মুঘল যুগে ভারতের আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য

Submitted by avimanyu pramanik on Wed, 10/29/2014 - 10:08

মুঘল যুগে ভারতের আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য :

আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য : মুঘল আমলে দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়, রাস্তাঘাট ও সরাইখানা নির্মাণ এবং পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে আভ্যন্তরীণ ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল । তা ছাড়া উন্নত মুদ্রানীতি এবং নগদে বেতন প্রদানের ফলে একদিকে যেমন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় টাকা পাঠান সহজ ছিল, অন্যদিকে তেমনই স্বল্প সুদে ঋণদানের ব্যবস্থাও ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসারে সহায়ক হয়েছিল । এই সময় বিমা ব্যবস্থা চালু থাকার ফলে ব্যবসায়ীরা উপকৃত হত । মুঘল আমলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে নানা স্তরবিন্যাস ছিল । পাইকারি ব্যবসায়ীদের বলা হত শেঠ বা বাহারা । আর খুচরো ব্যবসায়ীদের বলা হত বণিক বা ব্যাপারী । এছাড়া বনজারা নামে আর এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ছিল, যারা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে জিনিস পত্র বিক্রি করতো । হুন্ডির সাহায্যে পণ্য লেনদেন হতো এবং হুন্ডি ও অন্যান্য ব্যাংক-ব্যবসা জাতীয় কাজকর্মের দায়িত্ব ছিল স্রফ বা সরাফদের হাতে । ব্যবসায়ী সম্প্রদায় যথেষ্ট ধনী ছিল । দেশের আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ছাড়া স্থানীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেখা যায় শহরগুলি গ্রামে উৎপাদিত দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল । প্রত্যেক এলাকার জন্য একটি নির্দিষ্ট দিনে বাজার বসত । সেখানে বেচা কেনা চলত । একে হাট বা পেঠ বলা হত । টেভার্নিয়ে এই ধরনের অসংখ্য হাটের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন । তা-ছাড়া গ্রামে ও শহরে ফেরিওয়ালারা নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র গৃহস্থদের বাড়ি পৌঁচ্ছে দিত ।

অর্ন্তবাণিজ্য চলত দুভাবে— (১) অর্ন্তদেশীয় বাণিজ্য, অর্থাৎ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ও (২) উপকূল ধরে সামুদ্রিক বাণিজ্য । অর্ন্তদেশীয় বাণিজ্য চলত স্থলপথ ও নদীপথ উভয় ভাবেই । অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের জন্য দেশের যেসব রাজপথ ব্যবহৃত হত, তার সঙ্গে আর্ন্তজাতিক বাণিজ্য পথের যোগ ছিল । উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে এই ধরনের বেশ কিছু রাস্তা ছিল । দক্ষিণ ভারতের রাজপথগুলি আবার উপকূলবর্তী শহরের সঙ্গে যুক্ত ছিল । প্রধান নদীপথ ছিল দুটি — (ক) মুলতান থেকে সিন্ধু নদ ধরে একেবারে সমুদ্র পর্যন্ত ও (খ) গঙ্গা দিয়ে পাটনা হয়ে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত । গঙ্গার ধার ধরে বেশ কিছু বাণিজ্য শহর গড়ে উঠেছিল । সারা দেশে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল, তাদের মধ্যে উত্তর ভারতে শ্রীপুর, সাতগাঁ, হুগলী, ঢাকা, কলকাতা, পাটনা, বারাণসী, লখনউ, আগ্রা, দিল্লি, মুলতান, লাহোর, কাবুল, কান্দাহার, আহমদাবাদ, সুরাট ও দক্ষিণ ভারতের বুরহানপুর, গোলকুণ্ডা ও মসুলিপত্তম বিখ্যাত । এইসব বাণিজ্য পথ ও শহর ধরে দেশের ঘাটতি অঞ্চলে জিনিসপত্র পাঠান হত । যেমন, বাংলা থেকে চাল, চিনি ও মাখন পাঠানো হত আগ্রায় । বাংলা ও ওড়িশা থেকে নিকৃষ্ট ধরনের চাল যেত  মসুলিপত্তমে । বাংলায় আসত রাজস্থানের লবণ । পাটনা থেকে নদী পথে বাংলায় আসত গম ও উৎকৃষ্ট মানের চাল । মালব, রাজপুতানা ও উত্তর ভারত থেকে খাদ্যশস্য আসত গুজরাটে । তা-ছাড়া সমুদ্র উপকূল ধরে দাক্ষিণাত্য, গান্ডোয়ানা ও মালাবার থেকেও গুজরাটে খাদ্যশস্য আসত । অন্যদিকে গুজরাটের রেশম শিল্পের জন্য কাঁচামাল আসত বাংলা থেকে । তেমনই সুরাট, বুরহানপুরের তুলোর ওপর বাংলার বস্ত্রশিল্প নির্ভরশীল ছিল । ভারতের সর্বত্র বাংলার চিনির কদর ছিল । নদীপথে ওই চিনি পাঠান হত আগ্রায় এবং সমুদ্র পথে ভারতের সর্বত্র । অন্তর্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আগ্রা শহরটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ । এই শহরটি উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের কেন্দ্র ছিল । উপকূল ধরে যে বাণিজ্য চলত, তাতে দেখা যায় বিজয়নগর ও গোলকুণ্ডা থেকে বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী বাংলা ও গুজরাটে পাঠানো হত । উপকূলীয় বাণিজ্যে চেট্টি ব্যবসায়ীদের আধিপত্য ছিল । পূর্ব উপকুলে বাংলা ও ওড়িশার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল । বাংলা থেকে করমণ্ডল উপকূল হয়ে কোঙ্কন ও গুজরাটের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল । বাংলার চালের ওপর অনেকেই নির্ভরশীল ছিল । বাংলার খাদ্য আসতে দেরি হলে খাদ্যাভাব দেখা দিত । ওড়িশা থেকে রপ্তানি হত তেল । উপকুলের বাণিজ্য কিন্তু সব সময় নিরাপদ ছিল না । জলদস্যুর উৎপাত ছিল ।

