নিরুদ্দেশ — প্রেমেদ্র মিত্র
দিনটা ভারী বিশ্রী । শীতের দিনে বাদলার মতো এত অস্বস্তিকর আর কিছু বোধহয় নাই । বৃষ্টি ঠিক যে পড়িতেছে তাহা নয় । কিন্তু মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ও ম্লান পৃথিবী কেমন মৃতের মতো অসাড় হইয়া আছে । সোমেশ হঠাৎ আজ আসিয়া না পড়িলে কেমন করিয়া দুপুরটা কাটাইতাম বলিতে পারি না । কিন্তু সোমেশ আজ যেন কেমন হইয়া আসিয়াছে ।
খবরের কাগজটা দু-একবার উলটাইয়া পালটাইয়া সোমেশের সামনে ফেলিয়া দিয়া বলিলাম —'একটা আশ্চর্য ব্যাপার দেখেছ ?'
'কী ?'
'আজকের কাগজে একসঙ্গে সাত-সাতটা নিরুদ্দেশ -এর বিজ্ঞাপন ।'
সোমেশ কোনো কৌতুহলই প্রকাশ করিল না । যেমন বসিয়াছিল, তেমনি উদাসীন ভাবেই শুধু সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়িতে লাগিল । নিস্তব্ধ ঘরের ভিতর ধোঁয়ার কুণ্ডলী শুধু ধীরে ধীরে পাক খাইতে খাইতে ঊর্ধ্বে উঠিতেছে । আর সমস্তই নিশ্চল স্তব্ধ । বাইরের অসাড়তা যেন আমাদের মনের উপরও চাপিয়া ধরিয়াছে ।
নেহাৎ একটা কিছু করিয়া এই অস্বস্তিকর স্তব্ধতা ভাঙিবার প্রয়োজনেই আরম্ভ করিলাম,—'নিরুদ্দেশ' -এর এই বিজ্ঞাপনগুলো দেখলে কিন্তু আমার হাসি পায় । অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা কী হয় জান তো ? ছেলে হয়তো রাত করে থিয়েটার দেখে বাড়ি ফিরেছেন । এমন তিনি প্রায়ই ফিরে থাকেন আজকাল । খেতে বসবার সময় বাবা কয়েকদিন খোঁজ করেছেন—'কোথায় গেলেন বাবু ! তোমার গুণধর পুত্রটি ।'
লুকোনো পুঁজি থেকে মা বিকেলে ছেলের পেড়াপিড়িতে টাকা কটা বার করে দিয়েছেন । সুতরাং তিনি জেনে শুনে মিথ্যে আর বলতে পারেন না— চুপ করে থাকেন ।
বাবা বলে যান,—'এত রাত্রেও বাবুর আসবার সময় হলো না । আরবারে তো ফেল করে মাথা কিনেছেন । এবারও কী করে কৃতার্থ করবেন বুঝতেই পারছি । পয়সাগুলো আমার খোলামকুচি কিনা, তাই নবাবপুত্তুর যা খুশি তাই করছেন । দূর করে দেবো, এবার দূর করে দেবো ।'
এই মৌখিক আস্ফালনেই হয়তো ব্যাপারটা শেষ হতে পারত । কিন্তু ঠিক সেই সময়ে গুণধর পুত্রের প্রবেশ । বাবা ঝোঁকটা আর কাটিয়ে উঠতে পারেন না । নিজের কাছে মান রাখবার জন্যেও কিছু বলতে হয় ।
কতটা রাগ দেখানো উচিত ঠিক করতে না পেরে বলার মাত্রাটা একটু বেশি হয়ে পড়ে ।
শেষ পর্যন্ত বাবা বলেন, 'এমন ছেলের আমার দরকার নেই —বেরিয়ে যা ।'
অভিমানী ছেলে আর কিছু না হোক, পিতৃদেবের এ আদেশ তৎক্ষণাৎ পালন করিতে উদ্যত হয় ।
মা কোন দিক সামলাবেন বুঝতে না পেরে কাতরভাবে শুধু বলেন, —'আহা খাওয়া-দাওয়ার সময় কেন এসব বলো তো ! পরে বললেই তো হতো ।'
বাবা এবার মা-র ওপর মারমুখী হয়ে ওঠেন—'তোমার আশকারাতেই তো উচ্ছন্নে গেছে ! মাথাটি তো তুমিই খেয়েছ আদর দিয়ে ।'
মা আঁচলে চোখ মোছেন । ছেলে বিশাল পৃথিবীতে নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়ে পড়ে ।
পরের দিন ভয়ানক কাণ্ড । মা সেই রাত থেকে দাঁতে কুটি কাটেননি ! আজকের দিনও বিছানা থেকে উঠবেন মনে হয় না । বাবারও হয়তো রাত্রে ঘুম হয়নি । কিন্তু সে কথা প্রকাশ করবেন কোন মুখে !
