আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলন

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 02/02/2021 - 11:00

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলন (Civil Disobedience Movement and the Peasantry):-

১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে সারা বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় । এই অর্থনৈতিক মন্দা ঔপনিবেশিক ভারতের অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করে । ভারতের কৃষিজাত পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক হারে কমে যায় । কৃষকদের ওপর ধার্য কর ও রাজস্ব দেওয়া খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে । উপরুন্তু জমিদার ও সরকার কেউই সমানুপাতিক হারে কর বা খাজনার পরিমান হ্রাস না করায় কৃষকদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে । এই পরিস্থিতিতে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৬ই এপ্রিল গান্ধিজির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করে । এই আন্দোলনের কর্মসূচিতে কৃষক সমাজের স্বার্থরক্ষার দাবি অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ভারতের কৃষক সম্প্রদায় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে এবং খুব শীঘ্রই উত্তরপ্রদেশ, বিহার, বাংলা, গুজরাট, কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ, কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশ, পাঞ্জাব-সহ বিভিন্ন প্রদেশে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ।

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে অন্ধ্রপ্রদেশের কৃষকসমাজ অন্ধ্র কৃষাণ সভার নেতা অধ্যাপক এন জি রঙ্গা এবং কমিউনিস্ট নেতা পি সুন্দরাইয়ার নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু করে । অন্ধ্রপ্রদেশ কৃষাণ সভার উদ্যোগে প্রায় ২০০০ জন কৃষক ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে ১৩০ দিন ধরে অন্ধ্রের উপকূল অঞ্চলে প্রায় ১৫০০ মাইল পদযাত্রা করে ও বিভিন্ন জেলা এবং গ্রামাঞ্চলে জনসভার আয়োজন করে কৃষকদের দাবিদাওয়া প্রচার করে এবং সরকারের কাছে রাজস্বের হার কমানোর দাবি জানায় । অন্ধ্রের কোথাপটনম, মন্তেবারী, পালম ইত্যাদি জায়গায় কৃষকদের সচেতন করে তোলার জন্য শিক্ষাশিবিরের আয়োজন করা হয় । অন্ধ্রের দরিদ্র কৃষক বেঙ্কট রামা নাইডুর নেতৃত্বে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে জমিদারি-বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় ।

আইন অমান্য আন্দোলনের প্রভাবে কেরলের বিভিন্ন জায়গায় কৃষক আন্দোলন শুরু হয় । কেরল কংগ্রেস নেতা কেলাপ্পান কিষাণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন । পিল্লাই, রামচন্দ্র নেদুমগাড়ি প্রমূখ কমিউনিস্ট ও সোশ্যালিস্ট নেতৃবর্গের নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে । গ্রামে গ্রামে 'কৃষক সঙ্গম' নামে কৃষক সমিতি গঠিত হয় । নায়েব গোমস্তাদের অন্যায় ও শোষণ-দূর্নীতির অবসান, রায়ত উচ্ছেদের অবসান, আগাম খাজনা প্রদান রীতি রদ, সামন্ততান্ত্রিক করের বিলোপসাধন, প্রজাস্বত্ব পুনর্নবীকরণ প্রভৃতি দাবিগুলি কৃষক সঙ্গম সভা সম্মেলন আয়োজন করে তুলে ধরে ।

আইন অমান্য আন্দোলনে প্রভাবিত হয়ে পাঞ্জাবের কৃষক সমাজও কৃষক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল । অমৃতসর, হোসিয়ারপুর, জলন্ধর, শেখপুরা ইত্যাদি জেলার শিখ ও জাঠ কৃষকেরা স্বনির্ভর এবং গুরুদ্বার আন্দোলনের প্রভাবে রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন হওয়ায় এইসব অঞ্চলে সোহন সিং, হরি সিং, তেজ সিং প্রমুখের নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন ব্যাপকভাবে গড়ে ওঠে । পাতিয়ালায় জাগীর সিং ও ভগবান সিং -এর নেতৃত্বে কৃষকেরা খাজনা বন্ধের লক্ষ্যে আন্দোলন গড়ে তোলে । মন্টগোমারি ও মুলতান জেলার কৃষকরা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলনে শামিল হয় । অমৃতসর ও লাহোর জেলার কৃষকরা জলসেচকর্ ও রাজস্ব হ্রাসের দাবিতে আন্দোলন করে । পাঞ্জাবের বিভিন্ন অঞ্চলে এই সমস্ত কৃষক আন্দোলনের প্রভাবে ব্রিটিশ সরকার কৃষকদের কয়েকটি দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় ।

