Submitted by avimanyu pramanik on Wed, 09/30/2020 - 09:01

নীলদর্পণ : ঊনিশ শতকে বাংলার সমাজজীবনের চিত্র যেসব সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়েছে সেগুলির মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ছিল দীনবন্ধু মিত্রের লেখা নাটক 'নীলদর্পণ' । নীল চাষিদের ওপর নীলকর সাহেবদের শোষণ, অত্যাচার ও নীলবিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে বিশিষ্ট নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে 'নীলদর্পণ' নাটক রচনা করেন ।

ঊনিশ শতকে ইউরোপে বস্ত্রশিল্পের প্রয়োজনে নীলের চাহিদা বৃদ্ধি পেলে ইংরেজিসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা বাংলায় এসে এখানকার চাষিদের ধানচাষের পরিবর্তে নীলচাষে বাধ্য করে । ফলে চাষীদের ঘরে খাদ্যাভাব দেখা দেয় ও বাংলার চাষিদের জীবনে চরম দুর্দশা নেমে আসে । ক্ষতিগ্রস্ত চাষীদের জীবনে নেমে আসা দুর্দশার অশ্রুসজল কাহিনি 'নীলদর্পণ' নাটকে ফুটিয়ে তোলা হয় । চাষিদের জমি থেকে উৎখাত করা, ঘর-বাড়িতে আগুন লাগানো, নীলকুঠিতে চাষিদের ধরে নিয়ে গিয়ে অমানবিক নির্যাতন প্রভৃতি এই নাটকে তুলে ধরা হয় ।

'নীলদর্পণ' নাটকে নীলচাষিদের ওপর যে নির্মম অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরা হয় তা থেকে শিক্ষিত সমাজ নীলচাষিদের ওপর এই অন্যায় অত্যাচার সম্পর্কে জানতে পারে । ফলে বাংলার শিক্ষিত সমাজে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয় । তীব্র শোষণ ও অত্যাচারের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলার দরিদ্র নীলচাষিরা ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে, যা 'নীলবিদ্রোহ' নামে পরিচিত । নীলদর্পণ নাটকে এই বিদ্রোহের সূত্রপাত হয় ও প্রসারের চিত্র প্রতিফলিত হয় ।

'নীলদর্পণ' নাটক হল বাংলার প্রথম বাংলা ভাষায় নাটক যা ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয় । এর ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং পাদ্রী রেভারেন্ড জেমস লং এর নামে প্রকাশিত হয় । স্বার্থবিরোধী হওয়ায় লং সাহেবের নামে নীলকররা মামলা করে । মামলায় লং সাহেবের এক মাস কারাদণ্ড ও এক হাজার টাকা জরিমানা হয় । জরিমানার টাকা দেন কালিপ্রসন্ন সিংহ । নীলদর্পণ নাটক ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে । ইংরেজি ছাড়া অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় এই নাটক অনূদিত হয় । 'নীলদর্পণ' নাটক সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও অত্যাচার সম্পর্কে শিক্ষিত বাঙালি সমাজকে সচেতন ও প্রতিবাদী করে তোলে । এই নাটক বাঙালির মনে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয় । 'নীলদর্পণ' নাটক মানুষের আবেগে কতটা ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল তা একটি ঘটনা থেকে জানা যায় । নাটকটি মঞ্চস্থ হওয়ার সময় দর্শক আসনে বসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অত্যাচারী নীলকর সাহেব মিস্টার উডের চরিত্রে অভিনয়কারী অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির দিকে জুতো ছুড়ে মেরেছিলেন ।    

নীলদর্পণ নাটকে দীনবন্ধু মিত্র নীলবিদ্রোহের কাহিনি বর্ণনার দ্বারা সমকালীন সমাজকে তুলে ধরেছেন । তিনি এই নাটকটিতে সমাজের অসহায় ও অত্যাচারিত নীলচাষীদের দুঃখ-দুর্দশার বর্ণনার মধ্য দিয়ে সমকালীন সমাজের অসহায় প্রজাদের দুঃসহ লাঞ্ছনা তুলে ধরেছেন । এই নাটকের গোলক বসু, নবীন মাধব, বিন্দু মাধব, সৈরিন্ধ্রী, সাবিত্রী, সরলতা প্রভৃতি চরিত্র বর্ণনার মধ্য দিয়ে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের মানসিকতা ধরা পড়ে । গোলক বসুর সহজ-সরল বিশ্বাস, নবীন মাধবের কর্তব্যবোধ ও পিতৃভক্তি, সৈরিন্ধ্রীর পতিব্রতা, সাবিত্রীর অপত্য স্নেহ বাঙালি সমাজজীবনের প্রতিচ্ছবি মেলে ধরে । দীনবন্ধু মিত্র তার এই নাটকে বাস্তব সমাজ-সমস্যা, সমাজের পরিচিত প্রতিদিনের ঘটনা, চেনামুখ ও তাদের চোখের জল ও মুখের হাসি তুলে ধরেছেন । নীলকরদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনে সমাজের রায়ত, সম্পন্ন কৃষক ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় সকলে একজোট হয়েছিল । তাদের সম্মিলিত প্রতিবাদের ভাষা এই নাটকে ধরা পড়ে ।

****

Comments

Related Items

শ্রীরামপুর মিশন প্রেস কিভাবে একটি অগ্রনী মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল ?

প্রশ্ন : শ্রীরামপুর মিশন প্রেস কিভাবে একটি অগ্রনী মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল ?

উঃ- ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৩৮ বছর বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনায় শ্রীরামপুর মিশনের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।

বাংলায় মুদ্রণ শিল্পের বিকাশে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের কীরূপ অবদান ছিল ?

প্রশ্ন : বাংলায় মুদ্রণ শিল্পের বিকাশে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের কীরূপ অবদান ছিল ?

১৮৫৭ -এর মহাবিদ্রোহকে কি সামন্ত-শ্রেণির বিদ্রোহ বলা যায় ?

প্রশ্ন : ১৮৫৭ -এর মহাবিদ্রোহকে কি সামন্ত-শ্রেণির বিদ্রোহ বলা যায় ?

উঃ- ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের সময় থেকেই এই বিদ্রোহের চরিত্র বা প্রকৃতি নিয়ে বিভিন্ন ধারার ইতিহাসচর্চার নানা ধরনের গবেষণালব্দ মতামত পাওয়া যায় ।

কী উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক সরকার অরণ্য আইন প্রণয়ন করেন ?

প্রশ্ন : কী উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক সরকার অরণ্য আইন প্রণয়ন করেন ?

এদেশের চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে কলিকাতা মেডিকেল কলেজের কীরূপ ভূমিকা ছিল ?

প্রশ্ন : এদেশের চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে কলিকাতা মেডিকেল কলেজের কীরূপ ভূমিকা ছিল ?