গৃহিণীকে ধমক দিয়ে বলেন—'মিছিমিছি প্যানপ্যান কোরো না । অমন ছেলে যাওয়াই ভালো ।'
মা-র কান্না আবার উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে ।
বাবা এবার দাঁত খিচিয়ে বললেও নিজের মনের আশার কথাটাই বোধহয় জানান—'তাও গেলে তো বাঁচতাম । এ বেলাই দেখো সুড়সুড় করে আবার ফিরে আসবে । এমন বিনি পয়সার হোটেলখানা পাবে কোথায় ?'
মা এবার অশ্রুসিক্ত স্বরে বলেন—'এই দারুণ শীতে কাল সারারাত কোথায় রইল কে জানে ! কী করে বসে আমার তাই ভয় ।'
'হ্যাঁ ভয় !'—বাবা কথাটাকে ব্যঙ্গ করেই উড়িয়ে দিতে চান 'তোমার ছেলে কিছু করেনি গো কিছু করেনি । দিব্যি আছে কোনো বন্ধুর বাড়ি । অসুবিধে হলেই এসে দেখা দেবে ।'
মা-র কান্না তবু থামে না ।—'কীরকম অভিমানী জানো তো ।'
বিরক্ত হতে বাবা বেরিয়ে যান । সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে ফিরে এসে দেখেন অবস্থা গুরুতর । ছেলে ফেরেনি । মা শয্যা থেকে আর উঠবেন না বলেই পণ করেছেন ।
'না আর থাকতে দিলে না ! এ অশান্তির চেয়ে বনবাস ভালো ।' বলে বাবা বেরিয়ে পড়েন এবং ওঠেন গিয়ে একেবারে খবরের কাগজের অফিসে ।
খবরের কাগজের অফিসের ব্যাপারটা বড়ো জটিল । কোন দিকে কী করতে হয় কিছু বোঝা যায় না । খানিক এদিক-ওদিক বিমূঢ়ভাবে ঘুরে এক দিকের একটা অফিসঘরে ঢুকে পড়ে নিরীহ চেহারার এক ভদ্রলোককে বেছে নিয়ে সাহস করে জিজ্ঞাসা করেন—'আপনাদের কাগজে এই— এই একটা খবর বার করতে চাই !'
নিরীহ চেহারার লোকটি হঠাৎ মুখ তুলে ব্যঙ্গের স্বরে বলেন— 'খবর ! কেন আমাদের খবরগুলো পছন্দ হচ্ছে না ! আমরা কি এতদিন রামযাত্রা বার করেছি !'
বাবা একটু হতভম্ব হয়ে একবার অসহায়ভাবে চারদিকে তাকান । পাশের যে ভদ্রলোকটির মুখ দেখে অত্যন্ত রূঢ় প্রকৃতির মনে হয়েছিল, তিনিই সহানুভূতির স্বরে বলেন, 'আহা কী করছ ! ভদ্রলোক কী বলতে চান, শোনোই না ! বসুন আপনি ।'
বাবা একটা চেয়ারে একটু অপ্রস্তুতভাবে বসবার পর তিনি বলেন— 'কী খবর বলছিলেন !'
'আজ্ঞে ঠিক খবর নয় এই—এই একটু বিজ্ঞাপন !'
'বিজ্ঞাপন ? কীসের বিজ্ঞাপন ? কতটা স্পেস দরকার ? কপি এনেছেন ?'
বাবা আরো বিমূঢ়ভাবে বলেন—'আজ্ঞে ঠিক বিজ্ঞাপন নয়— এই আমার ছেলে বাড়ি থেকে চলে গিয়েছে—'
তাঁকে আর কথা শেষ করতে হয় না । টেবিলের অপর দিক থেকে ভদ্রলোক বলেন— 'ও বুঝেছি, নিরুদ্দেশ ! কী দেবেন— চেহারার বর্ণনা, না ফিরে আসবার অনুরোধ !'