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে বিহারে সংগঠিত কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল । জমিদার শ্রেণির বিরুদ্ধে কংগ্রেস দলের সংগ্রাম বিমুখ নীতির প্রতিবাদে কংগ্রেসি নেতা স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস দলের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে বিহারে একটি প্রাদেশিক কিষাণ সভা গড়ে তোলেন । প্রাচ্যবিদ্যায় বিখ্যাত পন্ডিত রাহুল সংকৃত্যায়ন, পঞ্চানন শর্মা, যদুনন্দন শর্মা প্রমূখ ব্যক্তিদের সাহায্যে তিনি কৃষকদের সংঘবদ্ধ করেন । অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়ে বহু কৃষক খাজনা দিতে অসমর্থ হওয়ায় তাদের জমি হাতছাড়া হয়েছিল । এই হারানো জমি ফিরে পাওয়ার লক্ষ্যে কৃষকেরা সত্যাগ্রহ কর্মসূচি গ্রহণ, বলপূর্বক বীজ বপন ও ফসল কাটা প্রভৃতি কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলন গড়ে তোলে । বিহারের দ্বারভাঙ্গা ও গয়া জেলায় সংঘটিত এই আন্দোলনের নাম বখস্ত ভূমি আন্দোলন । বিহারের মুঙ্গের জেলার বারহাইয়া তালুকে জমিদারি অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন শুরু হয়েছিল । বিহারের কৃষক আন্দোলন মূলত অহিংস পথে চললেও মুঙ্গের ও মুজফফর থানা আক্রমনের মতো সহিংস ঘটনাও ঘটে । তীব্র পুলিশি দমন নীতির সাহয্যে ব্রিটিশ সরকার এই আন্দোলন দমন করে ।

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে যুক্তপ্রদেশ বর্তমানে উত্তরপ্রদেশে কৃষক আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছিল । গান্ধিজি ও জাতীয় কংগ্রেস কর বয়কট আন্দোলন পুরোপুরি সমর্থন করেননি । গান্ধিজি একটি ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে কৃষকদের কাছে আবেদন করে বলেন— জমিতে অধিকার আছে এমন কৃষকেরা যেন নির্ধারিত রাজস্বহারের প্রতি টাকায় ১২ আনা ও জমির ওপর অধিকারহীন কৃষকেরা প্রতি টাকায় ৮ আনা কর দেয় । কিন্তু সরকারি তরফে দেখা যায় গান্ধিজির কথা অমান্য করে সমস্ত কৃষকেরা টাকায় ৮ আনা হারে খাজনা দিচ্ছে । ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে কালিকা প্রসাদ ও অঞ্জনি কুমার নামে দুই চরমপন্থী নেতার নেতৃত্বে কৃষকেরা জমিদারদের বাড়িঘর ঘেরাও করে জমির বেদখলিকরণ বন্ধের চেষ্টা করে ও সেওগড়ের রাজা কিছু কৃষকের জমির দখল নিলে তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলে । রায়বেরিলি ছাড়াও বারাবাঁকি ও এলাহাবাদের মানঝানপুর তহশিলে কৃষক আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছিল । ছোটোলাট হেইলি তীব্র দমননীতি প্রয়োগ করে এবং টাকায় দু-আনা খাজনা কমিয়ে উত্তরপ্রদেশে কৃষক আন্দোলন বন্ধের চেষ্টা করেন ।

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে বাংলাদেশে মূলত কিষান সভা, শ্রমিক কৃষক দল ও কৃষকপ্রজা দল কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল । মুসলিম লিগও কৃষক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে । বাংলাদেশের এইসময়কার সমস্ত কৃষক আন্দোলনগুলির মধ্যে শ্রমিক কৃষক দলের যুব সংগঠন ইয়ং কমরেড লিগ দ্বারা সংগঠিত ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ কৃষক আন্দোলন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । মহাজন জমিদার ও ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে কিশোরগঞ্জ আন্দোলন গড়ে ওঠে । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসের প্রথমদিকে চাষিরা ঈশ্বরচন্দ্র শীল নামে একজন মহাজনের কাছে ঋণপত্র বা তনসুক প্রত্যর্পণ দাবি করে । পাকুন্দিয়া, এগারসিন্ধু, জাঙ্গালিয়া, মিরজাপুর, জামালপুর, গোবিন্দপুর ইত্যাদি গ্রামে এই আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে ।

*****

Comments

Related Items

বাংলায় ছাপাখানার বিকাশ

বাংলায় ছাপাখানার বিকাশ (development of Printing Press in Bengal):-

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে জুন রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পলাশির যুদ্ধে পরাজিত করার পর ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ধীরে ধী

বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (উনিশ শতকের মধ্যভাগ - বিশ শতকের প্রথম ভাগ) : বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা

বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ (Alternative Ideas and Initiatives) - উনিশ শতকের মধ্যভাগ - বিশ শতকের প্রথম ভাগ : বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা :

বঙ্গদেশে আধুনিক ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার পূর্বে হাতে লেখা পুঁথিপত্রের সাহায্যে শিক্ষা গ্রহণের কাজ চলত । এইসব পুঁথিপত্রে

ভারতমাতা চিত্র (Bharatmata)

ভারতমাতা চিত্র  ভারতমাতা চিত্র

গোরা (Gora)

গোরা (Gora) of Rabindranath Tagore :-

ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতবাসীদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের বিকাশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে রচিত গোরা উপন্যাসটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । এই  উপন্যাসের কয়েকটি মুখ্য চরিত্র হল— গোরা, আনন্দময়