মাইটোসিসের দশা (Stages of Mitosis)
মাইটোসিস বিভাজন দুটি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়, যথা: (A) নিউক্লিয়াসের বিভাজন বা ক্যারিওকাইনেসিস এবং (B) সাইটোপ্লাজমের বিভাজন বা সাইটোকাইনেসিস ।
(A) নিউক্লিয়াসের বিভাজন বা ক্যারিওকাইনেসিস:- মাইটোসিসের নিউক্লিয়াসের বিভাজন বা ক্যারিওকাইনেসিস, চারটি দশায় সম্পন্ন হয় । মাইটোসিসের এই দশাগুলি হল [1] প্রফেজ, [2] মেটাফেজ, [3] অ্যানাফেজ এবং [4] টেলোফেজ ।
ক্যারিওকাইনেসিসের সংজ্ঞা:- যে প্রক্রিয়ায় মাতৃকোশের নিউক্লিয়াসটি চার দশার মাধ্যমে বিভাজিত হয়ে দুটি অপত্য নিউক্লিয়াস গঠন করে, তাকে ক্যারিওকাইনেসিস বলে । এক কথায় নিউক্লিয়াসের বিভাজন পদ্ধতি-ই হল ক্যারিওকাইনেসিস ।
ক্যারিওকাইনেসিসের কাজ:-
[i] অপত্য নিউক্লিয়াস সৃষ্টি করা ।
[ii] মাতৃ নিউক্লিয়াসের বৈশিষ্ট্যাবলি অপত্য নিউক্লিয়াসে সঞ্চারিত করা ।
[1] প্রফেজ (Prophase):-
[i] এই দশার প্রারম্ভে নিউক্লিয়াসটি আকার ও আয়তনে বড়ো হয় । এরপর জলবিয়োজনের ফলে নিউক্লিয় জালক বা ক্রোমাটিন সূত্র থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্রোমোজোম সৃষ্টি হয় । পরে প্রতিটি ক্রোমোজোম লম্বালম্বিভাবে বিভক্ত হয়ে দুটি ক্রোমাটিড গঠন করে, এরা সেন্ট্রিমিয়ার অঞ্চলে জোড়ায় জোড়ায় পরস্পরের সঙ্গে পেঁচিয়ে অবস্থান করে ।
[ii] এই পর্যায়ে নিউক্লিওলাস ও নিউক্লিয় পর্দা ক্রমশ বিলুপ্ত হতে থাকে ।
[iii] প্রাণী কোশের ক্ষেত্রে সেন্ট্রিওলটি বিভাজিত হয়ে দুটি অপত্য সেন্ট্রিওল গঠন করে নিউক্লিয়াসের দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে ।
প্রফেজের সংজ্ঞা : মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় নিউক্লিয়াস বিভাজনের যে দশায়
[i] নিউক্লিয় জালিকা থেকে ক্রোমোজোম সৃষ্টি হয়,
[ii] প্রতিটি ক্রোমোজোম লম্বালম্বিভাবে বিভক্ত হয়ে ২টি করে ক্রোমাটিন গঠন করে এবং
[iii] নিউক্লিয় পর্দা ও নিউক্লিওলাসের বিলুপ্তি ঘটতে থাকে, তাকে প্রফেজ বলে ।
প্রফেজের কাজ:-
[i] ক্রোমোজোম সৃষ্টি করা ।
[ii] ক্রোমাটিড গঠন করা ।
[iii] নিউক্লিয় পর্দা এবং নিউক্লিওলাসের বিলুপ্তি ঘটানো ।
[iv] ক্রোমাটিডদ্বয়ের স্পাইরালাইজেশন ঘটানো ।
[2] মেটাফেজ [Metaphase]:-
এই দশার শুরুতে নিউক্লিয় পর্দা এবং নিউক্লিওলাস সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হলে, বেম বা মাকু গঠিত হয় । বেমের উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত বেমতন্তুগুলি বিস্তৃত থাকে । ক্রোমোজোমগুলি বেমের বিষুব অঞ্চলে বেমতন্তুর সঙ্গে সেন্ট্রিমিয়ার দিয়ে আটকে থাকে ।
প্রাণীকোশের বেমতন্তু গঠিত হয় নব গঠিত সেন্ট্রিওলের অ্যাস্ট্রাল রশ্মি থেকে এবং উদ্ভিদ কোশের বেমতন্তু গঠিত হয় সাইটোপ্লাজমীয় তন্তু মাইক্রোটিউবিউল থেকে ।
মেটাফেজের সংজ্ঞা: মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় নিউক্লিয়াস বিভাজনের যে দশায় বেম গঠিত হয় এবং ক্রোমোজোমগুলি বেমের নিরক্ষীয় তলে বিন্যস্ত থাকে, তাকে মেটাফেজ বলে ।
মেটাফেজের কাজ:-
[i] বেমতন্তুসহ বেম বা স্পিণ্ডল গঠন করা ।
[ii] ক্রোমোজোমগুলি বেমের বিষুব অঞ্চলে বেম তন্তু দিয়ে আটকে রাখা ।
[iii] নিউক্লিয় পর্দা এবং নিউক্লিওলাসের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটানো ।
[3] অ্যানাফেজ [Anaphase]:-
এই দশায় ক্রোমোজোমের সেন্ট্রিমিয়ার দু'ভাগে বিভক্ত হওয়ায় ক্রোমাটিডগুলি পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে দুটি অপত্য ক্রোমোজোম গঠন করে । এরপর অপত্য ক্রোমোজোমের অর্ধেক অংশ উত্তর মেরুর দিকে এবং অর্ধেক অংশ দক্ষিণ মেরুর দিকে অগ্রসর হতে থাকে । এই রকম চলনকে ক্রোমোজোমীয় গমন বলে ।
