আইন অমান্য আন্দোলন : দ্বিতীয় পর্যায় (The Second Phase of the Civil Disobedience Movement)

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 04/23/2012 - 19:46

আইন অমান্য আন্দোলন : দ্বিতীয় পর্যায় (১৯৩২ - ৩৪ খ্রিঃ) :

The Second Phase of the Civil Disobedience Movement :

গান্ধি-আরউইন চুক্তির শর্তকে কেন্দ্র করে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনা ব্যর্থ হলে গান্ধিজি ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে ডিসেম্বর ভারতে ফিরে এসে দেখলেন যে গান্ধি-আরউইন চুক্তি লঙ্ঘন করে ব্রিটিশ সরকার দেশজুড়ে দমন মূলক নীতি অনুসরণ করে স্বৈরাচারী শাসন চালাচ্ছেন । উত্তরপ্রদেশে খাজনা বন্ধ আন্দোলন করার সময় পুরুষোত্তমদাস ট্যান্ডন, জওহরলাল নেহরু, আবদুল গফফর খান ও তাঁর বড়ভাই সহ লালকোর্তা বাহিনীর বহু কর্মী এবং আরও অনেকে গ্রেফতার হন । এই পরিস্থিতিতে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ৩ জানুয়ারি গান্ধিজি সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ডাক দেন । ৪ঠা জানুয়ারি গান্ধিজিকে গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করা হয় । কংগ্রেসকে বেআইনি সংগঠন রূপে নিষিদ্ধ করা হয় এবং কংগ্রেসের যাবতীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় । জনসাধারণের ওপর সরকারি নির্যাতন ও দমনমূলক আইন যথেচ্ছভাবে প্রযুক্ত হতে থাকে । সংবাদপত্র সমূহের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণাদেশ বলবৎ হয় । গান্ধি-আরউইন চুক্তি আশা-আকাঙ্খা পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে এই চুক্তি ভেঙ্গে দিয়ে আবার আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয় । এবার বাংলা, উত্তরপ্রদেশ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে । এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ভারতের শাসনতান্ত্রিক আলাপ আলোচনার স্বার্থে বিভিন্ন বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য তিনটি কমিটি গঠন করেন—

(ক) ভোটাধিকার কমিটি (Franchise Committee),

(খ) দেশীয় রাজ্য অনুসন্ধান কমিটি (State Inquiry Committee), 

(গ) যুক্তরাষ্ট্রীয় অর্থব্যবস্থা কমিটি (Federal Finance Committee) ।

দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক চলাকালে ভারতের সাম্প্রদায়িক দলগুলির সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক স্বার্থ নিয়ে টানাটানি ব্রিটিশ সরকারের নজর এড়ায় নি । সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিকে মদত দিয়ে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ চরিতার্থ করতে ও ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলন ব্যর্থ করে দিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র‍্যামসে ম্যাকডোনাল্ড ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই আগস্ট তাঁর 'সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি' (Communal Award) ঘোষণা করেন । এই নীতি অনুসারে মুসলমান, শিখ, ভারতীয় খ্রিস্টান এবং অনুন্নত সম্প্রদায় সমূহকে পৃথক নির্বাচনের অধিকার প্রদান করা হয়েছিল । এই ঘোষণায় তপশিলি জাতি এবং অন্যান্য অনুন্নত হিন্দুদের বর্ণহিন্দুদের থেকে পৃথক সম্প্রদায় রূপে গণ্য করার কথা বলা হয়েছিল । সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারায় হিন্দুজাতির অনুন্নত সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা হওয়ায় মহাত্মা গান্ধি ভীষণ ভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন । তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, এই ব্যবস্থা হিন্দুদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে অস্পৃশ্যতাকে উৎসাহিত করবে । প্রতিবাদে গান্ধিজি পুনার যারবেদা জেলে বন্দি অবস্থায় ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ২০শে সেপ্টেম্বর থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন । আমরণ অনশনে গান্ধিজির অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে উঠলে শেষ পর্যন্ত ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৫ শে সেপ্টেম্বর ডঃ ভীমজি রামরাও আম্বেদকর তাঁর সঙ্গে পুনা চুক্তি স্বাক্ষর করলে গান্ধিজি অনশন ভঙ্গ করেন । এই চুক্তি অনুসারে অনুন্নত এবং তপশিলি হিন্দুদের সঙ্গে বর্ণহিন্দু সম্প্রদায়ের যৌথ নির্বাচনের ব্যবস্থা হয় ।