মুঘল যুগে যে সব বিদেশী বণিক ব্যবসাবাণিজ্যের জন্য আসত, তাদের মধ্যে অনেকেই ভারতের আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে অংশ নিত । কোম্পানির আওতার বাহিরে তারা ব্যক্তিগত ভাবে এই বাণিজ্যে অংশ নিত । এই সব বিদেশি বণিক অনেক সমর নিজেদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নানভাবে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করত । আবার অনেক সময় তারা কোম্পানির জাহাজে দেশীয় বণিকদের মালপত্র বহন করত । এই সব দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে প্রায়ই মুঘল সরকারের সঙ্গে তাদের বিরোধ ঘটত । সপ্তদশ শতকে এইসব বিরোধ তীব্র আকার ধারণ না করলেও পরবর্তী যুগে কিন্তু এই ধরনের বিরোধ এক তীব্র সংকটের সৃষ্টি করেছিল ।

*****

Related Items

ভারতের ইতিহাসে ভৌগোলিক উপাদানের প্রভাব

ভারতের ইতিহাসে হিমালয় পর্বতের প্রভাব, ভারতের ইতিহাসে হিমালয় পর্বতের বিভিন্ন গিরিপথের প্রভাব, ভারতের ইতিহাসে বিন্ধ্য পর্বতের প্রভাব, ভারতের ইতিহাসে নদনদীর প্রভাব, ভারতের ইতিহাসে সমভূমির প্রভাব, ভারতের ইতিহাসে সমুদ্রের প্রভাব ...

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য

সাধারণভাবে হিমালয় থেকে দক্ষিণে বিন্ধ্যপর্বত পর্যন্ত্য অংশকে আর্যাবর্ত বা উত্তরাপথ ও বিন্ধ্যপর্বত থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত্য অংশকে দাক্ষিণাত্য বা দক্ষিনাপথ বলা হয় । ভু-প্রকৃতির বৈশিষ্ট অনুসারে দেশকে পাঁচটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে । ...

ভারতবর্ষ নামকরণের ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা

ভারতবর্ষের নামকরণ সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত প্রচলিত আছে । যেমন -পৌরাণিক যুগের সাগর বংশের সন্তান রাজা ভরতের নাম থেকে আমাদের দেশের নামটি এসেছে ভারত বা ভারতবর্ষ । বিষ্ণু পুরাণে বলা হয়েছে মহাসাগরের উত্তরে এবং বরফে ঢাকা পাহাড়ের দক্ষিণে অর্থাৎ হিমালয়ের ...

প্রতিবাদী আন্দোলন (Protest Movement)

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে প্রচলিত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতি অনেক মানুষ ভক্তি, শ্রদ্ধা ও আস্থা হারিয়ে ফেলে । ফলে এই শতাব্দীতে ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরুদ্ধে কয়েকটি প্রতিবাদী আন্দোলন ঘটে এবং নতুন নতুন ধর্মমতের উদ্ভব হয় । এর মধ্যে বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্ম প্রধান ।

আর্যদের পরিচয় (Coming of The Aryans)

আর্যদের বসতি বিস্তার, ঋকবেদের আলোকে আর্য জনজীবন, রাজনৈতিক জীবন, সামাজিক জীবন, পোশাক পরিচ্ছদ, সামাজিক কাঠাম, আর্যদের অর্থনৈতিক জীবন, কৃষি ও পশুপালন, ব্যবসাবাণিজ্য, শিল্প , আর্যদের ধর্মজীবন, পরবর্তী বৈদিক যুগে আর্য জনজীবনে পরিবর্তন ...