কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র (Central Nerve System)
কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র (i) মস্তিষ্ক এবং (ii) সুষুম্নাকান্ড নিয়ে গঠিত । মস্তিষ্কটি করোটির (cranium) মধ্যে সুরক্ষিত থাকে । সুষুম্নাকান্ড মেরুদন্ডের গহ্বরে পৃষ্ঠ মধ্যরেখা বরাবর অবস্থিত । কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রটি একটি ফাঁপা নল বিশেষ । এটি বাইরে থেকে মেনিনজেস (meninges) নামে এক আবরণ দ্বারা আবৃত থাকে । মেনিনজেসে তিনটি স্তর থাকে, যেমন : বাইরের দিক থেকে ভেতরে অবস্থিত এই স্তরগুলি হল যথাক্রমে : ডুরাম্যাটার (Duramater), অ্যারাকনয়েডম্যাটার (arachnoidmater) এবং পিয়াম্যাটার (piamater) । কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের গহ্বরে মস্তিষ্ক-সুষুম্না রস অর্থাৎ সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড (cerebro spinal fluid) নামে একরকম রস থাকে ।
মস্তিষ্ক (Brain)
সংজ্ঞা:- সুষুম্নাকান্ডের অগ্রভাগে অবস্থিত ও করোটির দ্বারা সুরক্ষিত কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের স্ফীত যে অংশটিতে প্রাণীদের বুদ্ধি, চিন্তা, স্মৃতি ইত্যাদি স্নায়বিক আবেগ নিয়ন্ত্রিত হয় তাকে মস্তিষ্ক বলে ।
মানুষের মস্তিষ্কের ওজন প্রায় 1.36 কেজি এবং এতে প্রায় 1000 কোটি স্নায়ুকোষ এবং ততোধিক নিউরোগ্লিয়া থাকে ।
গঠন [Structure]:- মানুষের মস্তিষ্কটি করোটির মধ্যে মেনিনজেস নামে এক পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকে । মানুষের মস্তিষ্ক তিনটি প্রধান অংশে বিভক্ত, যথা : (১) অগ্র মস্তিষ্ক, (২) মধ্য মস্তিষ্ক ও (৩) পশ্চাদ মস্তিষ্ক ।
(১) অগ্র মস্তিষ্ক :- অগ্র মস্তিষ্কটি তিনটি অংশ নিয়ে গঠিত, যথা: (ক) গুরু মস্তিষ্ক, (খ) থ্যালামাস এবং (গ) হাইপোথ্যালামাস ।
(ক) গুরু মস্তিষ্ক:- গুরু মস্তিষ্ক হল মস্তিষ্কের সবচেয়ে বড় অংশ এবং করোটির প্রায় বেশির ভাগ অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত । এর বাইরের দিকে অসংখ্য খাঁজ (সালকাস) এবং ভাঁজ (জাইরাস) দেখা যায় । গুরু মস্তিষ্কটি একটি গভীর খাঁজ দিয়ে দুটি গোলার্ধে অর্থাৎ ডান ও বাম সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ারে বিভক্ত থাকে । এই গোলার্ধ দুটি করপাস ক্যালোসাম নামে একটি প্রশস্ত স্নায়ু-যোজক দিয়ে পরস্পর যুক্ত থাকে । গুরু মস্তিষ্ক পাঁচটি খন্ডে বিভক্ত, যথা: অগ্র খন্ড, মধ্য খন্ড, পশ্চাদ খন্ড, এবং দুটি পার্শ্ব খন্ড । এগুলিকে ফ্রন্টাল, প্যারাইটাল টেম্পোরোল, অক্সিপিটাল ও লিম্বিক লোব বলে । গুরু মস্তিষ্কের বহির্ভাগ ধুসর পদার্থ এবং অন্তর্ভাগ শ্বেত পদার্থ দিয়ে গঠিত ।
