সমুদ্রস্রোত ও সমুদ্রস্রোতের উৎপত্তির কারণ

Submitted by avimanyu pramanik on Wed, 11/06/2013 - 11:28

বারিমণ্ডল (Hydrosphere) :- সৃষ্টির প্রথম অবস্থায় পৃথিবী ছিল এক উত্তপ্ত জ্বলন্ত মন্ডল । ধীরে ধীরে শীতল ও ঘনীভূত হয়ে তরল অবস্থায় আসে এবং অবিরাম তাপ বিকিরণ করে পৃথিবী ক্রমশ শীতল ও সংকুচিত হয় । আর সংকোচনের ফলে ভূপৃষ্ঠের গায়ে উঁচুনীচু আবরণের সৃষ্টি হয় । এই সময় পৃথিবীতে গ্যাস ও বাষ্প শীতল হয়ে অঝোরে বৃষ্টি শুরু হয় । সেই বৃষ্টির জল ভূপৃষ্ঠের নীচু অংশে জমে সাগর, মহাসাগর প্রভৃতির সৃষ্টি হয়েছে । নদ-নদী, হ্রদ, সাগর, মহাসাগর প্রভৃতি নিয়ে এই যে বিশাল জলভাগ তার নাম বারিমণ্ডল । ভু-পৃষ্ঠের সমগ্র আয়তনের শতকরা 70 ভাগ জল ও মাত্র ৩০ ভাগ স্থালভাগ ।

ভু-পৃষ্ঠে প্রধান পাঁচটি জলভাগ আছে । এগুলি মহাসাগর নামে পরিচিত । (i) প্রশান্ত মহাসাগর,  (ii) আটলান্টিক মহাসাগর,  (iii) ভারত মহাসাগর,  (iv) সুমেরু বা উত্তর মহাসাগর এবং (v) কুমেরু বা দক্ষিণ মহাসাগর ।     

সমুদ্রস্রোত (Ocean Current) :- পৃথিবীর আবর্তন, নিয়ত বায়ুপ্রবাহ, সমুদ্র জলের লবণত্ব, ঘনত্ব ও উষ্ণতার পার্থক্যের জন্য সমুদ্রের জল এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়মিতভাবে সারাবছর নির্দিষ্ট দিকে প্রবাহিত হয় । সমুদ্র জলের এই গতির নাম সমুদ্রস্রোত

সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির কারণ (Causes of Ocean Currents) : সমুদ্রস্রোত বিভিন্ন কারণে সৃষ্টি হয়ে থাকে । এই কারণগুলি হল— (১) পৃথিবীর আবর্তন, (২) নিয়ত বায়ুপ্রবাহ, (৩) সমুদ্রজলের উষ্ণতা, (৪) সমুদ্রজলের ও লবণত্ব ও ঘনত্বের তারতম্য, (৫) বরফের গলন , (৬) উপকূলের আকৃতি, (৭) ঋতু পরিবর্তন, (৮) বাষ্পীভবন, (৯) বিভিন্ন সমুদ্র স্রোতের মিলনস্থলে নতুন সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি ।

(১) পৃথিবীর আবর্তন (Rotation of the Earth) : নিজের আবর্তন গতিতে পৃথিবী পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে অবিরাম ঘুরে চলেছে । ফেরেলের সূত্র অনুসারে পৃথিবীর আবর্তনের ফলে সৃষ্ট কোরিওলিস বলের প্রভাবে বায়ুপ্রবাহের মতো সমুদ্রস্রোতেরও গতিবিক্ষেপ ঘটে এবং সমুদ্র স্রোত সরাসরি উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত হতে পারে না । সমুদ্র স্রোতগুলি উত্তর গোলার্ধে ডানদিকে অর্থাৎ ঘড়ির কাঁটার দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বামদিকে অর্থাৎ ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে বেঁকে প্রবাহিত হয় ।

(২) নিয়ত বায়ুপ্রবাহ (Planetary Winds) : সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির প্রধান কারণ হল নিয়ত বায়ুপ্রবাহ । নিয়ত বায়ুপ্রবাহ নির্দিষ্ট পথে প্রবাহিত হওয়ার সময় সমুদ্রের জলকেও তার প্রবাহপথের দিকে টেনে নিয়ে যায় । আয়নবায়ুর প্রবাহপথ অনুসারে সমুদ্রস্রোত উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে নিরক্ষরেখার দিকে প্রবাহিত হয় । আবার পশ্চিমা বায়ু প্রভাবিত অঞ্চলে সমুদ্রস্রোত পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে থাকে । যেমন— উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে জাপান স্রোত দক্ষিণ-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ুর প্রভাবে পূর্বদিকে বেঁকে সমগ্র প্রশান্ত মহাসাগর অতিক্রম করে । মেরুবায়ুর প্রভাবে পূর্ব দিক থেকে পশ্চিমে সমুদ্র স্রোত প্রবাহিত হয় ।

