ইউরোপীয় বণিক ও ভারতের শাসকশ্রেণি :
ইউরোপীয় বণিকদের কার্যকলাপ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় মুঘল সম্রাটরা সাধারণভাবে ইউরোপীয় বণিকদের বিরোধিতা করতেন না, বরং যতদূর সম্ভব সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করে দিতেন । তাঁরা ইউরোপীয়দের প্রতি কোনো রকম বৈষম্যমূলক আচরণ করতেন না । তবে বিদেশি বণিকরা যাতে অধিকারের সীমানা ছাড়িয়ে না যায়, সেদিকে তাঁদের কড়া নজর ছিল । কাজেই বিদেশি বণিকরা মাঝে মাঝে বাড়াবাড়ি করবার চেষ্টা করলেও সফল হয়নি । বিদেশি বণিকদের প্রতি তাঁদের নীতি ছিল একান্তই বাস্তববাদী ।
অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে আঞ্চলিক রাজন্যবর্গের সঙ্গে ইউরোপীদের সম্পর্ক : মুঘল সাম্রাজ্য যখন গৌরব শীর্ষে, তখন ইউরোপীয় বণিকেরা তাদের ব্যবসাবাণিজ্য প্রসারের উদ্দেশ্যে মুঘল সম্রাট ও স্থানীয় শাসকদের কৃপাপ্রার্থী ছিল । তাদের মধ্যে রেষারেষি ও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল এবং নানা ভাবে স্থানীয় শাসকদের কাছ থেকে সুযোগসুবিধা আদায়ের জন্য উদ্যোগী ছিল । ভারতের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করা বা অংশ গ্রহণ করবার বাসনা ও স্পর্ধা তাদের ছিল না । অষ্টাদশ শতকের গোড়ায় অবস্থার পরিবর্তন ঘটে । এই সময় মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ঘনিয়ে আসে । প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ঐক্য ভেঙ্গে পড়ে । দিকে দিকে আঞ্চলিক শক্তির উদ্ভব ঘটে । চতুর্দিকের নৈরাজ্য ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ব্যবসাবাণিজ্যের সহায়ক ছিল না । এই অরাজকতার সুযোগ নিয়ে শেষ পর্যন্ত ইংরেজরা ভারতে তাদের সাম্রাজ্য স্থাপনে সফল হয়েছিল ।
বাংলা : অষ্টাদশ শতকের গোড়াতেই বাংলায় মুরশিদকুলি খানের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক শক্তির উদ্ভব ঘটেছিল এবং প্রধানত এখানেই ইউরোপীয় বণিকদের সঙ্গে নবাবদের যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তারই পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত বাংলা তার স্বাধীনতা হারায় । অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে মুরশিদকুলি খান, সুজা-উদ-দৌলা এবং আলিবর্দি খানের নেতৃত্বে বাংলায় দীর্ঘদিন সুখ ও শান্তি বিরাজিত ছিল এবং তাঁরা একটি সুদৃঢ় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে ও ইউরোপীয় বণিকদের ব্যবসাবাণিজ্যে উৎসাহ প্রদান করে বাংলার ইতিহাসে এক নবযুগের সূত্রপাত করেন । অষ্টাদশ শতকের গোড়ায় বাংলায় ইংরেজ, ফরাসি ও ওলন্দাজ বণিকেরা সক্রিয় ছিল । বাংলাতে ব্যবসায়ে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল । ভারতের মধ্যে বাংলাই ছিল তখন সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী অঞ্চল । এখনকার সূক্ষ্ম মসলিন বস্ত্রের খ্যাতি ছিল জগৎজোড়া । অন্যান্য সম্পদেও বাংলা সমৃদ্ধশালী ছিল । তাই বাংলার ব্যবসায়ে প্রতিটি বিদেশি বাণিজ্যিক সংস্থা আগ্রহী ছিল । বাংলার নবাবরাও তাদের বাণিজ্যে উৎসাহ দিতেন, কারণ এর ফলে বাংলায় প্রচুর অর্থাগম হচ্ছিল । বাংলার আর্থিক প্রগতির কথা চিন্তা করেই তাঁরা বিদেশি বণিকদের কার্যকলাপে উৎসাহ দিতেন । কিন্তু তাঁরা কাউকে আলাদা করে পক্ষপাতিত্ব করবার বিরোধী ছিলেন । তাঁরা সমস্ত বিদেশি বণিকদের সমান চোখে দেখতেন ।
