উত্তরের বিশাল পার্বত্য অঞ্চল

Submitted by avimanyu pramanik on Wed, 11/12/2014 - 23:30

উত্তরের বিশাল পার্বত্য অঞ্চল :- প্রায় নিরবিচ্ছিন্ন পর্বতশ্রেণি নিয়ে গড়ে ওঠা এই অঞ্চলটি পশ্চিমে কাশ্মীর থেকে পূর্বে অসম পর্যন্ত বিস্তৃত । প্রায় ২,৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১৬০ থেকে ৪৫০ কিলোমিটার চওড়া বিশাল এই পার্বত্য অঞ্চলটি ভারতের উত্তর সীমান্তকে প্রাচীরের মতো রক্ষা করছে । দুটি প্রধান পর্বতশ্রেণি নিয়ে উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলটি গঠিত হয়েছে — (ক) কারাকোরাম পর্বতশ্রেণি (খ) হিমালয় পর্বতশ্রেণি ।

(ক) কারাকোরাম পর্বতশ্রেণি : এই পর্বতশ্রেণিটি পামীর মালভূমি থেকে পশ্চিমে সিন্ধু নদী পর্যন্ত প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য জুড়ে অবস্থান করছে । কারাকোরাম পর্বতশ্রেণিতে অনেকগুলি সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ আছে । এই পর্বতশ্রেণির পশ্চিম অংশে অবস্থিত গডউইন অস্টিন বা K2 হল ভারতের সর্বোচ্চ এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ এবং এর উচ্চতা হল ৮৬১১ মিটার । মাউন্ট এভারেস্ট হল পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ, এর উচ্চতা ৮৮৪৮ মিটার । কারাকোরাম পর্বতে অনেকগুলি হিমবাহ দেখা যায় । এদের মধ্যে সিয়াচেন, বালটেরা, বিয়াফো, হিসপার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য । সিয়াচেন ভারতের দীর্ঘতম হিমবাহ এর দৈর্ঘ্য ৭৬ কিমি. । বালটেরা হিমবাহের দৈর্ঘ্য ৬০ কিমি । বিয়াফো হিমবাহের দৈর্ঘ্য ৬০ কিমি এবং হিসপার হিমবাহের দৈর্ঘ্য ৬২ কিমি । 

(খ) হিমালয় পর্বতশ্রেণি : উত্তর-পশ্চিমের পামীরগ্রন্থি থেকে নির্গত হয়ে এই পর্বতশ্রেণি অর্ধচন্দ্রাকারে পশ্চিমে জম্মু-কাশ্মীরের নাঙ্গা পর্বত থেকে পূর্বে অরুণাচল প্রদেশের নামচা-বারওয়া পর্বত পর্যন্ত প্রায় ২,৫০০ কিমি দীর্ঘ অঞ্চল জুড়ে অবস্থান করছে ।

হিমালয় পর্বতের ভূপ্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য : হিমালয় পর্বতমালাকে ভূপ্রকৃতিগতভাবে দু-ভাগে ভাগ করা যায়, যথা— (i) প্রস্থ বরাবর হিমালয় পর্বতের ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং (ii) দৈর্ঘ্য বরাবর হিমালয় পর্বতের ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ।

(i) প্রস্থ বরাবর হিমালয় পর্বতের ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য : প্রস্থ বরাবর হিমালয় দক্ষিণ থেকে উত্তরে চারটি সমান্তরাল পর্বতশ্রেণির সমন্বয়ে গঠিত, যথা: (ক) শিবালিক হিমালয়,  (খ) হিমাচল হিমালয়,  (গ) হিমাদ্রি হিমালয় এবং (ঘ) টেথিস হিমালয় ।

(ক) শিবালিক হিমালয় : হিমালয়ের সর্ব দক্ষিণ প্রান্তে কম উচ্চতাযুক্ত ছোটো-ছোটো পাহাড় সারি বেঁধে পশ্চিম থেকে পূর্বে বিস্তৃত রয়েছে, এদের শিবালিক পাহাড় বলে । এদের উচ্চতা ৬০০ থেকে ১,৫০০ মিটার, প্রস্থ ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার এবং বিস্তার প্রায় ২,৪০০ কিলোমিটার । শিবালিকের দক্ষিণ ঢাল খাড়া এবং উত্তর ঢাল গড়ানো ।  

(খ) হিমাচল হিমালয় : শিবালিকের উত্তরে এবং হিমাদ্রির দক্ষিণে ৬০ থেকে ৮০ কি.মি. চওড়া এবং ২,০০০ থেকে ৫,০০০ মিটার উঁচু পর্বতশ্রেণিগুলিকে হিমাচল হিমালয় বলে । বহুযুগ ধরে ক্ষয়ের ফলে হিমাচল হিমালয় বহু অংশে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে । হিমাচলের প্রধান পর্বতশ্রেণিগুলি হল— পিরপঞ্জল, ধাওলাধর, মুসৌরী, মহাভারত প্রভৃতি । হিমাচল হিমালয় উত্তরে ক্রমশ ঢালু হয়ে হিমাদ্রিতে মিশেছে ।