অতঃপর গান্ধিজি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে অস্পৃশ্য ও নিপীড়িত মানুষের স্বার্থে হরিজন আন্দোলনের প্রতি মনোনিবেশ করেন । তিনি ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে 'নিখিল ভারত অস্পৃশ্যতা বিরোধী লিগ' গঠন করেন । ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে 'হরিজন পত্রিকা' প্রকাশিত হয় । গান্ধিজি বললেন, ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে বিহারের ভুমিকম্পে বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ হল বর্ণহিন্দুদের পাপের শাস্তি । গান্ধিজি অস্পৃশ্যতা বিরোধী হলেও জাতিভেদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেননি । তাই ক্ষুব্ধ বর্ণহিন্দুরা পুনায় গান্ধিজির বাড়ি লক্ষ করে বোমা নিক্ষেপ করে । ভেস্তে যায় ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের আইনসভার মন্দিরে প্রবেশ সংক্রান্ত বিল । অনেকে গান্ধিজির আইন অমান্য আন্দোলন ছেড়ে সরকার পক্ষে যোগ দেয় । তাঁদের যুক্তি হল— (১) গান্ধিজির অনশনের কোনো প্রভাব পড়ে নি,  (২) হরিজন সমস্যা তুলে ধরে গান্ধিজি অনেক মুখ্য বিষয় উপেক্ষা করেন,  (৩) পুনা চুক্তির থেকে কোনো ফায়দা তোলা যায় নি ।

আইন অমান্য আন্দোলনের গুরুত্ব (Impact of the Civil Disobedience Movement):

আইন অমান্য আন্দোলন লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হলেও এর গুরুত্ব অপরিসীম । এই আন্দোলন জাতিকে সর্বপ্রকার ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত করে তোলে । কংগ্রেস যে ভারতের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে— এই সত্যটিও প্রতিষ্ঠিত হয় । পরন্তু এই আন্দোলন বিশ্ববাসীর সমক্ষে ভারতে ব্রিটিশ রাজের অত্যাচারী রূপটি প্রকট করে দেয় । প্রমাণ করে যে, ভারতের স্বাধীনতার সমস্যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঘরোয়া সমস্যা নয়, এটি একটি আন্তর্জাতিক বিষয় । মার্কসবাদী পণ্ডিত রজনী পাম দত্তের ভাষায়— "এই সংগ্রাম ব্যর্থ হয় নি । কয়েক বছরের অগ্নিসংস্কারের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে এক নতুন ও বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য, আত্মবিশ্বাস, গর্ব ও দৃঢ় সংকল্প ।" 

তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠক (The Third Round Table Conference):

১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে লন্ডনে তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় । কংগ্রেস যথারীতি ওই বৈঠকে যোগদান করেনি । অন্যান্য দল ও সম্প্রদায়ের অনেক কমসংখ্যক প্রতিনিধি এই বৈঠকে যোগদান করেছিলেন । তাঁরা ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রে কয়েকটি প্রগতিশীল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চাইলে সরকার তা প্রত্যাখ্যান করে । তবে এই বৈঠক এবং পরবর্তী আলোচনা সমূহের ফলশ্রুতি হিসাবে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসনআইন বিধিবদ্ধ হয় ।

*****

Related Items

ঔপনিবেশিক শিক্ষা ধারণার সমালোচনা

ঔপনিবেশিক শিক্ষা ধারণার সমালোচনা (Critique of Colonial Ideas Regarding Education):-

ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সূচনাপর্বে বাংলা তথা ভারতের শিক্ষার্থীরা পাঠশালা, টোল, মক্তব ও মাদ্রাসা থেকে সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি -র মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করত । এসব প্রতি

বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট

বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (The Bengal Technical Institute) :-

ব্রিটিশ আমলে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে স্বদেশি আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প হিসাবে বাংলায় স্বদেশি উদ্যোগে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ (National Council of Education)

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ (National Council of Education):-

ব্রিটিশ আমলে লর্ড কার্জনের সময় ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করার পর স্বদেশী আন্দোলন শুরু হলে ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প রূপে দেশীয় প্রগতিশীল স্বদেশী ধাঁচে বাংলায় বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রস

বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশ

বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশ (Development of Technical Education in Bengal) :-

ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে বাংলায় পাশ্চাত্য ধাঁচের কারিগিরি শিক্ষার অস্তিত্ব ছিল না । ঊনিশ শতক থেকে বাংলায় আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার ও বিজ্ঞান শিক্ষার অগ্

বসু বিজ্ঞান মন্দির (Bose Institute)

বসু বিজ্ঞান মন্দির (Bose Institute):-

ঔপনিবেশিক ভারতে আধুনিক বিজ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশের উদ্দেশ্যে যেসকল প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল 'বসুবিজ্ঞান মন্দির' বা বোস ইনস্টিটিউট । ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর জগদীশচন্দ্র বসু ইংল্যান্ডের র