সমুদ্রস্রোতের প্রভাব (Effects of Ocean Currents) : ভৌগলিক পরিবেশ ও মানুষের কাজকর্মের ওপর পৃথিবীর বিভিন্ন সমুদ্রে প্রবাহিত সমুদ্রস্রোতের নানা রকম প্রভাব দেখা যায় । যেমন —
(১) মগ্নচড়া সৃষ্টি (Creation of Sand Bars) : শীতল সমুদ্রস্রোতের সঙ্গে ভেসে আসা হিমশৈলগুলি উষ্ণ সমুদ্রস্রোতের সংস্পর্শে গলে যায় । তখন হিমশৈলে আবদ্ধ নুড়ি, বালি, কাঁকর, আবর্জনা প্রভৃতি অগভীর সমুদ্রবক্ষে সঞ্চিত হয়ে নিমজ্জিত চড়ার সৃষ্টি করে । একে মগ্নচড়া বা ব্যাংক বলে । যেমন, উত্তর আমেরিকার নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্বে গড়ে ওঠা গ্র্যান্ড ব্যাংক একটি বিখ্যাত মগ্নচড়া । এই মগ্নচড়াগুলি বাণিজ্যিক মৎস্য আহরণের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।
(২) বাণিজ্যিক মৎস্য আহরণের ক্ষেত্রের সৃষ্টি (Business and Commerce) : উষ্ণ ও শীতল সমুদ্রস্রোতের মিলনস্থলে হিমশৈলের গলনের ফলে হিমশৈলবাহিত পদার্থের সঞ্চয় ঘটে মগ্নচড়ার সৃষ্টি হয় । এই মগ্নচড়ায় আবর্জনার প্রাচুর্যে ও সূর্যরশ্মির প্রবেশের ফলে মাছেদের খাদ্য প্ল্যাংকটন প্রচুর পরিমাণে জন্মায় । ফলে সামুদ্রিক মাছের ঝাঁক উষ্ণ ও শীতল স্রোতের মিলনস্থলে বাস করে এবং মগ্নচড়াগুলি বাণিজ্যিক মৎস্য আহরণক্ষেত্র হিসেবে গড়ে ওঠে । যেমন, নিউফাউন্ডল্যান্ডের গ্র্যান্ড ব্যাংক পৃথিবীর একটি বিখ্যাত বাণিজ্যিক মৎস্য আহরণক্ষেত্র । এছাড়া ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ, নরওয়ে ও জাপানের উপকূলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মৎসচারণ ক্ষেত্রগুলি গড়ে উঠেছে ।
(৩) উপকূলের জলবায়ুর ওপর প্রভাব (Impact on Coastal Temperature) : উষ্ণ ও শীতল সমুদ্রস্রোত উপকূলের জলবায়ুর ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে । শীতল স্রোত উপকূলের জলবায়ুকে অপেক্ষাকৃত শীতল রাখে । উষ্ণ স্রোত উপকূলের জলবায়ুকে অপেক্ষাকৃত উষ্ণ রাখে । যেমন, আটলান্টিক মহাসাগরে উষ্ণ উত্তর আটলান্টিক স্রোতের প্রভাবে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের উপকূল অঞ্চল সারা বছর বরফমুক্ত থাকে এবং উষ্ণ কুরোশিয়ো স্রোতের প্রভাবে জাপানের প্রচন্ড ঠান্ডা হ্রাস পায় । আবার শীতল ল্যাব্রাডর স্রোতের প্রভাবে কানাডার পূর্ব উপকূলভাগ বছরে আট নয় মাস বরফাচ্ছাদিত থাকে ।
(৪) জলবায়ুর পরিবর্তন (Changes of Climate) : সমুদ্রস্রোতের প্রভাবে আঞ্চলিক জলবায়ুরও পরিবর্তন ঘটে । যেমন—
(i) উষ্ণ ও শীতল স্রোতের মিলনস্থলে ঘন কুয়াশা ও ঝড়ঝঞ্ঝার সৃষ্টি হয় । উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের উপর দিয়ে প্রবাহিত উষ্ণ ও আর্দ্র বায়ু এবং শীতল ল্যাব্রাডার স্রোতের উপর দিয়ে প্রবাহিত শীতল ও শুষ্ক বায়ু পরস্পর সংমিশ্রণের ফলে নিউ ফাউন্ডল্যান্ড উপকূলে প্রবল ঝড় ও ঘন কুয়াশার সৃষ্টি হয় । এইজন্য এই অঞ্চলে জাহাজ চলাচল বিপজ্জনক ।
(ii) উষ্ণ স্রোতের ওপর জলীয়বাষ্পপূর্ণ বায়ু ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টিপাত এবং শীতল স্রোতের ওপর জলীয়বাষ্প ঘনীভূত হয়ে তুষারপাত ঘটায় । এই কারণে ইংল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলে বৃষ্টিপাত এবং কানাডার ল্যাব্রাডর উপকূলে তুষারপাত ঘটে ।
(iii) প্রশান্ত মহাসাগরে পেরু ও ইকুয়েডর উপকূল দিয়ে মাঝে মাঝে প্রচন্ড উষ্ণ স্রোত প্রবাহের ফলে এল নিনোর প্রভাবে পূর্ব আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশসমূহে আবহাওয়ার অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটে ।
(৫) পোতাশ্রয় বরফ মুক্ত (Frost-free Harbours) উষ্ণ স্রোতের প্রভাবে শীতপ্রধান দেশের বন্দর ও পোতাশ্রয় বরফ মুক্ত থাকে ।
(৬) জাহাজ চলাচল (Navigation) : স্রোতের অভিমুখে জাহাজ চালানো সুবিধাজনক । সমুদ্রস্রোতের অনুকূলে জাহাজ সহজে দ্রুতগতিতে চালানো সম্ভব হয় ।
শৈবাল সাগর : সমুদ্রস্রোতের চক্রাকার আবর্তনের ফলে সৃষ্ট জলাবর্তের মাঝের স্রোতহীন অংশে শৈবাল, আগাছা প্রভৃতি জন্মায় । একে শৈবাল সাগর বলে । সাধারণত মহাসাগরের মধ্যভাগের স্রোতহীন, শৈবাল বা আগাছাভরা শান্ত অংশই হল শৈবাল সাগর (Sargasso Sea) । প্রশান্ত মহাসাগরে বিশাল শৈবাল সাগর দেখা যায় ।
হিমপ্রাচীর : সমুদ্রে উষ্ণ স্রোতের ঘন নীল জলের পাশ দিয়ে প্রবাহিত শীতল স্রোতের ঘন সবুজ জলের মাঝের স্পষ্ট বিভেদরেখাকে হিমপ্রাচীর বলে । নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের কাছে উত্তরমুখী উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোত ও দক্ষিণমুখী শীতল ল্যাব্রাডর স্রোতের মাঝে হিমপ্রাচীর দেখা যায় ।
*****