Submitted by avimanyu pramanik on Wed, 01/05/2022 - 20:39

প্রশ্ন:- অমৃতসরের সন্ধির গুরুত্ব বর্ণনা করুন ।

অমৃতসরের সন্ধি (Treaty of Amritsar) - পাঞ্জাবের বিবাদমান ছোটো মিসলগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে পাঞ্জাবে এক শক্তিশালী শিখ রাজ্য গড়ে তোলাই ছিল রঞ্জিত সিংহের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য । এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তিনি ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে অমৃতসর দখল করে শতদ্রু নদীর পূর্ব তীরের শিখ রাজ্যগুলি অধিকার করতে উদ্দ্যোগী হন । এতে ওই সমস্ত শিখ রাজ্যের নায়কগণ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ইংরেজদের শরণাপন্ন হন । ইংরেজ গভর্নর জেনারেল লর্ড মিন্টো রঞ্জিত সিংহের সঙ্গে বোঝাপড়ার জন্য চার্লস মেটাকাফকে তাঁর দরবারে পাঠান । ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবের মহারাজা রণজিৎ সিংহ এবং ইংরেজদের পক্ষে গভর্নর-জেনারেল লর্ড মিন্টোর প্রতিনিধি হিসাবে চার্লস মেটকাফ -এর মধ্যে অমৃতসরের সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় । অমৃতসরের সন্ধির শর্ত অনুসারে ঠিক হয় যে, শতদ্রু নদীর পূর্বদিকে রণজিৎ সিংহ আর রাজ্যবিস্তার করতে পারবেন না । অর্থাৎ তাঁকে পশ্চিম পাঞ্জাবের নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যেই রাজ্যবিস্তার সীমাবদ্ধ রাখতে হবে । অমৃতসরের সন্ধির মাধ্যমে ইংরেজরা শতদ্রু নদীর পূর্বতীরে রণজিৎ সিংহের রাজ্যবিস্তার সম্পূর্ণভাবে রোধ করে ছিল । এই সন্ধির ফলে রণজিৎ সিংহের মর্যাদাহানি হয় এবং ব্রিটিশ পক্ষের রাজ্য ও প্রভাব বৃদ্ধি পায় । অমৃতসরের চুক্তির ফলে রণজিৎ সিংহের পক্ষে শতদ্রু নদীর পূর্বতীরে রাজ্য বিস্তারের আর কোনো সুযোগ রইল না । যাই হোক, অমৃতসরের সন্ধির পরবর্তী সময়ে তিনি মুলতান, ঝঙ্গ, কাশ্মীর, ডেরা ইস্‌মাইল খাঁ, ডেরা গাজি খাঁ ও পেশোয়ার অধিকার করেন । যার ফলে তাঁর সাম্রাজ্য লাহোর থেকে সিন্ধু পর্যন্ত বিস্তৃত হয় ।

 

অমৃতসরের সন্ধির শর্তগুলি ছিল—

 

(১) শতদ্রু নদীকে রণজিৎ সিংহের রাজ্যের পূর্ব সীমারেখা বলে স্থির হয়  ।

(২) শতদ্রু নদীর পূর্ব তীরের রাজ্যগুলির ওপর ইংরেজদের আধিপত্য স্বীকার করে নেওয়া হয় ।

(৩) উভয় পক্ষ ‘স্থায়ী মৈত্রী’ বজায় রাখতে স্বীকৃত হন ।

পূর্বদিকে রাজ্যবিস্তারে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে রঞ্জিত সিংহ পশ্চিম দিকে রাজ্য বিস্তারে সচেষ্ট হন । ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি আফগানদের পরাস্ত করে আটক অধিকার করেন । ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি মুলতান, কাশ্মীর ও পেশোয়ার জয় করে তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত করেন । ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইংরেজদের সঙ্গে রঞ্জিত সিংহের সদ্ভাব বজায় থাকলেও নানা বিষয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে মন কষাকষি চলছিল । ইতিমধ্যে রাশিয়া পারস্যে অধিকার বিস্তার করলে ভারতের নিরাপত্তা সম্পর্কে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ আশঙ্কিত হন । এছাড়া সিন্ধুদেশের রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব সম্পর্কে ইংরেজরা ক্রমে আগ্রহী হয়ে উঠছিলেন । এমতাবস্থায় তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্ক রাশিয়ার অগ্রগতি রোধ করার উদ্ধেশ্যে রঞ্জিত সিংহ ও সিন্ধুর আমীরদের প্রতি ঘনিষ্টতা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন । এর ফলশ্রুতিতে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে কাবুলের সিংহাসনচ্যুত রাজা শাহসুজা, রঞ্জিত সিংহ ও ইংরেজদের মধ্যে 'ত্রিশক্তি মৈত্রী চুক্তি' স্বাক্ষরিত হয় । ওই বছরই রঞ্জিত সিংহের জীবনাবসান হয় ।  

