সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির কারণ (Causes of Ocean Currents)

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 10/19/2021 - 20:30

সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির কারণ (Causes of Ocean Currents) : সমুদ্রস্রোত বিভিন্ন কারণে সৃষ্টি হয়ে থাকে । এই কারণগুলি হল— (১) পৃথিবীর আবর্তন, (২) নিয়ত বায়ুপ্রবাহ, (৩) সমুদ্রজলের উষ্ণতা, (৪) সমুদ্রজলের ও লবণত্ব ও ঘনত্বের তারতম্য, (৫) বরফের গলন , (৬) উপকূলের আকৃতি, (৭) ঋতু পরিবর্তন, (৮) বাষ্পীভবন, (৯) বিভিন্ন সমুদ্র স্রোতের মিলনস্থলে নতুন সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি ।

(১) পৃথিবীর আবর্তন (Rotation of the Earth) : নিজের আবর্তন গতিতে পৃথিবী পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে অবিরাম ঘুরে চলেছে । ফেরেলের সূত্র অনুসারে পৃথিবীর আবর্তনের ফলে সৃষ্ট কোরিওলিস বলের প্রভাবে বায়ুপ্রবাহের মতো সমুদ্রস্রোতেরও গতিবিক্ষেপ ঘটে এবং সমুদ্র স্রোত সরাসরি উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত হতে পারে না । সমুদ্র স্রোতগুলি উত্তর গোলার্ধে ডানদিকে (ঘড়ির কাঁটার দিকে) এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বামদিকে (ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে) বেঁকে প্রবাহিত হয় ।

(২) নিয়ত বায়ুপ্রবাহ (Planetary Winds) : সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির প্রধান কারণ হল নিয়ত বায়ুপ্রবাহ । নিয়ত বায়ুপ্রবাহ নির্দিষ্ট পথে প্রবাহিত হওয়ার সময় সমুদ্রের জলকেও তার প্রবাহপথের দিকে টেনে নিয়ে যায় । আয়নবায়ুর প্রবাহপথ অনুসারে সমুদ্রস্রোত উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে নিরক্ষরেখার দিকে প্রবাহিত হয় । আবার পশ্চিমা বায়ু প্রভাবিত অঞ্চলে সমুদ্রস্রোত পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে থাকে । যেমন, উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে জাপান স্রোত দক্ষিণ-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ুর প্রভাবে পূর্বদিকে বেঁকে সমগ্র প্রশান্ত মহাসাগর অতিক্রম করে । মেরুবায়ুর প্রভাবে পূর্ব দিক থেকে পশ্চিমে সমুদ্র স্রোত প্রবাহিত হয় ।

(৩) সমুদ্রজলের উষ্ণতা (Difference in Temperature ) : সূর্যরশ্মি ভূপৃষ্ঠের কোথাও লম্বভাবে, আবার কোথাও তির্যকভাবে পড়ে । সূর্যরশ্মির পতনকোণের তারতম্যের কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের সমুদ্রের জলের উষ্ণতার মধ্যেও যথেষ্ঠ পার্থক্য ঘটে । উষ্ণতার সমতা বজায় রাখার জন্য তুলনামূলক ভাবে উষ্ণ অঞ্চলের জলরাশি শীতল অঞ্চলের দিকে এবং শীতল অঞ্চলের জলরাশি উষ্ণ অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয় । নিরক্ষীয় অঞ্চলের সমুদ্রজল সূর্য কিরণে উত্তপ্ত এবং আয়তনে বর্ধিত ও হালকা হয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠে উঁচু হয়ে ভেসে ওঠে এবং বহিঃস্রোত (Hot Surface Current) বা উষ্ণ-পৃষ্ঠ স্রোত হিসেবে শীতল মেরু প্রদেশের দিকে প্রবাহিত হয় এবং এই শূন্যস্থান পূরণের জন্য মেরু অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত শীতল এবং ভারী জল সমুদ্রের নীচ দিয়ে শীতল অন্তঃস্রোত (Cold Under Current) হিসেবে নিরক্ষীয় অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয় । এই ভাবে উষ্ণ ও শীতল অঞ্চলের মধ্যে সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয় ।

(৪) সমুদ্রজলের লবণত্ব ও ঘনত্বের তারতম্য (Salinity and Density of Sea water):- সমুদ্রের জলে লবণের পরিমাণ সর্বত্র সমান নয় । সমুদ্রজলে বিভিন্ন প্রকারের লবণ ও নানা ধরনের পদার্থ দ্রবীভূত হয়ে জলের ঘনত্বকে বাড়িয়ে তোলে । সমুদ্র জলের লবণত্ব ও ঘনত্বের তারতম্যের জন্যেও সমুদ্রস্রোতের উৎপত্তি হয় । লবণাক্ততার সমতা আনার জন্য সমুদ্রের কম লবণাক্ত হালকা জল সমুদ্রের ওপরের অংশ দিয়ে বেশি লবণাক্ত ভারী জলের দিকে বহিঃস্রোত হিসেবে প্রবাহিত হয় । আবার সমুদ্রের বেশি লবণাক্ত ভারী জল কম লবণাক্ত হালকা জলের দিকে অন্তঃস্রোত হিসাবে প্রবাহিত হয় । এইভাবে মেরু অঞ্চলের বেশি লবণাক্ত জল নিরক্ষীয় অঞ্চলের কম লবণাক্ত জলের দিকে এবং নিরক্ষীয় অঞ্চলের জল মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্র স্রোতের সৃষ্টি করে । আবার শীতল ও বেশি লবণাক্ত জল উষ্ণ ও কম লবণাক্ত জলের চেয়ে ভারী হওয়ায় বেশি লবণাক্ত ভারী জল নীচে নামে এবং কম লবণাক্ত হালকা জল ওপরে ওঠে । এইভাবে ওপর থেকে নীচে এবং নীচ থেকে ওপরে স্রোতের সৃষ্টি হয় ।