কাজ:- গুরু মস্তিষ্ক
(i) চাপ, তাপ, ব্যথা, ইত্যাদি স্পর্শবোধ;
(ii) ভয়, আনন্দ প্রভৃতি চেতনাবোধ এবং
(iii) স্মৃতি, চিন্তা, বুদ্ধি প্রভৃতি উন্নত মানসিক বোধ নিয়ন্ত্রণ করে ;
(iv) মানবদেহের বিভিন্ন অংশের নানা শারীরবৃত্তীয় কাজের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে এবং
(v) মানুষের বিভিন্ন সহজাত প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করে ।
(খ) থ্যালামাস:- গুরু মস্তিষ্কের নীচে অবস্থিত এবং ধূসর পদার্থ দিয়ে গঠিত অংশকে থ্যালামাস বলা হয় ।
কাজ:- এটি মানুষের ক্রোধ, লজ্জা বেদনা, ইত্যাদি মানসিক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে ।
(গ) হাইপোথ্যালামাস:- থ্যালামাসের নীচে অবস্থিত এবং শ্বেত ও ধূসর পদার্থ দিয়ে গঠিত অংশকে হাইপোথ্যালামাস বলে ।
কাজ:- এটি মানসিক আবেগ ও ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণ করে । এছাড়া নিদ্রা ও জাগ্রত অবস্থার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানও হাইপোথ্যালামাসের অন্যতম প্রধান কাজ ।
(২) মধ্য মস্তিষ্ক:- অগ্র ও পশ্চাদ মস্তিষ্কের মাঝখানে মধ্য মস্তিষ্ক অবস্থিত । এর প্রধান অংশগুলি হল
(ক) ক্রুরা সেরিব্রাই,
(খ) টেগমেনটাম এবং
(গ) টেকটাম ।
কাজ:- এই অংশটি দর্শন ও শ্রবণ নিয়ন্ত্রণ করে ।
(৩) পশ্চাদ মস্তিষ্ক:- পশ্চাদ মস্তিষ্কটি তিনটি অংশ নিয়ে গঠিত, যথা: (ক) লঘু মস্তিষ্ক, (খ) পনস বা যোজক এবং (গ) সুষুম্নাশীর্ষক ।
(ক) লঘু মস্তিষ্ক:- এটি সুষুম্নাশীর্ষক ও পনসের পিছনে এবং পশ্চাদ করোটির খাঁজে অবস্থিত । লঘু মস্তিষ্কটি দুটি গোলার্ধে বিভক্ত থাকে । এই গোলার্ধ দুটি ভারমিস নামে একটি যোজক দিয়ে যুক্ত থাকে ।
কাজ:- লঘু মস্তিষ্ক মানবদেহের ভারসাম্য রক্ষা করে ।
(খ) পনস বা যোজক:- মধ্য মস্তিষ্ক এবং সুষুম্নাশীর্ষকের মাঝখানে অবস্থিত অংশকে পনস বা যোজক বলে ।
কাজ:- মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সমন্বয়সাধন করা হল পনস বা যোজকের প্রধান কাজ ।
(গ) সুষুম্নাশীর্ষক:- এটি পনসের পরবর্তী অংশ এবং সুষুম্নাকান্ডের অগ্রভাগে অবস্থিত । এটি মস্তিষ্কের সবচেয়ে নীচের অংশ ।
কাজ:- হৃদস্পন্দন, শ্বাসক্রিয়া, খাদ্যগ্রহণ, লালা ও ঘর্ম নিঃসরণ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা হল সুষুম্নাশীর্ষকের প্রধান কাজ ।
গুরু মস্তিষ্ক ও লঘু মস্তিষ্কের পার্থক্য
বৈশিষ্ট্য | গুরু মস্তিষ্ক | লঘু মস্তিষ্ক |
