আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথায় দেশভাগ

Submitted by avimanyu pramanik on Sat, 02/27/2021 - 19:30

আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথায় দেশভাগ :-

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের 'ভারতের স্বাধীনতা আইন' অনুযায়ী ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট অবিভক্ত ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে এবং ভারত ও পাকিস্তান নাম দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় । মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে পৃথক পাকিস্তানের সৃষ্টি হলে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত পশ্চিম পাঞ্জাবের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের অত্যাচারে সেখানকার হিন্দু, শিখ প্রভৃতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হয় ও সর্বহারা হয়ে দলে দলে ভারতের অন্তগত পূর্ব পাঞ্জাবে উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নেয় । অপরদিকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত পূর্ব পাঞ্জাবের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ও শিখদের অত্যাচারে দলে দলে মুসলমানরা পশ্চিম পাঞ্জাবে চলে যায় । পাকিস্তান থেকে বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তু পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, পাঞ্জাব -সহ বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে । পাকিস্তান ও ভারতে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে । পাকিস্তানে এবং পাকিস্তান ত্যাগের সময় প্রচুর হিন্দু, শিখ ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ দাঙ্গায় নিহত হন । একই ভাবে ভারতে এবং ভারত ত্যাগের সময় বহু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ দাঙ্গায় নিহত হন । এছাড়া লুন্ঠন, বাড়িতে আগুন লাগানো, মাঠের ফসল নষ্ট প্রভৃতি অবাধে চলে । উভয় দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বহু নারী নির্যাতনের শিকার হয় । ধর্ষণ, অপহরণ প্রভৃতি ঘটনা অবাধে চলে ।

দেশভাগের ফলে উদ্ভুত ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বেদনাদায়ক বিভিন্ন বিষয় স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা ও সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়েছে । দেশ ভাগের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কীভাবে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হত্যা, ধর্ষণ, লুন্ঠন প্রভৃতির শিকার হয়েছে এবং দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে তা বিভিন্ন লেখকের লেখায় উঠে এসেছে । দেশত্যাগের সময় অতীতের বিভিন্ন ঘটনার স্মৃতিচারণ, অনেক বেদনা নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু প্রভৃতি বিষয়গুলি বিভিন্ন লেখক তাদের লেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন । দেশভাগ কীভাবে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও পরিবার পরিজনর বিভিন্ন সদস্যের সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে, কীভাবে বহু প্রিয়জন একে অপরের থেকে চিরদিনের মতো হারিয়ে গেছে তা বিভিন্ন আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথায় ফুটে উঠেছে । নিজের মাতৃভূমির ভিটেমাটি ছেড়ে উদ্বাস্তু হলেও সেই ভিটেমাটি, পরিবেশ পরিজনের প্রতি গভীর মমত্ববোধ এবং আকুল মনের টান বিভিন্ন লেখায় বার বার ফুটে উঠেছে । 