অ্যানাফেজের সংজ্ঞা:- মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় নিউক্লিয়াস বিভাজনের যে দশায় অপত্য ক্রোমোজোমগুলি বেমের দুই বিপরীত মেরুপ্রান্তে পৌঁছায়, তাকে অ্যানাফেজ বলে ।
অ্যানাফেজের কাজ:-
[i] অপত্য ক্রোমোজোম সৃষ্টি ।
[ii] অর্ধেক অপত্য ক্রোমোজোমকে উত্তর মেরু এবং অর্ধেক অপত্য ক্রোমোজোমকে দক্ষিণ মেরুতে পাঠানো ।
[iii] স্টেমবডি গঠন করা ।
[4] টেলোফেজ [Telophase]:-
টেলোফেজ হল মাইটোসিসের শেষ বা চতুর্থ দশা । এই দশার শুরুতে ক্রোমোজোমগুলি বেমের দুই মেরু প্রান্তে পৌঁছুলে তাদেরকে বেষ্টন করে আবার নিউক্লিয় পর্দার আবির্ভাব ঘটে এবং নিউক্লিওলাস পুনর্গঠিত হয় । এই অবস্থায় ক্রোমোজোমগুলি পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে নিউক্লিয় জালক গঠন করে, এর ফলে দুটি অপত্য নিউক্লিয়াস গঠিত হয় ।
টেলোফেজের সংজ্ঞা :- মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় নিউক্লিয়াস বিভাজনের যে দশায় একটি মাতৃ নিউক্লিয়াস থেকে বেমের দুই বিপরীত মেরুতে দুটি অপত্য নিউক্লিয়াস গঠিত হয়, তাকে টেলোফেজ বলে ।
টেলোফেজের কাজ:-
[i] বেমের দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থানকারী ক্রোমোজোমদের ঘিরে নিউক্লিয় পর্দার আবির্ভাব ঘটানো ।
[ii] নিউক্লিওলাসের পুনরাবির্ভাব ঘটানো ।
[iii] দুটি অপত্য নিউক্লিয়াস সৃষ্টি করা ।
(B) সাইটোপ্লাজমের বিভাজন বা সাইটোকাইনেসিস (Cytokinesis)
মাতৃকোশের নিউক্লিয়াস বিভাজনের সঙ্গে সঙ্গে সাইটোপ্লাজমের বিভাজন শুরু হয় । উদ্ভিদ কোশের ক্ষেত্রে অপত্য নিউক্লিয়াস দুটির মাঝখানে কোশপাত [cell plate] গঠিত হয় । কোশপাত গঠনে মাইক্রোটিউবিউল এবং ছোটো ছোটো গলগি ভেসিকল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় । পরে এই কোশপাত কোশপ্রাচীরে রূপান্তরিত হয়, ফলে জনিতৃ কোশটির সাইটোপ্লাজম দু'ভাগে ভাগ হয়ে গিয়ে দু'টি অপত্য কোশসৃষ্টি করে ।
প্রাণীকোশের ক্ষেত্রে নিউক্লিয়াস বিভাজনের পর নবগঠিত নিউক্লিয়াসে দুটির মাঝখান থেকে উভয় দিকের কোশপর্দা ভিতরের দিকে নলাকারে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । ফলে সাইটোপ্লাজম ক্লিভেজ [cleavage] প্রক্রিয়ায় বিভাজিত হয়ে দু'টি অপত্যকোশগঠন করে ।
সাইটোকাইনেসিস সংজ্ঞা: মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় কোশবিভাজনের যে দশায় বিভাজনরত কোশের সাইটোপ্লাজম বিভক্ত হয়ে দুটি অপত্য নিউক্লিয়াসকে এমনভাবে বেষ্টন করে থাকে, যার ফলে দুটি অপত্যকোশের সৃষ্টি হয়, তাকে সাইটোকাইনেসিস বলে ।
সাইটোকাইনেসিসের কাজ :
[i] সাইটোপ্লাজমকে বিভাজিত করা ।
[ii] অপত্যকোশসৃষ্টি করা ।
উদ্ভিদকোশের সাইটোকাইনেসিস ও প্রাণীকোশের সাইটোকাইনেসিস -এর পার্থক্য
উদ্ভিদকোশের সাইটোকাইনেসিস | প্রাণীকোশের সাইটোকাইনেসিস |
১. এটি সেলপ্লেট গঠনের মাধ্যমে ঘটে | ১. এটি ফায়ারিং বা ক্লিভেজ পদ্ধতিতে ঘটে । |
২. দুই নিউক্লিয়াসের মাঝে জমতে থাকা ফ্র্যাগমোপ্লাস্ট কণাগুলি একের পর এক জুড়ে গিয়ে সেলপ্লেট গঠন করে । সেলপ্লেটটি পরে মধ্যচ্ছদায় রূপান্তরিত হয়, আর এরই দু'পাশে সেলুলোজ, পেকটিন ইত্যাদি জমতে থাকায় একসময় প্রাথমিক কোশপ্রাচীর গড়ে ওঠে । এভাবেই মাতৃকোশের সাইটোপ্লাজম সমান দু'ই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় । |
২. দুটি নিউক্লিয়াসের মাঝে বিষুব অঞ্চলের দু'ধার বরাবর দুটি খাঁজের সৃষ্টি হয় । ক্রমে ওই খাঁজ দুটি গভীর হয়ে পরস্পরের দিকে বাড়তে থাকলে এক সময় তারা মিলিত হয় এবং সাইটোপ্লাজমটি দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে ।
|
*****
- 39088 views