা ব্রিটেন থেকে আমদানি করার পক্ষপাতি ছিলেন । যার ফলশ্রুতি এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত কারিগরদের রুজিরোজগার প্রায় বন্ধ হয়ে গেলে তারা কর্মহীন হয়ে পড়ে ।

(২) সরকারের বৈষম্যমূলক শুল্ক নীতি : ইংল্যান্ডের জিনিসপত্র যাতে ভারতে অবাধে আসতে পারে তার জন্য কোম্পানি আমদানি শুল্ক কমিয়ে দেয় । অন্যদিকে অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকে ব্রিটেনে ভারত থেকে রপ্তানি করা পণ্যের ওপর উঁচু হারে শুল্ক ধার্য করা হয় । যেমন ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেনে ভারতীয় ছাপা সুতিবস্ত্র ও মসলিনের ওপর শুল্কের হার ছিল যথাক্রমে ৬৭.৫% এবং ৩৭.৫% । ভারত থেকে আমদানি করা চিনির ওপর শুল্ক ধার্য করা হত উৎপাদান মূল্যের তিন গুণ বেশি ।

(৩) কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য : ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকেই কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা 'দত্তক' -এর অপব্যবহার করে বাংলায় বিনাশুল্কে অবাধ বাণিজ্য শুরু করে । এই অসাধু ব্যবসার ফলে দেশীয় বণিকদের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ে । ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানি লাভের পর থাকে অন্যান্য ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের হটিয়ে দিয়ে বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোম্পানি একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করে । বস্ত্র শিল্পের ক্ষেত্রে কোম্পানির মূল নীতি ছিল 'যথাসম্ভব কম দামে মাল কিনে তা ইউরোপীয় বাজারে চড়া দামে বিক্রয় করা' । কোম্পানির এই নীতির ফলে ভারতীয় তাঁতিদের লোকসানের সীমা ছিল না ।

(৪) অবাধ বাণিজ্য নীতি : ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে সনদ আইনের এর মাধ্যমে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার লোপ পায় এবং অবাধ বাণিজ্যনীতি চালু হয় । আমদানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় ইংল্যান্ডের বড় বড় কারখানায় তৈরি সস্তা দামের শিল্পসামগ্রীতে ভারতের বাজার ছেয়ে যায়, ফলে দেশীয় শিল্প ক্রমশ পিছু হটতে থাকে । ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের পর কিছু সময়ের জন্য ইউরোপের বাজারে ভারতের রপ্তানি বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে যায় ।

(৫) শিল্পবিপ্লব — কোম্পানির ভারসাম্যহীন শিল্পনীতি — ভারতীয় শিল্পের আদিম কৃতকৌশল ও কারিগরি শিক্ষার অভাব  : ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব ঘটার ফলে যন্ত্রের সাহায্যে অতিঅল্প সময়ের মধ্যে উন্নত মানের নানান দ্রব্য সামগ্রী বিপুল পরিমাণে উৎপাদন এবং ভারতে তাদের অব্যাহত যোগান ছিল দেশীয় শিল্পের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ । ইংল্যান্ডের কলকারখানায় উৎপন্ন মানে উন্নত কিন্তু দামে সস্তা পণ্যের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় ভারতীয় শিল্প হেরে যায় । অন্যদিকে ভারতীয় শিল্পের আদিম কৃতকৌশল ও দেশীয় শিল্পীদের কারিগরি শিক্ষার অভাব উনিশ শতকে ভারতীয় হস্তশিল্পের ধ্বংসের জন্য দায়ী ছিল । এই কারনেই রাসব্রুক উইলিয়াম, হ্যামিলটন প্রমুখ ইতিহাসিকরা বলেছে যে, ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবই ছিল ভারতীয় শিল্প-বাণিজ্যের ধ্বংসের মূল কারণ —এর জন্য ব্রিটিশ সরকার বিশেষ দায়ী ছিল না ।

অন্যান্য কারণ :-

(৬) সস্তা দামে বিদেশী পণ্যের আমদানি এবং ভারতীয় নাগরিকদের বিদেশী পণ্যের প্রতি ঝোঁক ।

(৭) দাদন প্রথার কুফল ।

(৮) কাঁচা মালের দাম বৃদ্ধি

(৯) তাঁতিদের ওপর অত্যাচার

(১০) ব্রিটিশ সরকারের পক্ষপাত মূলক শিল্পসংরক্ষণ নীতি, প্রভৃতি ।

উনিশ শতকে দেশীয় শিল্পের অবক্ষয়ের অর্থনৈতিক ফলাফল :  উনিশ শতকে দেশীয় শিল্পের অবক্ষয়ের ফলে—

(১) ভারতের হস্তশিল্প এবং বিখ্যাত তাঁতশিল্প ধ্বংশ হয়ে যায় ।

(২) উনিশ শতকের ভারত শিল্পজাত পণ্যের রপ্তানিকারক দেশ থেকে ওই সমস্ত পণ্যের আমদানিকারক দেশে পরিণত হয় ।

(৩) একসময়ের শিল্পপ্রধান ভারতবর্ষ উনিশ শতকে ইংল্যান্ডের কাঁচামাল সরবরাহকারী একটি দেশে পরিণত হয় ।

*****

Comments

Related Items

বর্তমান ভারত (Bartaman Bharat)

বর্তমান ভারত (Bartaman Bharat) :-

'বর্ত্তমান ভারত' স্বামী বিবেকানন্দের লেখা একটি প্রবন্ধ । ১৮৯৭ সালে বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর স্বামী বিবেকানন্দ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ভ্রমণ করেন । তারপর ১৮৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের বাংলা মু

আনন্দমঠ (Anandamath)

আনন্দমঠ (Anandamath):-

ঊনিশ শতকে ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশে যেসমস্ত ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম । তিনি তাঁর 'আনন্দমঠ' উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে ভারতবাসীর মধ্যে জাতী

লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবোধের বিকাশ : বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ

লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবোধের বিকাশ : বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ (Expression of Nationalism in Literary Works and Paintings):-

ভারতীয়দের জাতীয়তাবোধের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতা শুরু হয় ও ক্রমে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে । স

হিন্দু মেলা (Hindu Mela)

হিন্দু মেলা (Hindu Mela) :-

ঊনিশ শতকে বাংলায় যেসমস্ত রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল 'হিন্দুমেলা' । পণ্ডিত রাজনারায়ণ বসুর অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় নবগোপাল মিত্র ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে চৈত্রসংক্রান্তির

ভারতসভা (Indian Association)

ভারতসভা (Indian Association) :-

ঊনিশ শতকে ভারতে যেসব রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে সেগুলির মধ্যে 'ভারতসভা' বা 'Indian Association' বিশেষ উল্লেখযোগ্য । ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জুলাই কলকাতার অ্যালবার্ট হলে (বর্তমানে কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে) সুরেন্দ্রন