উত্তর ঔপনিবেশিক ভারত : বিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব (১৯৪৭ - ১৯৬৪)

Submitted by avimanyu pramanik on Fri, 02/26/2021 - 10:29

উত্তর ঔপনিবেশিক ভারত : বিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব (১৯৪৭ - ১৯৬৪) [Post-Colonial India : Second Half od the 20th Century (1947-1964)]:-

দীর্ঘদিনের ত্যাগ, তিতিক্ষা ও আত্মবলিদানের পর ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হওয়া ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের 'ভারতের স্বাধীনতা আইন' অনুসারে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট অবিভক্ত ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে এবং ভারত ও পাকিস্তান নাম দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় । সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পশ্চিম পাঞ্জাব, পূর্ব বাংলা ও আসামের শ্রীহট্ট জেলার কিছু অংশ নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র ও অবশিষ্ট ভূখণ্ড নিয়ে ভারত রাষ্ট্র গঠিত হয় । নবগঠিত স্বাধীন ভারতরাষ্ট্রকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় । এই সমস্যাগুলির মধ্যে অন্যতম তিনটি সমস্যা ছিল— (i)  দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিকরণ সমস্যা, (ii) উদ্বাস্তু সমস্যা এবং (iii) ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন সমস্যা ।

স্বাধীনতা লাভের আগে ভারতীয় ভুখন্ডে ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ শাসনাঞ্চল ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোটোবড়ো মিলিয়ে ছয় শতাধিক দেশীয় রাজ্য অবস্থিত ছিল । স্বাধীনতা লাভের পর এই সমস্ত দেশীয় রাজ্য গুলির ভবষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয় । ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের 'ভারতীয় স্বাধীনতা আইন' -এ দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিজেদের স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখার অথবা ভারত বা পাকিস্তানের যে-কোনো একটি রাষ্ট্রে যোগদানের অধিকার দেওয়া হয় । ভারতীয় নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতা লাভের পূর্বেই উপলিবধি করেছিলেন যে, ভারতের অভ্যন্তরভাগে অবস্থিত কোনো দেশীয় রাজ্য পাকিস্তানে যোগ দিলে বা স্বাধীন থাকলে তা স্বাধীন ভারতের সার্বভৌমত্বের পক্ষে বিপজ্জনক হবে । ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুন ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ঘোষণা করে যে, ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার পর দেশীয় রাজ্যগুলির স্বাধীন অস্তিত্ব ভারত স্বীকার করবে না । সেই অনুসারে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর উদ্যোগ ও প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেশীয় রাজ্যগুলির অধিকাংশই 'ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাক্সেসান (Instrument of Accession)' -নামে ভারতভুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করে ।

দেশভাগের পর মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে পৃথক পাকিস্তানের সৃষ্টি হলে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত পশ্চিম পাঞ্জাবের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের অত্যাচারে সেখানকার হিন্দু, শিখ প্রভৃতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হয় ও সর্বহারা হয়ে দলে দলে ভারতের অন্তগত পূর্ব পাঞ্জাবে উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নেয় । অপরদিকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত পূর্ব পাঞ্জাবের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ও শিখদের অত্যাচারে দলে দলে মুসলমানরা পশ্চিম পাঞ্জাবে চলে যায় । পাকিস্তান থেকে বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তু পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, পাঞ্জাব -সহ বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে । পাকিস্তান ও ভারতে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে । পাকিস্তানে এবং পাকিস্তান ত্যাগের সময় প্রচুর হিন্দু, শিখ ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ দাঙ্গায় নিহত হন । একই ভাবে ভারতে এবং ভারত ত্যাগের সময় বহু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ দাঙ্গায় নিহত হন । এছাড়া লুন্ঠন, বাড়িতে আগুন লাগানো, মাঠের ফসল নষ্ট প্রভৃতি অবাধে চলে । উভয় দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বহু নারী নির্যাতনের শিকার হয় । ধর্ষণ, অপহরণ প্রভৃতি ঘটনা অবাধে চলে । পাকিস্তান অপেক্ষা ভারতকে অনেক বেশি উদ্বাস্তুর দায়িত্ব নিতে হয় এবং তাদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হয় ।

বহু ভাষাভিত্তিক স্বাধীন ভারতের বিভিন্ন প্রদেশগুলি ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের জন্য আন্দোলন শুরু করে । ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের দাবিতে ভারতে আন্দোলন শুরু হলে আন্দোলন প্রশমনের উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল ও পট্টভি সিতারামাইয়া -কে নিয়ে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে । এটি 'জে ভি পি' কমিটি নামে পরিচিত । আন্দোলনের জেরে ভাষার ভিত্তিতে বিভিন্ন রাজ্যগুলির সীমান্ত সংশোধিত হয় । স্বাধীন ভারতের রাজ্য পুনর্গঠন নিয়ে দীর্ঘ সমস্যা ও বিতর্ক চলার পর শেষপর্যন্ত ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয় । ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে 'রাজ্য পুনর্গঠন আইন' পাস হলে ওই বছর ভাষাভিত্তিক ১৪টি রাজ্য এবং ৬টি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল গঠিত হয় ।

*****

Comments

Related Items

বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন (Indian universities Act, 1904)

লর্ড কার্জন প্রতিক্রিয়াশীল শাসক হলেও শিক্ষার ব্যাপারে তিনি খুবই উৎসাহী ছিলেন । লর্ড কার্জন স্যার টমাস র‍্যালের সভাপতিত্বে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে 'র‍্যালে কমিশন' গঠন করেছিলেন । এটি 'ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন' নামেও পরিচিত । স্যার টমাস র‍্যালে ছিলেন বড়লাটের কার্যনির্বাহক সমিতির আইন সদস্য । এই কমিশন ...

হান্টার কমিশন (Hunter Education Commission)

১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে লর্ড রিপণের সময় উইলিয়াম হান্টারের নেতৃত্বে হান্টার কমিশন গঠিত হয় । এই কমিশনের কাজ ছিল দেশে ইংরেজি শিক্ষার অগ্রগতি পর্যালোচনা করা । শিক্ষার প্রসারে হান্টার কমিশনের ভূমিকা এক অভিনব অধ্যায়ের সূচনা করেছিল । হান্টার কমিশনের সুপারিশগুলি ছিল ....

উডের ডেসপ্যাচ (Wood's Despatch of 1854)

শিক্ষা সংক্রান্ত নানা সমস্যার সমাধান করার জন্য ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির পরিচালক সমিতির সভাপতি স্যার চার্লস উড 'শিক্ষা বিষয়ক প্রস্তাব' (Wood's Education Despatch) নামে একটি শিক্ষা নীতি রচনা করে ভারতে পাঠান । ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে চার্লস উডের সুপারিশ ...

বহু বিকল্পীয় প্রশ্নোত্তর (M.C.Q) - বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ

বহু বিকল্পীয় প্রশ্নোত্তর (M.C.Q) - বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ:-

মাধ্যমিকের নমুনা প্রশ্ন:-

১. ভারতে 'হাফটোন' প্রিন্টিং পদ্ধতি প্রবর্তন করেন—     [মাধ্যমিক-২০১৭]

বহু বিকল্পীয় প্রশ্নোত্তর (M.C.Q) - সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা

বহু বিকল্পীয় প্রশ্নোত্তর (M.C.Q) - সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা:-

মাধ্যমিকের নমুনা প্রশ্ন:-

১. ভারতের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হল—       [মাধ্যমিক -২০১৭]