(৩) সমুদ্রজলের উষ্ণতা (Difference in Temperature ) : সূর্যরশ্মি ভূপৃষ্ঠের কোথাও লম্বভাবে, আবার কোথাও তির্যকভাবে পড়ে । সূর্যরশ্মির পতনকোণের তারতম্যের কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের সমুদ্রের জলের উষ্ণতার মধ্যেও যথেষ্ঠ পার্থক্য ঘটে । উষ্ণতার সমতা বজায় রাখার জন্য তুলনামূলক ভাবে উষ্ণ অঞ্চলের জলরাশি শীতল অঞ্চলের দিকে এবং শীতল অঞ্চলের জলরাশি উষ্ণ অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয় । নিরক্ষীয় অঞ্চলের সমুদ্রজল সূর্য কিরণে উত্তপ্ত এবং আয়তনে বর্ধিত ও হালকা হয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠে উঁচু হয়ে ভেসে ওঠে এবং বহিঃস্রোত (Hot Surface Current) বা উষ্ণ-পৃষ্ঠ স্রোত হিসেবে শীতল মেরু প্রদেশের দিকে প্রবাহিত হয় এবং এই শূন্যস্থান পূরণের জন্য মেরু অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত শীতল এবং ভারী জল সমুদ্রের নীচ দিয়ে শীতল অন্তঃস্রোত (Cold Under Current) হিসেবে নিরক্ষীয় অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয় । এই ভাবে উষ্ণ ও শীতল অঞ্চলের মধ্যে সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয় ।

(৪) সমুদ্রজলের লবণত্ব ও ঘনত্বের তারতম্য (Salinity and Density of Sea water):- সমুদ্রের জলে লবণের পরিমাণ সর্বত্র সমান নয় । সমুদ্রজলে বিভিন্ন প্রকারের লবণ ও নানা ধরনের পদার্থ দ্রবীভূত হয়ে জলের ঘনত্বকে বাড়িয়ে তোলে । সমুদ্র জলের লবণত্ব ও ঘনত্বের তারতম্যের জন্যেও সমুদ্রস্রোতের উৎপত্তি হয় । লবণাক্ততার সমতা আনার জন্য সমুদ্রের কম লবণাক্ত হালকা জল সমুদ্রের ওপরের অংশ দিয়ে বেশি লবণাক্ত ভারী জলের দিকে বহিঃস্রোত হিসেবে প্রবাহিত হয় । আবার সমুদ্রের বেশি লবণাক্ত ভারী জল কম লবণাক্ত হালকা জলের দিকে অন্তঃস্রোত হিসাবে প্রবাহিত হয় । এইভাবে মেরু অঞ্চলের বেশি লবণাক্ত জল নিরক্ষীয় অঞ্চলের কম লবণাক্ত জলের দিকে এবং নিরক্ষীয় অঞ্চলের জল মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্র স্রোতের সৃষ্টি করে । আবার শীতল ও বেশি লবণাক্ত জল উষ্ণ ও কম লবণাক্ত জলের চেয়ে ভারী হওয়ায় বেশি লবণাক্ত ভারী জল নীচে নামে এবং কম লবণাক্ত হালকা জল ওপরে ওঠে । এইভাবে ওপর থেকে নীচে এবং নীচ থেকে ওপরে স্রোতের সৃষ্টি হয় ।

(৫) বরফের গলন (Melting of Ice) : সমুদ্রের কোনো অঞ্চলে বিশালাকৃতির বরফ গলনের ফলে সেখানে সমুদ্রজলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় । তখন জলের সমতা বিধানের জন্য সেই অতিরিক্ত জলরাশি কম জলরাশিপূর্ণ সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি করে ।