(৫) বরফের গলন (Melting of Ice) : সমুদ্রের কোনো অঞ্চলে বিশালাকৃতির বরফ গলনের ফলে সেখানে সমুদ্রজলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় । তখন জলের সমতা বিধানের জন্য সেই অতিরিক্ত জলরাশি কম জলরাশিপূর্ণ সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি করে ।

(৬) উপকূলের আকৃতি (Shape of Coasts) : বিভিন্ন মহাদেশ বা স্থলভাগের আকৃতি বিভিন্ন ধরনের । সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হওয়ার সময় মহাদেশের উপকূলভাগ বা কোনো দ্বীপে বাধাপ্রাপ্ত হলে তার গতিপথ পরিবর্তিত হয় এবং সমুদ্রস্রোত একাধিক শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে । যেমন, ভারত মহাসাগরের দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোত আফ্রিকার মাদাগাস্কার দ্বীপের উত্তরে বাধা পেয়ে মোজাম্বিক স্রোত ও মাদাগাস্কার স্রোতে বিভক্ত হয় ।

(৭) ঋতু পরিবর্তন (Season Change) : ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে কোনো কোনো অঞ্চলে সমুদ্রস্রোতের প্রবাহের দিকও পরিবর্তিত হয় । যেমন, উত্তর ভারত মহাসাগরে মৌসুমি স্রোত গ্রীষ্মকালে পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে এবং শীতকালে পূর্ব দিক থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হয় ।

(৮) বাষ্পীভবন (Evaporation) : উষ্ণতার জন্য সমুদ্রের কোনো অংশে বাষ্পীভবন বেশি হলে সেখানে জলের অভাব পূরণ করার জন্য চারদিক থেকে শীতল স্রোত ছুটে আসে, ফলে সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয় ।

(৯) বিভিন্ন সমুদ্র স্রোতের মিলনস্থলে নতুন সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি:- বিভিন্ন সমুদ্র স্রোতের মিলনস্থলে জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রিত হয়ে নতুন সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয় । তবে এই ধরনের সমুদ্র স্রোতের ব্যাপকতা থাকে না এবং সাধারণত এগুলো সাময়িক স্রোত হিসেবেও পরিগণিত হয় ।

*****

Comments

Related Items

কাবেরী নদী (The Kaveri)

কাবেরী নদী (The Kaveri) : কর্ণাটক রাজ্যের তালাকাভেরি উচ্চভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে কাবেরী নদী কর্ণাটক ও তামিলনাড়ুর মধ্য দিয়ে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে । কাবেরী নদীর দৈর্ঘ্য ৭৬৫ কিমি.

কৃষ্ণা নদী (The Krishna)

কৃষ্ণা নদী (The Krishna) : পশ্চিমঘাট পর্বতমালার মহাবালেশ্বরের শৃঙ্গের কিছুটা উত্তরে প্রায় ১৪০০ মিটার উচ্চতা থেকে উৎপন্ন হওয়ার পর কৃষ্ণা নদী দক্ষিণ-পূর্বে তেলেঙ্গানা ও অন্ধপ্রদেশ রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিশাল বদ্বীপ সৃষ্টি করে

গোদাবরী নদী (The Godavari)

গোদাবরী নদী (The Godavari) : গোদাবরী নদী 'দক্ষিণ ভারতের গঙ্গা' নামে পরিচিত । মহারাষ্ট্রের ব্রম্ভগিরি পাহাড়ের ত্র্যম্বক শৃঙ্গ থেকে উৎপন্ন হয়ে এবং পরে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে গোদাবরী নদী মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়, তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশ

মহানদী (The Mahanadi)

মহানদী (The Mahanadi) : ছত্তিসগড় রাজ্যের রায়পুর জেলার দক্ষিণাংশের সিয়াওয়া মালভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে মধ্যপ্রদেশ ও ওড়িশা রাজ্য অতিক্রম করার পর বদ্বীপ সৃষ্টি করে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে । মহানদী

তাপী নদী (The Tapti)

তাপী বা তাপ্তি নদী (The Tapti) : মধ্যপ্রদেশের মহাদেব পর্বতের মুলতাই উচ্চভূমির প্রায় ৭৭০ মিটার উচ্চতা থেকে উৎপন্ন হয়ে তাপী নদী মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের ওপর দিয়ে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে সাতপুরা ও অজন্তার মধ্যবর্তী সংকীর্ণ উপত