পৃথিবীর বায়ুচাপ বলয় (Pressure Belts of the World)

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 08/13/2012 - 11:47

পৃথিবীর বায়ুচাপ বলয় (Pressure Belts of the World):- পৃথিবীর বায়ুর চাপের ক্ষেত্রে দুটি অবস্থা লক্ষ করা যায়— (ক) উচ্চচাপ ([High Pressure)  ও  (খ) নিম্নচাপ (Low Pressure) ।  কোনোও জায়গার বায়ুর চাপের চেয়ে তার চারিদিকের বায়ুর চাপ যদি কম হয় তাহলে সেই জায়গার বায়ুর চাপকে উচ্চচাপ বলা হয় । আর কোনোও জায়গার বায়ুর চাপের চেয়ে তার চারিদিকের বায়ুর চাপ বেশি হয় তাহলে সেই জায়গার বায়ুর চাপকে নিম্নচাপ বলা হয় ।

বায়ুচাপের তারতম্য অনুসারে পৃথিবীকে সাতটি নির্দিষ্ট বায়ুচাপ অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে । পৃথিবীর আকৃতি প্রায় গোলাকার হওয়ার জন্য এক একটি বায়ুচাপ অঞ্চল পৃথিবীপৃষ্ঠকে এক একটি ‘রিং’ বা ‘বলয়ের মতো’ ঘিরে আছে তাই এদের বায়ুচাপ বলয়ও বলে । অর্থাৎ পৃথিবীতে নির্দিষ্ট সাতটি বায়ুচাপ বলয় আছে । এই ৭টি বায়ুচাপ বলয়ের মধ্যে ৪টি স্থায়ী উচ্চচাপ বলয় রয়েছে, এবং ৩টি স্থায়ী নিম্নচাপ বলয় রয়েছে ।

৪টি স্থায়ী উচ্চচাপ বলয় হল :- (২) কর্কটীয় উচ্চচাপ বলয়,  (৩) মকরীয় উচ্চচাপ বলয়, (৬) সুমেরু উচ্চচাপ বলয়,  ও (৭) কুমেরু উচ্চচাপ বলয় ।

আর ৩টি স্থায়ী নিম্নচাপ বলয় হল:- (১) নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়,  (৪) সমেরু বৃত্ত অঞ্চলের নিম্নচাপ বলয় এবং  (৫) কুমেরু বৃত্ত অঞ্চলের নিম্নচাপ বলয় ।

(১) নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয় :- নিরক্ষরেখার উভয় পাশে ১০ অক্ষাংশের মধ্যে এই চাপ বলয় দেখা যায় । এই অঞ্চলে নিম্নচাপ বলয় সৃষ্টির কারণগুলি হল :-

(ক) এখানে সূর্য সারাবছর লম্বভাবে কিরণ দেয় । ফলে এই অঞ্চলের বায়ু অন্যান্য অঞ্চলের বায়ুর থেকে উষ্ণ ও হালকা হয় ।

(খ) এই অঞ্চলে স্থলভাগের চেয়ে জলভাগের পরিমাণ বেশি থাকায়, সূর্যের প্রচন্ড উত্তাপে জল বাষ্পীভূত হয়ে বাতাসের সঙ্গে মিশে থাকে, তাই এই অঞ্চলের বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ অনেক বেশি হয় । জলীয় বাষ্পপূর্ণ বাতাস শুষ্ক বায়ুর চেয়ে হালকা হয় ।  ফলে হালকা বায়ু উপরে উঠে যায় ।

(গ) পৃথিবীর আবর্তন গতির জন্য এই অঞ্চলের ঊর্ধ্বস্তরের উষ্ণ ও আদ্র বায়ু উত্তর ও দক্ষিণ দিকে ছড়িয়ে পড়ে ।

এই সব কারণে নিরক্ষীয় অঞ্চলের উষ্ণ, জলীয় বাষ্পপূর্ণ ও হালকা বায়ুর চাপ কম (নিম্ন) হয় এবং নিম্নচাপের বায়ু হালকা হয় বলে সোজা উপরে উঠে যেতে থাকে । প্রধানত ঊর্ধ্বগামী বলে এই বায়ুর বিভিন্ন দিকে প্রবাহ নেই বললেই চলে । এখানে বায়ু ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে বয়ে চলে না বলে বায়ু প্রবাহ খুব একটা বোঝা যায় না । ফলে এখানে একটি শান্তভাব বিরাজ করে । তাই এই অঞ্চলকে নিরক্ষীয় শান্তবলয় [Eqatorial Belt of Calms বা doldrums] বলা হয় । এখানকার ঊর্ধ্বগামী আদ্র বায়ু প্রচুর পরিচলন বৃষ্টিপাত ঘটায় ।  