দক্ষিণারঞ্জন বসু সম্পাদিত 'ছেড়ে আসা গ্রাম' উপন্যাসে দেশভাগের পরিণতিতে উদবাস্তু শরণার্থীদের মানসিক যন্ত্রণা ও বেদনা ধরা পড়েছে । দেশভাগের পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু কমিশনার শ্রী হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা 'উদবাস্তু' নামক স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থে পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুর জীবন সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা স্থান পেয়েছে । দেশভাগের ওপর লেখা এই ধরনের কিছু গ্রন্থ হল— নীরদচন্দ্র চৌধুরীর 'অটোবায়োগ্রাফি অব অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান', এন কে বোসের 'মাই ডেজ উইথ গান্ধি', সুধীর ঘোষের 'গান্ধি'স এমিসারী', জি ডি খোসলার 'মেমোরিস গে চ্যারিয়ট', চৌধুরী খালিজুজামানের 'পাথওয়ে টু পাকিস্তান', ফিরোজ খান নুনের 'ফ্রম মেমোরি', চৌধুরী মহম্মদ আলির 'দ্য ইমারজেন্সি অব পাকিস্তান', ওয়ালি খানের 'ফ্যাক্টস আর ফ্যাক্টস : দ্য আনটোল্ড স্টোরি অব ইন্ডিয়ান'স পার্টিশান', ফ্রান্সিস  টাকারের 'হোয়াইল মেমোরি সামস', কনরাড কনফিল্ডের 'দ্য প্রিন্সলি ইণ্ডিয়া আই নিউ', পেণ্ডেরেল মুনের 'ওয়াভেল : দ্য ভাইসরয়'স জার্নাল', খুশবন্ত সিং -এর 'এ ট্রেন টু পাকিস্তান' প্রভৃতি । দেশভাগের ওপর লেখা উল্লেখযোগ্য সাহিত্য হল— প্রফুল্ল চক্রবর্তীর 'মার্জিনাল ম্যান', বুদ্ধদেব বসুর 'একটি জীবন', জ্যোতির্ময়ী দেবীর 'এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা', বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের 'কোলকাতা-নোয়াখালি-বিহার', অমিয়ভূষণ মজুমদারের 'গড় শ্রীখণ্ড', সতীনাথ ভাদুড়ীর 'গণনায়ক', অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে', তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বিপাশা', আখতারুজ্জমান ইলিয়াসের 'খোয়াবনামা', প্রফুল্ল রায়ের 'কেয়াপাতার নৌকো', শঙ্খ ঘোষের 'সুপুরিবনের সারি' প্রভৃতি । এই সমস্ত গ্রন্থগুলিতে দেশ ভাগের প্রেক্ষাপটে উদ্বাস্তু শরণার্থীদের মানসিক যন্ত্রণা ও বেদনার যে মর্মন্তুদ কাহিনী ফুটে উঠেছে তা সমকালীন ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে অমূল্য সম্পদ । 

উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকৎ আলি খাঁ -র মধ্যে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই এপ্রিল 'দিল্লি চুক্তি' বা 'নেহরু-লিয়াকৎ চুক্তি' স্বাক্ষরিত হয় । চুক্তি অনুযায়ী ঠিক হয়— সংখ্যালঘু শ্রেণি নিজ রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকবে এবং নিজের রাষ্ট্রের কাছে যে-কোনো সমস্যার প্রতিকার চাইবে । পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম থেকে কেউ অন্য দেশে শরণার্থী হতে চাইলে সে সাহায্য পাবে । ভারত ও পাকিস্তান উদ্বাস্তু সমস্যার কারণ ও সংখ্যা নির্ধারণের জন্য অনুসন্ধান কমিটি ও সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করবে । পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রিসভায় সংখ্যালঘু প্রতিনিধি থাকবে । এই চুক্তিতে ভারতীয় মন্ত্রিসভার অনেকেই সন্তুষ্ট হতে পারেন নি । হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা এই চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করে । উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে এই চুক্তি যথেষ্ট নয় মনে করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্য ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও ডঃ ক্ষিতিশ চন্দ্র নিয়োগী এই চুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন । চুক্তির পরেও উদ্বাস্তুদের আসা বন্ধ হয়নি । বেশকিছু মুসলমান ভারতে চলে আসে । তারা যাতে তাদের ফেলে যাওয়া স্থাবর সম্পত্তি ফিরে পায় সে ব্যাপারে নেহরুর সরকার উদ্যোগী হয় । কিন্তু এদেশে থেকে যাওয়া হিন্দুরা যাতে পূর্ব পাকিস্তানে তাদের সম্পত্তি ফিরে পায় সে ব্যাপারে নেহরুর সরকার উদ্যোগী হয়নি ।

*****

Comments

Related Items

রশিদ আলি দিবস (Rasid Ali Day)

রশিদ আলি দিবস (Rasid Ali Day) :-

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি লালকেল্লার সামরিক আদালতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন রশিদ আলিকে কোর্ট মার্শাল করে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলে এই অবিচারের প্রতিবাদে ও তাঁর মুক্তির দাবিতে

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Quit India Movement) :-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই আগস্ট মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ড

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Civil Disobedience Movement):-

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দিলে সেই আন্দোলনে ভারতের ছাত্রসম

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Non Co-operation Movement):-

মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, দমনমূলক রাওলাট আইন, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অপশাসন প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে গান্ধিজির নেতৃত্বে জা

অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি (Anti-Circular Society)

অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি (Anti-Circular Society):-

বাঙালিদের ব্রিটিশ বিরোধিতাকে দুর্বল করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসক লর্ড কার্জন প্রশাসনিক অজুহাত দেখিয়ে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ২০শে জুলাই সরকারিভাবে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা ঘোষণা কর