অভিব্যক্তির তত্ত্বাবলি ও ল্যামার্কের তত্ত্ব

Submitted by arpita pramanik on Fri, 12/21/2012 - 15:48

অভিব্যক্তির তত্ত্বাবলি (Theories of Evolution)

অভিব্যক্তির ফলে নতুন প্রজাতির অথবা একটি প্রজাতি থেকে অন্য একটি প্রজাতির উত্পত্তি হয় । অভিব্যক্তির কৌশল সম্পর্কে যেসব বিজ্ঞানী বিভিন্ন তত্ত্বাবলি [theories] প্রতিষ্ঠিত করেছেন তাঁদের মধ্যে ল্যামার্ক এবং ডারউইনের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য । এখানে অভিব্যক্তির বিভিন্ন তত্ত্বাবলি সংক্ষেপে আলোচনা করা হল ।

ল্যামার্কের তত্ত্ব [Theory of Lamarck]:-  ল্যামার্ক সর্বপ্রথম অভিব্যক্তির ওপর বিশ্লেষণী তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন এবং বিষয়টি 1809 খ্রিস্টাব্দে তাঁর লেখা 'ফিলোসফিক জুওলজিক' নামে একটি বইতে লিপিবদ্ধ করেন । ল্যামার্কের তত্ত্বকে ল্যামার্কিজম বা ল্যামার্কবাদ বলে । কয়েকটি প্রধান প্রতিপাদ্যের ওপর ভিত্তি করে ল্যামার্কবাদ গঠিত হয়েছে । অভিব্যক্তি সম্পর্কে ল্যামার্কের মতবাদের প্রতিপাদ্য বিষয়গুলো আলোচনা করা হল :

[1] ব্যবহার ও অব্যবহারের সূত্র [Law of use and disuse]:-  ল্যামার্কের মতে, জীবের প্রয়োজনে জীবদেহে কোনও নতুন অঙ্গের উত্পত্তি অথবা কোনও পুরানো অঙ্গের অবলুপ্তি ঘটতে পারে । তাঁর মতে, যদি কোনও জীবের কোনও অঙ্গ ধারাবাহিকভাবে ক্রমাগত ব্যহৃত হয়, তবে সেই অঙ্গ পরিবেশের প্রয়োজনীয়তার জন্য ধীরে ধীরে সবল ও সুগঠিত হবে । অন্যদিকে, জীবের কোনও অঙ্গ পরিবেশের পক্ষে অপ্রয়োজনীয় হলে ওই অঙ্গের আর ব্যবহার থাকে না —সুতরাং ক্রমাগত অব্যবহারের ফলে অঙ্গটি নিস্ক্রিয় অঙ্গে পরিণত হবে এবং অবশেষে অবলুপ্ত হয়ে যাবে । ল্যামার্কের মতে অঙ্গের ব্যবহার ও অব্যবহার জীবদেহে পরিবর্তন সূচিত করে, যা জীবের বংশপরম্পরায় অর্জিত বৈশিষ্ট্য ।

[2] পরিবেশের প্রভাব এবং জীবের সচেষ্টতা [Efforts]:-  সদা পরিবর্তনশীল পরিবেশে জীব নিজেকে উপযুক্তরূপে মানিয়ে নেবার জন্য সব সময় চেষ্টা করে । এটি জীবের একটি সহজাত প্রবৃত্তি । স্বাভাবিকভাবে পরিবর্তনশীল পরিবেশে নিজেকে অভিযোজিত করতে জীবদেহে নানা রকম পরিবর্তন দেখা যায় ।  ল্যামার্কের মতে, জীব সজ্ঞানে, নিজের চেষ্টায় বিশেষ কোনও অঙ্গের বৃদ্ধি অথবা ক্ষয় করে বিবর্তনের ধারা পরিবর্তন করতে পারে । এটাও একটি জীবের অর্জিত বৈশিষ্ট্য ।

[3]  অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ [Inheritance of acquired characteris]:-  ল্যামার্কের মতে, কোনও জীবের জীবনকালে যে সমস্ত বৈশিষ্ট্য অর্জিত হয়, সেই সমস্ত বৈশিষ্ট্য এক জনু থেকে অপর জনুতে সঞ্চারিত হয়, অর্থাৎ অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ ঘটে ।

[4]  নতুন প্রজাতির উত্পত্তি [Origin of new species]:-  ল্যামার্কের তত্ত্ব অনুযায়ী অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণের জন্য এবং প্রতিটি জনুতে নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য অর্জিত হওয়ায় ধীরে ধীরে একটি প্রজাতি থেকে অপর একটি নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয় ।

 

ল্যামার্কের মতবাদের স্বপক্ষে উদাহরণ (Examples in favour of Lamarckism)

[১] ক্রমাগত জলে সাঁতার কাটার ফলে জলজ পাখির পা, পায়ের আঙ্গুলের অন্তর্বর্তী স্থানগুলো পাতলা চামড়া দ্বারা সংযুক্ত হওয়ায় লিপ্তপদে পরিণত হয়েছে ।

[২] সাপের পূর্বপুরুষদের গিরগিটির মতো চারটে পা ছিল, কিন্তু ভূগর্ভ অভিযোজনের জন্য পায়ের ক্রমাগত অব্যবহারের ফলে বর্তমানে ওই বৈশিষ্ট্যটি সম্পূর্ণরূপে লুপ্ত হয়েছে ।

[৩] উটপাখির পূর্বপুরুষদের সক্রিয় ডানা ছিল এবং তারা আকাশে উড়তে পারত , কিন্তু বংশানুক্রমে ডানার ব্যবহার না থাকায় সেটি এখন লুপ্তপ্রায় অঙ্গে পরিণত হয়েছে ।