(২) ও (৩) কর্কটীয় ও মকরীয় উচ্চচাপ বলয় :- 

(ক) নিরক্ষীয় অঞ্চলে উষ্ণ, আদ্র ও হালকা বায়ু উপরে ওঠে এবং পৃথিবীর আবর্তনের ফলে উত্তর ও দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয় । সেখানে ক্রমশ প্রসারিত, শীতল ও ভারী হয়ে বায়ু দুই ক্রান্তীয় অঞ্চলে (২৫- ৩৫ অক্ষাংশে) নেমে আসে ।  আবার,

(খ) মেরুপ্রদেশ থেকে শীতল ও ভারী বায়ু ভূপৃষ্ঠ বরাবর নিরক্ষরেখার দিকে অগ্রসর হয় । ফলে কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি রেখাদ্বয়ের কাছে বায়ুর চাপ খুব বাড়ে ।

(গ) এই অঞ্চলে বায়ুর গতি থাকে নিম্নমুখী । ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে এই বায়ু বয়ে যায় না । এইজন্য কোনো বায়ুপ্রবাহ পরিলক্ষিত হয় না । ফলে এক শান্তভাব বিরাজ করে । তাই এই অঞ্চল দুটিকে কর্কটীয় ও মকরীয় শান্তবলয় [Tropical Belt of Calms] বলা হয় ।

(ঘ) উপরের শীতল বায়ুস্তর থেকে নীচের উষ্ণতর ভূপৃষ্ঠে নেমে আসার দরুন বায়ু শুকনো হয় । সেই জন্য পৃথিবীর অধিকাংশ মরুভূমি এখানে দেখা যায় ।  

অশ্ব অক্ষাংশ (Horse Latitude) :- উত্তর গোলার্ধে কর্কটক্রান্তি রেখার নিকটবর্তী ২৫ - ৩৫ উত্তর  অক্ষাংশের মধ্যবর্তী অঞ্চলে কর্কটীয় উচ্চচাপ বলয়ের বায়ু নিম্নমুখী হওয়ায় এই অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে কোনো বায়ুপ্রবাহ দেখা যায় না । ফলে এক ধরনের শান্তভাব বিরাজ করে, এই জন্য এই অঞ্চলকে কর্কটীয় শান্তবলয় বলে । আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর বিস্তৃত কর্কটীয় শান্তবলয়ের ৩০ - ৩৫ অক্ষাংশকে অশ্ব অক্ষাংশ বলে । প্রাচীনকালে পালতোলা জাহাজগুলিকে আয়নবায়ুর অভাবে দীর্ঘ সময় কর্কটীয় শান্তবলয়ে (আটল্যান্টিক মহাসাগরে) অপেক্ষা করতে হত । অনেক সময় খাদ্য ও পানীয় জলের সাশ্রয়ের জন্য জাহাজকে হালকা করার উদ্দেশ্যে জাহাজের নাবিকেরা অশ্ব বোঝাই জাহাজ থেকে অশ্ব ও মালপত্র ফেলে দিয়ে কোনো রকমে প্রাণ বাঁচাতে জাহাজ নিয়ে চলে যেত । সেই থেকে উত্তর গোলার্ধের কর্কটীয় শান্ত বলয়ের অন্তর্গত ৩০ - ৩৫  উত্তর অক্ষাংশকে অশ্ব অক্ষাংশ বলা হয় ।

(৪) ও (৫) মেরুপ্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয় (সুমেরুবৃত্ত ও কুমেরুবৃত্ত অঞ্চলের নিম্নচাপ বলয়):- পৃথিবীর আবর্তনের বেগ মেরুদ্বয়ের তুলনায় দুই মেরুবৃত্ত প্রদেশে (৬০- ৬৫ অক্ষাংশে) অনেক বেশি । সেজন্য এই দুই অঞ্চলের বায়ু ক্রান্তীয় অঞ্চলের দিকে বিক্ষিপ্ত হয় । ফলে, মেরুবৃত্ত প্রদেশে বায়ুর ঘাটতি পড়ে ও বায়ুর চাপ হ্রাস পায় এবং বায়ুতে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয় ।

(৬) ও (৭)  মেরুদেশীয় উচ্চচাপ বলয় (সুমেরু ও কুমেরু উচ্চচাপ বলয়) :-  

(ক) দুই মেরুর নিকটবর্তী অঞ্চলের বায়ু অতিরিক্ত শৈত্যের জন্য সর্বদাই শীতল ও ভারী হয় । উপরন্তু