(গ) হিমাদ্রি হিমালয় : হিমাচলের উত্তরে হিমালয় পর্বতের সর্বোচ্চ পর্বতশ্রেণি হিমাদ্রি অবস্থিত । এর উচ্চতা গড়ে প্রায় ৬,০০০ মিটারের বেশি উঁচু । হিমালয় পর্বতের এই অংশটি বছরের সব সময় বরফে ঢাকা থাকে বলে একে হিমাদ্রি বা হিমগিরি বলা হয় । হিমাদ্রি হিমালয়ের বিখ্যাত শৃঙ্গগুলি হল চিরতুষারাবৃত মাউন্ট এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, মাকালু প্রভৃতি । মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা উচ্চতা ৮৮৪৮ মিটার এবং এটি  পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ । কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতশৃঙ্গের উচ্চতা ৮,৫৯৮ মিটার । মাকালু পর্বতশৃঙ্গের উচ্চতা ৮,৪৮১ মিটার । হিমাদ্রি হিমালয় ক্রমশ ঢালু হয়ে তিব্বতের মালভূমিতে মিশেছে ।

(ঘ) টেথিস হিমালয় : হিমাদ্রির উত্তরে টেথিস বা তিব্বতীয় হিমালয় অবস্থিত । এটি একটি বিশাল মালভূমি অঞ্চল । ভারতের জম্মু-কাশ্মীর ও হিমাচল প্রদেশের অংশ বিশেষ দেখা যায় ।

(ii) দৈর্ঘ্য বরাবর হিমালয় পর্বতের ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য : দৈর্ঘ্য বরাবর হিমালয় পর্বতমালাকে ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু ও মৃত্তিকার পার্থক্য অনুসারে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা: (ক) পশ্চিম হিমালয়, (খ) মধ্য হিমালয় এবং (গ) পূর্ব হিমালয় ।  

(ক) পশ্চিম হিমালয় : পশ্চিমে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের নাঙ্গা পর্বত থেকে পূর্বে নেপাল সীমান্তে অবস্থিত কালী নদী পর্যন্ত অংশে পশ্চিম হিমালয় পর্বতশ্রেণি বিস্তৃত । ভারতের জম্মু-কাশ্মীর ও হিমাচল প্রদেশ রাজ্যে এই পর্বতশ্রেণিটি বিস্তার লাভ করেছে । এটি ভারতের মধ্যে অবস্থিত হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ও এর উচ্চতা ৮,১২৬ মিটার । ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে পশ্চিম হিমালয়কে তিন ভাগে ভাগ করা যায়, যথা: (১) কাশ্মীর হিমালয়,  (২) হিমাচল হিমালয় এবং (৩) কুমায়ুন হিমালয় । প্রধানত তিনটি পর্বতশ্রেণি নিয়ে পশ্চিম হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলটি গঠিত হয়েছে— (i) লাদাখ পর্বতশ্রেণি (ii) জাস্কর পর্বতশ্রেণি এবং (iii) পিরপিঞ্জল পর্বতশ্রেণি । শ্রীনগরের দক্ষিণে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পিরপিঞ্জল পর্বতশ্রেণি বিস্তৃত । এর উচ্চতা ৩,৫০০ থেকে ৫,০০০ মিটার । পিরপিঞ্জল পর্বতশ্রেণি কাশ্মীর উপত্যকাকে ভারতের অন্যান্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে । কেবলমাত্র বানিহাল বা জহর পাস, পিরপিঞ্জল পাস, বুলন্দপীর প্রভৃতি গিরিপথগুলি দিয়ে কাশ্মীর উপত্যকায় প্রবেশ করা যায় । কাশ্মীর হিমালয়ের জোজিলা পাস গিরিপথটি দিয়ে কাশ্মীর উপত্যকা থেকে লাদাখের রাজধানী লে-তে যাওয়া যায় । এছাড়া কুমায়ুন হিমালয়ের মানাপাস, নিতিপাস প্রভৃতি গিরিপথগুলি দিয়ে ভারতের উত্তরাঞ্চল রাজ্য থেকে তিব্বত যাওয়া যায় ।

(খ) মধ্য হিমালয় : ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্য এবং নেপালে বিস্তৃত এই পার্বত্য অঞ্চলটিতে মাউন্ট এভারেস্ট, মাকালু, ধবলগিরি, অন্নপূর্ণা, গৌরীশঙ্কর প্রভৃতি পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গগুলি অবস্থিত । মধ্য হিমালয় হল পূর্ব হিমালয় ও পশ্চিম হিমালয়ের সীমানা । এটি নেপালের অন্তর্গত ।