(৬) উপকূলের আকৃতি (Shape of Coasts) : বিভিন্ন মহাদেশ বা স্থলভাগের আকৃতি বিভিন্ন ধরনের । সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হওয়ার সময় মহাদেশের উপকূলভাগ বা কোনো দ্বীপে বাধাপ্রাপ্ত হলে তার গতিপথ পরিবর্তিত হয় এবং সমুদ্রস্রোত একাধিক শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে । যেমন, ভারত মহাসাগরের দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোত আফ্রিকার মাদাগাস্কার দ্বীপের উত্তরে বাধা পেয়ে মোজাম্বিক স্রোত ও মাদাগাস্কার স্রোতে বিভক্ত হয় ।

(৭) ঋতু পরিবর্তন (Season Change) : ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে কোনো কোনো অঞ্চলে সমুদ্রস্রোতের প্রবাহের দিকও পরিবর্তিত হয় । যেমন, উত্তর ভারত মহাসাগরে মৌসুমি স্রোত গ্রীষ্মকালে পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে এবং শীতকালে পূর্ব দিক থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হয় ।

(৮) বাষ্পীভবন (Evaporation) : উষ্ণতার জন্য সমুদ্রের কোনো অংশে বাষ্পীভবন বেশি হলে সেখানে জলের অভাব পূরণ করার জন্য চারদিক থেকে শীতল স্রোত ছুটে আসে, ফলে সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয় ।

(৯) বিভিন্ন সমুদ্র স্রোতের মিলনস্থলে নতুন সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি:- বিভিন্ন সমুদ্র স্রোতের মিলনস্থলে জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রিত হয়ে নতুন সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয় । তবে এই ধরনের সমুদ্র স্রোতের ব্যাপকতা থাকে না এবং সাধারণত এগুলো সাময়িক স্রোত হিসেবেও পরিগণিত হয় ।

*****

Related Items

দ্বীপপুঞ্জ সমূহ (The Islands)

দ্বীপপুঞ্জ সমূহ (The Islands): ভারতের দক্ষিণ-পূর্বে বঙ্গোপসাগরে বহু আগ্নেয় দ্বীপ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে আরব সাগরে অসংখ্য প্রবাল দ্বীপের অবস্থান পরিলক্ষিত হয় । অবস্থান অনুসারে এই দ্বীপপুঞ্জগুলিকে দু'ভাগে ভাগ করা যায় । যথা— (১) বঙ্গোপসাগরের দ্বীপপুঞ্জ এবং (

উপকূলীয় সমভূমি অঞ্চল (The Coastal Plains)

উপকূলীয় সমভূমি অঞ্চল (The Coastal Plains) : দক্ষিণ ভারতের পূর্বদিকে বঙ্গোপসাগর এবং পশ্চিমদিকে আরব সাগরের উপকূল বরাবর গড়ে ওঠা সংকীর্ণ সমভূমি অঞ্চল দুটি উপকূলীয় সমভূমি নামে পরিচিত । এই অঞ্চলকে দু-ভাগে ভাগ করা যায় । যথা— (১) পূর্ব উপকূলীয় সমভূমি

উপদ্বীপীয় মালভূমি অঞ্চল (The Peninsular Plateau)

(গ) উপদ্বীপীয় মালভূমি অঞ্চল (The Peninsular Plateau or The Deccan Plateau): উত্তরের সমভূমি অঞ্চলের দক্ষিণ দিকে পশ্চিমে আরাবল্লি পর্বত থেকে শুরু করে পূর্বে রাজমহল পাহাড় এবং উত্তরে গঙ্গা সমভূমি থেকে শুরু করে দক্ষিণে উপকূলীয় সমভূমির মধ্যবর্তী অংশে উপদ্ব

উত্তরের সমভূমি অঞ্চল (The Northern Plains)

উত্তরের সমভূমি অঞ্চল (The Northern Plains) : উত্তরে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল এবং দক্ষিণে উপদ্বীপীয় মালভূমির মধ্যবর্তী অঞ্চলে সিন্ধু, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র এবং এদের বিভিন্ন উপনদী ও শাখানদীগুলি পলি সঞ্চয় করে যে বিস্তৃত সমতলভূমি গঠন করেছে তাকে উত্তরের সমভূমি

উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল (The Northern Mountains)

উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল (The Northern Mountains) : ভারতের সমগ্র উত্তর অংশ জুড়ে উত্তরে তিব্বত মালভূমি এবং দক্ষিণে উত্তর ভারতের সমভূমি অঞ্চলের মাঝে অবস্থান করছে উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল । প্রায় নিরবিচ্ছিন্ন পর্বতশ্রেণি নিয়ে গড়ে ওঠা এই অঞ্চলটি পশ্চিমে কাশ