(খ) সূর্যকিরণের অভাবে এখানকার বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কম থাকে । ফলে এখানে উচ্চচাপ বলয়ের সৃষ্টি হয়েছে ।

বায়ুচাপ কক্ষ (Pressure Cell) :- ভূপৃষ্ঠে বায়ুচাপ বলয়গুলি পূর্ব থেকে পশ্চিমে অক্ষাংশ বরাবর প্রসারিত । কিন্তু জলভাগ ও স্থলভাগের অবস্থান সর্বত্র একইভাবে থাকে না । সেজন্য বায়ুচাপ বলয়গুলিও সুনির্দিষ্ট নয় । জলভাগ ও স্থলভাগের মধ্যে তাপমাত্রার পার্থক্যের জন্যে এই চাপ বলয়গুলি এক-একটি বলয় হিসাবে ঠিক থাকে না । ছোট ছোট বায়ুচাপ কক্ষ হিসাবে অবস্থান করে ।

সমচাপ বা সমপ্রেষ রেখা (Isobar Line) :- ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন স্থানে বছরের বিভিন্ন সময়ে বায়ুচাপের তারতম্য লক্ষ করা যায় । উষ্ণতার মতো উচ্চতার পার্থক্যেও বায়ুচাপের তারতম্য হয় । সাধারণত ভূপৃষ্ঠের যে সব জায়গার বায়ুর চাপ সমান, সেই সব জায়গাকে যে কাল্পনিক রেখার সাহায্যে যোগ করা হয় তাকে সমচাপ বা সমপ্রেষরেখা বলে । পৃথিবীপৃষ্ঠের বিভিন্ন স্থানে বায়ুচাপের বিভিন্নতার জন্য আলাদা আলাদা সমচাপ রেখা আঁকা হয় ।

সাধারণভাবে জুলাই ও জানুয়ারী মাসের বায়ুর চাপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পার্থক্য লক্ষ করা যায় । সেই জন্য এই দুটি মাসের মধ্যে বায়ুর চাপের উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর সমপ্রেষরেখা মানচিত্র তৈরি হয় । এই মানচিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, জানুয়ারী মাসে নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয় বা কক্ষগুলি সূর্যের দাক্ষিণায়নের সঙ্গে সঙ্গে নিরক্ষরেখার কিছু দক্ষিণে সরে যায় । আবার জুলাই মাসে সূর্যের উত্তরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয় বা কক্ষগুলি নিরক্ষরেখার কিছু উত্তরে সরে আসে । তবে এই চাপবলয়গুলি সূর্যের মত ২৩½ উত্তরে বা দক্ষিণে সরে না, মাত্রা ৫ বা তার কম সরে । বায়ুচাপ বলয়ের এই স্থান পরিবর্তনের ফলে বায়ু প্রবাহের দিক ও গতি পরিবর্তিত হয় ।  

*****

Related Items

উষ্ণতা হ্রাসের গড় (Lapse rate) কাকে বলে ? উষ্ণমণ্ডল সৃষ্টির কারণ কি ?

প্রশ্ন : উষ্ণতা হ্রাসের গড় (Lapse rate) কাকে বলেউষ্ণমণ্ডল সৃষ্টির কারণ কি ?

দিনের বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীতে তাপের তারতম্য হয় কেন ?

প্রশ্ন : দিনের বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীতে তাপের তারতম্য হয় কেন ?

উত্তর : সকালে এবং বিকালে কোনো স্থান থেকে সূর্য অনেক দূরে থাকে বলে সূর্যরশ্মি

(১) পৃথিবীপৃষ্ঠের সেই স্থানে তুলনামূলক ভাবে বেশি তির্যকভাবে পড়ে,

(২) বেশি পরিমাণ বায়ুস্তর ভেদ করে আসে এবং

পৃথিবীর বিভিন্ন বায়ুচাপ বলয়ের সীমা পরিবর্তনের কারণ ও প্রভাব কী কী ?

প্রশ্ন :- পৃথিবীর বিভিন্ন বায়ুচাপ বলয়ের সীমা পরিবর্তনের কারণ ও প্রভাব কী কী ?

অ্যালবেডো (Albedo) কাকে বলে ?

প্রশ্ন : অ্যালবেডো (Albedo) কাকে বলে ?

বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরে ছিদ্র হলে কী ঘটতে পারে ?

প্রশ্ন:- বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরে ছিদ্র হলে কী ঘটতে পারে ?