১.অংশবিভেদ | গুরুমস্তিষ্ক হল অগ্র মস্তিষ্কের অংশ । | লঘু মস্তিষ্ক হল পশ্চাদ মস্তিষ্কের অংশ । |
২.অবস্থান | গুরু মস্তিষ্ক আকারে বড় এবং এই মস্তিষ্ক করোটির অধিকাংশ অঞ্চল জুড়ে থাকে । | লঘু মস্তিষ্ক অপেক্ষাকৃত ছোট এবং পশ্চাদ করোটির খাঁজে অবস্থিত । |
৩.যোজক | গুরু মস্তিষ্কের গোলার্ধ দুটি করপাস ক্যালোসাম নামে যোজক দিয়ে যুক্ত থাকে । | লঘু মস্তিষ্কের গোলার্ধ দুটি ভারমিস নামে যোজক দিয়ে যুক্ত থাকে । |
৪.খন্ড | গুরু মস্তিষ্কটি পাঁচটি খন্ডে বিভক্ত, যেমন : একটি করে অগ্র, মধ্য ও পশ্চাদ খন্ডক এবং দুটি পার্শ্ব খন্ডক । | লঘু মস্তিষ্কে এই ধরনের খন্ড থাকে না । |
৫.কাজ | গুরু মস্তিষ্কের প্রধান কাজ হল প্রাণীদের চিন্তা, বুদ্ধি, স্মৃতি ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা । | লঘু মস্তিষ্কের প্রধান কাজ হল প্রাণীদেহের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করা । |
সুষুম্নাকান্ড (Spinal Cord)
উপাদান [Components]:- সুষুম্নাকান্ডটি সুষুম্নাশীর্ষক থেকে শুরু হয়ে মেরুদন্ডের গহ্বরের পৃষ্ঠ- মধ্যরেখা বরাবর প্রথম লাম্বার কশেরুকা পর্যন্ত বিস্তৃত । মানুষের সুষুম্নাকান্ডটি 18 ইঞ্চি বা 45 সেন্টিমিটারের মতো লম্বা । প্রতি কশেরুকার সংযোগস্থলে সুষুম্নাকান্ডটি খাঁজবিশিষ্ট হয়েছে, সুষুম্নাকান্ডটি অনেকগুলি খন্ডক (31টি) নিয়ে গড়ে উঠেছে । প্রতি খন্ডক থেকে একজোড়া করে সুষুম্নীয় স্নায়ুর (spinal nerves) উদ্ভব হয়েছে । সুষুম্নাকান্ডের অঙ্কদেশে একটি অঙ্কীয় স্নায়ু খাঁজ (ventral fissure) এবং পৃষ্ঠদেশে একটি পৃষ্ঠীয় স্নায়ু খাঁজ (dorsal fissure) সুষুম্নাকান্ডকে দুটি প্রতিসম অংশে বিভক্ত করেছে । সুষুম্নাকান্ডের ভেতরের অংশ ধূসর পদার্থ এবং বাইরের অংশ শ্বেত পদার্থ দিয়ে গঠিত । প্রতি অর্ধাংশের ধূসর বস্তু দুটি শৃঙ্গে বিভক্ত । এদের যথাক্রমে সম্মুখ স্নায়ু শৃঙ্গ এবং পশ্চাদ স্নায়ু শৃঙ্গ বলে । প্রতিটি সুষুম্না স্নায়ু কশেরুকা গহ্বরে প্রবেশ করে দুভাগে বিভক্ত হয়ে পৃষ্ঠমূল এবং অঙ্কমূল রূপে প্রতিটি সুষুম্না খন্ডকের একটি অর্ধাংশের সঙ্গে যুক্ত থাকে । সুষুম্নাকান্ডের গহ্বরটিকে নিউরোসিল (neurocoel) বলে । এই গহ্বরের মধ্যে সেরিব্রো-স্পাইনাল তরল থাকে ।
কাজ:- সুষুম্নাকান্ড অ্যাফারেন্ট (অন্তর্বাহী) ও ইফারেন্ট (বহির্বাহী) স্নায়ুর সাহায্যে দেহের বিভিন্ন যন্ত্রের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে এবং সরল প্রতিবর্ত ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে ।
*****
- 18479 views