প্রশ্ন:- অমৃতসরের সন্ধির গুরুত্ব বর্ণনা করুন ।
অমৃতসরের সন্ধি (Treaty of Amritsar) - পাঞ্জাবের বিবাদমান ছোটো মিসলগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে পাঞ্জাবে এক শক্তিশালী শিখ রাজ্য গড়ে তোলাই ছিল রঞ্জিত সিংহের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য । এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তিনি ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে অমৃতসর দখল করে শতদ্রু নদীর পূর্ব তীরের শিখ রাজ্যগুলি অধিকার করতে উদ্দ্যোগী হন । এতে ওই সমস্ত শিখ রাজ্যের নায়কগণ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ইংরেজদের শরণাপন্ন হন । ইংরেজ গভর্নর জেনারেল লর্ড মিন্টো রঞ্জিত সিংহের সঙ্গে বোঝাপড়ার জন্য চার্লস মেটাকাফকে তাঁর দরবারে পাঠান । ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবের মহারাজা রণজিৎ সিংহ এবং ইংরেজদের পক্ষে গভর্নর-জেনারেল লর্ড মিন্টোর প্রতিনিধি হিসাবে চার্লস মেটকাফ -এর মধ্যে অমৃতসরের সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় । অমৃতসরের সন্ধির শর্ত অনুসারে ঠিক হয় যে, শতদ্রু নদীর পূর্বদিকে রণজিৎ সিংহ আর রাজ্যবিস্তার করতে পারবেন না । অর্থাৎ তাঁকে পশ্চিম পাঞ্জাবের নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যেই রাজ্যবিস্তার সীমাবদ্ধ রাখতে হবে । অমৃতসরের সন্ধির মাধ্যমে ইংরেজরা শতদ্রু নদীর পূর্বতীরে রণজিৎ সিংহের রাজ্যবিস্তার সম্পূর্ণভাবে রোধ করে ছিল । এই সন্ধির ফলে রণজিৎ সিংহের মর্যাদাহানি হয় এবং ব্রিটিশ পক্ষের রাজ্য ও প্রভাব বৃদ্ধি পায় । অমৃতসরের চুক্তির ফলে রণজিৎ সিংহের পক্ষে শতদ্রু নদীর পূর্বতীরে রাজ্য বিস্তারের আর কোনো সুযোগ রইল না । যাই হোক, অমৃতসরের সন্ধির পরবর্তী সময়ে তিনি মুলতান, ঝঙ্গ, কাশ্মীর, ডেরা ইস্মাইল খাঁ, ডেরা গাজি খাঁ ও পেশোয়ার অধিকার করেন । যার ফলে তাঁর সাম্রাজ্য লাহোর থেকে সিন্ধু পর্যন্ত বিস্তৃত হয় ।
অমৃতসরের সন্ধির শর্তগুলি ছিল—
(১) শতদ্রু নদীকে রণজিৎ সিংহের রাজ্যের পূর্ব সীমারেখা বলে স্থির হয় ।
(২) শতদ্রু নদীর পূর্ব তীরের রাজ্যগুলির ওপর ইংরেজদের আধিপত্য স্বীকার করে নেওয়া হয় ।
(৩) উভয় পক্ষ ‘স্থায়ী মৈত্রী’ বজায় রাখতে স্বীকৃত হন ।
পূর্বদিকে রাজ্যবিস্তারে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে রঞ্জিত সিংহ পশ্চিম দিকে রাজ্য বিস্তারে সচেষ্ট হন । ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি আফগানদের পরাস্ত করে আটক অধিকার করেন । ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি মুলতান, কাশ্মীর ও পেশোয়ার জয় করে তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত করেন । ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইংরেজদের সঙ্গে রঞ্জিত সিংহের সদ্ভাব বজায় থাকলেও নানা বিষয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে মন কষাকষি চলছিল । ইতিমধ্যে রাশিয়া পারস্যে অধিকার বিস্তার করলে ভারতের নিরাপত্তা সম্পর্কে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ আশঙ্কিত হন । এছাড়া সিন্ধুদেশের রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব সম্পর্কে ইংরেজরা ক্রমে আগ্রহী হয়ে উঠছিলেন । এমতাবস্থায় তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্ক রাশিয়ার অগ্রগতি রোধ করার উদ্ধেশ্যে রঞ্জিত সিংহ ও সিন্ধুর আমীরদের প্রতি ঘনিষ্টতা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন । এর ফলশ্রুতিতে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে কাবুলের সিংহাসনচ্যুত রাজা শাহসুজা, রঞ্জিত সিংহ ও ইংরেজদের মধ্যে 'ত্রিশক্তি মৈত্রী চুক্তি' স্বাক্ষরিত হয় । ওই বছরই রঞ্জিত সিংহের জীবনাবসান হয় ।
ত্রিশক্তি মৈত্রী চুক্তি— আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে রণজিৎ সিংহ অত্যন্ত কূটনৈতিক চাতুর্যের পরিচয় দেন । ইংরেজদের পরোক্ষ সহযোগিতায় সাময়িকভাবে আফগানিস্তানের উপর নিজের আধিপত্য কায়েমে সক্ষম হলেও ইংরেজদের হস্তক্ষেপের ফলে ১৮৩৯ সালে শাহসুজা, ইংরেজ ও রণজিৎ সিংহের মধ্যে 'ত্রিশক্তি মৈত্রী চুক্তি' স্বাক্ষরিত হয় । অবশেষে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে রণজিৎ সিংহের মৃত্যু হয় । এইভাবে প্রতিটি ব্যাপারেই ইংরেজদের সঙ্গে আপসের মাধ্যমে রণজিৎ সিংহ নিজের অস্তিত্বকে বজায় রেখে চলেছিলেন । কারণ সমসাময়িক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে রণজিৎ সিংহ সঠিকভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন যে, অমিতশক্তিশালী ব্রিটিশ শক্তির সঙ্গে লড়াইয়ে তিনি কোনোদিনই জয়লাভ করতে পারবেন না । তাই বাস্তবোচিত নীতি গ্রহণ করে তিনি নিজের বুদ্ধিদীপ্ততা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন ।
মূল্যায়ন - ইংরেজদের সঙ্গে রণজিৎ সিংহের সম্পর্ক কেমন ছিল তা বিশ্লেষণ করেত গিয়ে প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ডঃ নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ বলেছেন যে, ‘ইঙ্গ-শিখ মৈত্রীর ক্ষেত্রে রণজিৎ সিংহ ছিলেন ঘোড়া এবং ইংরেজরা ছিলেন সেই ঘোড়ার চালক’ । বস্তুত রণজিৎ সিংহ ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে শিখ রাজ্যের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা করে যেতে পারেননি ।
******