ত্রিশক্তি মৈত্রী চুক্তি— আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে রণজিৎ সিংহ অত্যন্ত কূটনৈতিক চাতুর্যের পরিচয় দেন । ইংরেজদের পরোক্ষ সহযোগিতায় সাময়িকভাবে আফগানিস্তানের উপর নিজের আধিপত্য কায়েমে সক্ষম হলেও ইংরেজদের হস্তক্ষেপের ফলে ১৮৩৯ সালে শাহসুজা, ইংরেজ ও রণজিৎ সিংহের মধ্যে 'ত্রিশক্তি মৈত্রী চুক্তি' স্বাক্ষরিত হয় । অবশেষে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে রণজিৎ সিংহের মৃত্যু হয় । এইভাবে প্রতিটি ব্যাপারেই ইংরেজদের সঙ্গে আপসের মাধ্যমে রণজিৎ সিংহ নিজের অস্তিত্বকে বজায় রেখে চলেছিলেন । কারণ সমসাময়িক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে রণজিৎ সিংহ সঠিকভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন যে, অমিতশক্তিশালী ব্রিটিশ শক্তির সঙ্গে লড়াইয়ে তিনি কোনোদিনই জয়লাভ করতে পারবেন না । তাই বাস্তবোচিত নীতি গ্রহণ করে তিনি নিজের বুদ্ধিদীপ্ততা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন ।

মূল্যায়ন - ইংরেজদের সঙ্গে রণজিৎ সিংহের সম্পর্ক কেমন ছিল তা বিশ্লেষণ করেত গিয়ে প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ডঃ নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ বলেছেন যে, ‘ইঙ্গ-শিখ মৈত্রীর ক্ষেত্রে রণজিৎ সিংহ ছিলেন ঘোড়া এবং ইংরেজরা ছিলেন সেই ঘোড়ার চালক’ । বস্তুত রণজিৎ সিংহ ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে শিখ রাজ্যের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা করে যেতে পারেননি ।

******

Comments

Related Items

বিশ শতকের ভারতে দলিত রাজনীতি ও আন্দোলনের বিকাশ

বিশ শতকের ভারতে দলিত রাজনীতি ও আন্দোলনের বিকাশ(Development of Dalit Politics and Movements in Twentieth Century India):-

বিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী যে জাতীয় আন্দোলনগুলি সংঘটিত হয় তার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চারটি জাতীয় আন্দ

বীণা দাস (Bina Das)

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে যাঁদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে আছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন বাংলার বিপ্লবী বীণা দাস । তিনি ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে আগস্ট নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁদের আদি বাসস্থান ছিল চট্টগ্রামে । তাঁর পিতার নাম বেণী মাধব দাস ও মাতার নাম সরলা দাস ...

মাস্টারদা সূর্যসেন (Surya Sen)

ভারতবর্ষের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে পরিচিত সূর্য সেন বা সূর্যকুমার সেন যিনি মাস্টারদা নামে সমধিক পরিচিত । তাঁর ডাকনাম ছিল কালু । সূর্য সেন ১৮৯৪ সালের ২২শে মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর বাবার নাম রাজমনি সেন এবং মায়ের নাম শশীবালা সেন ...

বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স (Bengal Volunteers)

বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স (Bengal Volunteers):-

গান্ধিজির নেতৃত্বে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ডাকা অহিংস অসহযোগ আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পরে ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে 'বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স' সংগঠনটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে । ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জাতীয়

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ (Students' Role in Armed Revolutionary Struggles) :-

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরাধীন জাতির মুক্তি সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে । ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও জাতীয