(গ) পূর্ব হিমালয় : পশ্চিমে সিঙ্গালিলা পর্বতশ্রেণি থেকে পূর্বে নামচাবারওয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হিমালয়ের পূর্ব দিকের এই অংশটিকে মোটামুটি ভাবে তিন ভাগে ভাগ করা যায়, যথা:- (১) সিকিম ও দার্জিলিং হিমালয়,  (২) ভুটান হিমালয় এবং (৩) অরুণাচল হিমালয় । এই পার্বত্য অঞ্চলটি ভুটান এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম এবং অরুণাচল প্রদেশ রাজ্যে বিস্তার লাভ করেছে । পূর্ব হিমালয়ের সিঙ্গালিলা পর্বতশ্রেণি পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলাকে নেপাল থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে । এছাড়া সিকিম ও নেপাল সীমান্তে পূর্ব হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতশৃঙ্গ বিরাজমান । এটি হিমালয়ের দ্বিতীয় উচ্চতম পর্বত শৃঙ্গ । এর উচ্চতা ৮,৫৯৮ মিটার । কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতশৃঙ্গটি নেপালের ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে অবস্থিত ।  সিকিম ও দার্জিলিং হিমালয় প্রায় খাড়াভাবে তরাই -এর সমভূমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে । অনুচ্চ শিবালিক পর্বতশ্রেণি এখানে প্রায় নেই বললেই চলে । পূর্ব হিমালয়ের নাথুলা পাস, জেলেপলা পাস প্রভৃতি গিরিপথ্গুলি দিয়ে তিব্বতের চুম্বি উপত্যকায় যাওয়া যায় ।

ভারতের জনজীবনে হিমালয়ের প্রভাব :-

(i) হিমালয় পর্বত ভারতের উত্তর সীমান্তে দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মতো দন্ডায়মান থেকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে ভারতকে রক্ষা করছে ।

(ii) হিমালয় পর্বত না থাকলে শীতকালে ভারতেও সাইবেরিয়ার মতো তীব্র শীতের প্রাবল্য দেখা যেত ।

(iii) হিমালয়ের সুউচ্চ প্রাচীরে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু ভারতে বৃষ্টিপাত ঘটায় ।

(iv) হিমালয়ের বিভিন্ন হিমবাহগুলো হল ভারতের গঙ্গা, সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্র প্রভৃতি প্রধান নদীগুলোর উত্স । এছাড়া অন্যান্য নদীগুলোও হিমালয়ের বরফগলা জলে পুষ্ট থাকে ।

(v) ভারতের গঙ্গা, সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্র প্রভৃতি নদীগুলি হিমালয় পর্বত থেকে প্রচুর পরিমাণে পলি বয়ে নিয়ে এসে উত্তর ও পূর্ব ভারতের বিশাল সমভূমি অঞ্চলের সৃষ্টি করেছে ।

*****

Related Items

ভাগীরথী-হুগলী নদীর ওপর বর্জ্যের প্রভাব (Effects of waste disposal on Bhagirathi-Hooghly river)

ভাগীরথী-হুগলী নদীর ওপর বর্জ্যের প্রভাব (Effects of waste disposal on Bhagirathi-Hooghly river) : প্রায় 2500 কিমি দীর্ঘ গঙ্গা নদী ভারতের জীবন রেখা । গঙ্গা নদীর পার্শ্ববর্তী কলকারখানার বর্জ্য, পৌরসভার বর্জ্য, কৃষি ক্ষেত্রের কীটনাশক বাহিত জল ইত্যাদি এই নদ

বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় শিক্ষার্থীর ভূমিকা (Role of Students in Waste Management)

বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় শিক্ষার্থীর ভূমিকা (Role of students in waste management) : সুন্দর ও স্বচ্ছ মন এবং সুস্থশিক্ষা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল । পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সুন্দর না থাকলে, সুন্দর স্বচ্ছ মন ও সুস্থশিক্ষা সম্ভব নয় । তাই বর্জ্য ব্যবস্

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা (Need for Waste Management)

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা (Need for waste management) : ভূপৃষ্ঠস্থ জলের কলুষিতকরণ, মৃত্তিকা সংক্রমণ, দূষণ, লিশেট ইত্যাদির মাধ্যমে বর্জ্য পরিবেশকে প্রভাবিত করে থাকে । বর্জ্যপদার্থ কঠিন বা তরলরূপে জলাশয়ে এসে পড়লে তা জলের রাসায়নিক গঠনের পরিবর্তন

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি (Method of Waste Management)

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি (Method of waste management) : বর্জ্যপদার্থ সংগ্রহ, বর্জ্যের পরিবহন, আবর্জনার বিলিব্যবস্থা, নর্দমার জল ও অন্যান্য বর্জ্যের নিকাশ প্রভৃতি হল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অন্যতম দিক । বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রধান পদ্ধতিগুলি হল— (১) বর্জ্য

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (Waste Management)

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (Waste Management) : যে কার্যকরী পরিচালন পদ্ধতির মাধ্যমে বর্জ্য পদার্থের সংগ্রহ, অপসারণ, পরিবহণ, শোধন, ক্ষতিকর প্রভাব হ্রাস ও পুনরায় বর্জ্য পদার্থকে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা হয়, তাকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলা হয় । অন্যভাবে বলা যায়, বর্জ