[৪]  ল্যামার্কের মতে, জিরাফের সুদীর্ঘ গ্রীবা, খুব উঁচু গাছ থেকে পাতা সংগ্রহের জন্য, অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণের ফলেই ঘটেছে ।

উদবংশীয় জিরাফ খর্ব গ্রীবাযুক্ত এবং স্বভাবগত তৃণাচারী [grazing] প্রাণী ছিল । এই ধরনের প্রাণীর পরিবেশে তৃণ ও বীরুৎজাতীয় উদ্ভিদদের ক্রমশ ঘাটতি ঘটায়, তারা অপেক্ষাকৃত উঁচু গাছের পাতা খেতে শুরু করে । উঁচু গাছের পাতা নাগাল পাওয়ার জন্য উদবংশীয় জিরাফের গ্রীবা ও অগ্রপদ দুটি লম্বা হতে থাকে । দেহের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনে গ্রীবার ক্রমপ্রসারণের ফলে অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণের মাধ্যমে খর্ব গ্রীবাযুক্ত উদবংশীয় জিরাফ থেকে বর্তমানকালের দীর্ঘ গ্রীবাযুক্ত জিরাফের উৎপত্তি ঘটে । 

ল্যামার্কের মতবাদের বিপক্ষে পরীক্ষা (Experiments against Lamarckism)

[1]  বিজ্ঞানী ভাইসম্যান [Weismann]:- ল্যামার্কের মতবাদকে তার ইঁদুরের ওপর পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে নাকচ করে দেন । তিনি একজোড়া ইঁদুর দম্পতির লেজ কেটে দেন । তাদের সন্তান জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে সন্তানগুলিরও লেজ কেটে দেন । এইভাবে 35 জনু [generation] ধরে ইন্দুরের লেজ কাটা সত্ত্বেও তিনি একটিও লেজবিহীন ইঁদুর জন্মাতে দেখেন নি এবং স্বাভাবিক কারণেই ল্যামার্কের তত্ত্বকে অস্বীকার  করেন ।

[2]  ড্রসোফিলা [Drosophila]:- মাছিকে পরপর 60 জনু ধরে সম্পূর্ণ অন্ধকার ঘরে জনন কার্য পরিচালনা করা সত্ত্বেও তাদের কেউই দৃষ্টিশক্তিহীন হয়ে জন্মগ্রহণ করে নি ।

*****

Related Items

চক্ষু বা চোখ (Eye)

যে বিশেষ অঙ্গের দ্বারা প্রাণীরা পরিবেশ থেকে আলোকজাত উদ্দীপনা গ্রহণ করে এবং বহির্জগতের দৃশ্য দেখতে পায়, তাকে চোখ বলে । চক্ষু বা চোখ হল আমাদের দর্শনেন্দ্রিয় । আমাদের চোখ দুটি মস্তিষ্কের সম্মুখভাগে অক্ষিকোটরে অবস্থিত । প্রতিটি চোখ একটি অক্ষিগোলক, একজোড়া অক্ষিপল্লব ...

প্রতিবর্ত চাপ বা রিফ্লেক্স আর্ক

যে স্নায়ুপথে প্রতিবর্ত ক্রিয়ার স্নায়ুস্পন্দন আবর্তিত হয়, তাকে প্রতিবর্ত চাপ বা রিফ্লেক্স আর্ক বলে । প্রতিবর্ত চাপ সাধারণত তিনটি স্নায়ুকোষ দ্বারা গঠিত । তবে দুই অথবা বহু স্নায়ুকোষের সমন্বয়েও প্রতিবর্ত চাপ গঠিত হাতে পারে । প্রতিবর্ত চাপে সাইন্যাপস অর্থাৎ স্নায়ু-সন্নিধির অবস্থান অনুযায়ী ...

প্রতিবর্ত ক্রিয়া (Reflex action)

প্রাণীদেহে নির্দিষ্ট উত্তেজনার প্রভাবে যে তাত্ক্ষনিক, স্বতঃস্ফুর্ত ও অনৈচ্ছিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, তাকে প্রতিবর্ত ক্রিয়া বলে । প্রতিবর্ত ক্রিয়ার দুটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল- এই ক্রিয়া অনৈচ্ছিক এবং এটি সুষুম্নাকান্ড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত । সুতরাং সুষুম্নাকান্ড দিয়ে নিয়ন্ত্রিত প্রাণীদের অনৈচ্ছিক ...

স্নায়ু সন্নিধি ও স্নায়ুগ্রন্থি

সাইন্যাপস্ বা প্রান্তসন্নিকর্ষ হল দুটি নিউরোনের সংযোগস্থল, যেখানে একটি নিউরোনের অ্যাক্সনের প্রান্ত এবং অন্য একটি নিউরোনের ডেনড্রাইটের প্রান্ত খুব কাছাকাছি থাকে কিন্তু কখনই স্পর্শ করে না, মাঝে একটি আনুবীক্ষণিক ফাঁক থেকেই যায়, আর এর মধ্য দিয়েই নিউরোহিউমর নামে তরলের ...

স্নায়ু ও স্নায়ুর কাজ

যোগ কলার আবরণবেষ্টিত স্নায়ুতন্তুকে সাধারণ ভাবে স্নায়ু বা নার্ভ বলে । স্নায়ুতন্তুর চারদিকে যে যোগ কলার আবরণ থাকে তাকে এন্ডোনিউরিয়াম বলে । এন্ডোনিউরিয়াম-আবরণযুক্ত কয়েকটি স্নায়ুতন্তু আবার পেরিনিউরিয়াম নামক আবরণ দ্বারা আবৃত থাকে । মোটা ও বড় স্নায়ুর ক্ষেত্রে কয়েকটি ...