ইংরেজরা ছিল সুচতুর এবং সুযোগসন্ধানী । ফরাসি ও ওলন্দাজ ব্যবসায়ীদের পিছনে ফেলে নিজেদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলাই ছিল তাদের লক্ষ্য । এই জন্য তারা কিছু অতিরিক্ত সুযোগসুবিধার প্রত্যাশী ছিল । কিন্তু তারা জানত মুরশিদকুলি খান এই অতিরিক্ত সুযোগসুবিধা কখনই দেবেন না । তাই তারা এই উদ্দেশ্যে সুরমানের নেতৃত্বে মুঘল সম্রাট ফারুকশিয়ারের কাছে এক দৌত্য প্রেরণ করে । কিন্তু তাতে সহজে কার্যোদ্ধার হয়নি । ধৈর্যের পরীক্ষায় ইংরেজরা তখনই উত্তীর্ণ হন যখন ডঃ হ্যামিলটন নামে এক জনৈক চিকিৎসক মুঘল সম্রাটের এক দুরারোগ্য ব্যাধির উপশম করতে সক্ষম হন । কৃতজ্ঞ সম্রাট ১৭১৭ খ্রীষ্টাব্দে এক ফরমান বা হুকুমনামা জারি করে বাংলায় মাত্র ৩,০০০ টাকার বিনিময়ে ইংরেজদের বিনা শুল্কে বাণিজ্য করবার অনুমতি দেন । এ ছাড়াও তারা আরও কয়েকটি সুযোগসুবিধা লাভ করেন । বাংলায় ব্রিটিশ বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধির ইতিহাসে এই ফরমানের গুরুত্ব অসাধারন । এর ফলে কেবল তাদের বাণিজ্যের পরিমাণই বহু গুণে বৃদ্ধি পায়নি, অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকেরা তাদের থেকে অনেক পিছিয়ে পড়েছিল । কিন্তু মুরশিদকুলি খান বা আলিবর্দিকে দিয়ে এই ফরমান মানানো সহজসাধ্য কাজ ছিল না । ফলে ইংরেজরা এই ফরমান থেকে যতটা লাভ আশা করেছিল, ততটা তারা করতে পারেনি । অবশ্য যতটুকু পেরেছিল, তাতেই তাদের ব্যবসা হু হু করে বেড়েছিল । আসলে মুরশিদকুলি বা আলিবর্দি সরাসরি এই ফরমান অগ্রাহ্য করেন নি । যে সব সুযোগসুবিধা দিলে কারও কোন ক্ষতির সম্ভবনা ছিল না, সেগুলিকে দিতে তারা আপত্তি করেননি । ইংরেজদের বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তারা এই সুযোগ দেন । যদিও এর ফলে অন্যান্য বিদেশি বণিকেরা পক্ষপাতিত্বের শিকার হন । সম্রাটকে অশ্রদ্ধা করবার কোনো ইচ্ছাই বাংলার নবাবদের ছিল না । কিন্তু ইংরেজরা যখন তাদের আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যও বিনা শুল্কে করতে শুরু করে এবং তার ফলে একদিকে সরকার ও অন্যদিকে দেশি বণিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে, তখন তাঁরা কঠোর নীতি অনুসরণ করতে বাধ্য হন । তা-ছাড়া ইংরেজদের কোনো দুর্নীতিও সহ্য করতে তাঁরা প্রস্তুত ছিল না । ফলে প্রায়ই তাদের সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধ লাগত এবং ফলস্বরূপ ইংরেজরা তাঁদের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হত । তাঁরা কিন্তু কখনই ইংরেজদের প্রতি অনাবশ্যক অত্যাচার বা কঠোর নীতি প্রয়োগ করতেন না বা অন্যায়ভাবে টাকাও আদায় করতেন না । মারাঠা আক্রমণের সময় আলিবর্দি তা প্রতিহত করতে ইংরেজদের কাছ থেকে টাকা দাবি করতে বাধ্য হরেছিলেন । এক কথায়, নবাবরা ইংরেজদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন । অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকদের ক্ষেত্রে এই ধরনের কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি ।
মহারাষ্ট্র ও মাদ্রাজ : ১৭১৭ খ্রীষ্টাব্দের ফরমানের প্রায় ১৮ বছর বাদে পশ্চিম উপকূলে মারাঠা ও পর্তুগিজদের মধ্যে বিরোধ এবং মারাঠাদের সামুদ্রিক নেতা কানহোজি আঙরিয়ার অত্যাচারের ফলে ইংরেজদের ব্যবসা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় । এই অবস্থায় বোম্বাই শহরকে সুরক্ষিত করবার ব্যবস্থা করা হয় । এরপর অবশ্য ইংরেজদের বাণিজ্যের উন্নতি হতে থাকে । অবশেষে ১৭৩৯ খ্রীষ্টাব্দে তারা পেশবার সঙ্গে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে আঙরিয়ার শক্তি চূর্ণ করে দেয় । মাদ্রাজে ইংরেজদের ব্যবসা অবশ্য শান্তিপূর্ণ পথেই চলেছিল । এখানে তাদের সঙ্গে কর্ণাটকের নবাব ও হায়দরাবাদের নিজামের সুসম্পর্ক ছিল ।
*****
- 3188 views