বাবা যেন এতক্ষণে কূল পেয়ে বলেন— 'আজ্ঞে হ্যাঁ, ফিরে আসবার অনুরোধ ! ওর মা বড়ো কাঁদাকাটি করছে ।'
'বুঝেছি বুঝেছি । রাগারাগি করে গিয়েছে বুঝি ?' ভদ্রলোক একটা কাগজের প্যাড বাবার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন— 'নিন, লিখে দিন !'
'লিখে !' বাবার মুখের বিপদগ্রস্তভাব অত্যন্ত স্পষ্ট ।
ভদ্রলোক দয়াপরবশ হয়ে বলেন—'আচ্ছা আমরা লিখে দেবো'খন । আপনি শুধু নামটামগুলো দিয়ে যান ।'
পরিচয় ইত্যাদি দিয়ে যাবার সময় বাবা অনুরোধ করেন, 'একটু ভালো করে লিখে দেবেন । ওর মা কাল থেকে জলগ্রহণ করেনি ।'
'সে বলতে হবে না, এমন লিখে দেবো, যে পড়ে আপনার ছেলে কেঁদে ভাসিয়ে দেবে । আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন ।'
আশ্বস্ত হয়ে বাবা ঘরে ফেরেন । কিন্তু অশ্রুসজল বিজ্ঞাপন বার হবার আগেই দেখেন ছেলে ঘরে এসে হাজির ।
অনুতপ্ত হয়ে সে এসেছে মনে কোরো না; সে বাড়িতে থাকতে আসেনি ! শুধু একবার চলে যাবার আগে তার গোটাকতক বই নিয়ে যেতে এসেছে ।
এবার মা-র ক্রুদ্ধস্বর শোনা যায়, 'তা যাবি বই কি; অমনি কুলাঙ্গার তুই তো হয়েছিস । কোনো ছেলে যেন আর বকুনি খায় না । তুই একেবারে পির হয়েছিস ? কাল সারারাত দুচোখের পাতা এক করেননি তা জানিস ? ভেবে ভেবে চেহারাটা আজ কী হয়েছে দেখে আয় । উনি তেজ করে চলে যাবেন !'
বাবা এবার ভেতরে ঢুকে মৃদুস্বরে বলেন— 'আঃ আর বকাবকি কেন ?'
মা ধমক দিয়ে বলেন— 'তুমি থামো । অত আদর ভালো নয় ! একটু বকুনি খেয়েছেন বলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে এত বড়ো আস্পর্ধা !'
অধিকাংশ নিরুদ্দেশের বিজ্ঞাপনের ইতিহাসই এই ।
সোমেশের সিগারেটটা তখন শেষ হইয়াছে । এতক্ষণ ধরিয়া আমার কথা সে মোটেই শুনিয়াছে বলিয়া মনে হয় না । একবার একটু নড়িয়া বসিতেও তাহাকে দেখা যায় নাই ।
একটু বিরক্ত স্বরেই বলিলাম, 'কী হয়েছে তোমার বলো তো ? মিছিমিছিই আমি একলা বকে মরছি ।'
সে কথার কোনো উত্তর না দিয়া সোমেশ হঠাৎ ছড়ানো পা গুটাইয়া লইয়া সোজা হইয়া বসিয়া সিগারেটের অবশিষ্টটুকু ফেলিয়া দিল । তারপর বলিল,—
'তুমি জানো না । এই বিজ্ঞাপনের পেছনে অনেক সত্যকার ট্র্যাজিডি থাকে ।'
'তা থাকে যে আমি অস্বীকার করছি না । কখনো-কখনো সত্যিই যে যায় সে আর ফেরে না ।'
সোমেশ একটু হাসিয়া বলিল, 'না, তা বলছি না । ফিরে আসারই ভয়ানক একটা ট্র্যাজিডির কথা আমি জানি ।'
আমি উৎসুকভাবে তাহার দিকে চাহিয়া বলিলাম, 'তার মানে ?'
'শোনো বলছি ।'
বাহিরে এতক্ষণে বৃষ্টি আবার আরম্ভ হইয়াছে । কাঁচের শার্সির ভিতর দিয়া বাহিরের রাস্তাঘাট ঝাপসা অবাস্তব দেখাইতেছে । মনে হইতেছে আমরা যেন সমস্ত পৃথিবী হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া গিয়াছি ।
'পুরানো খবরের কাগজের ফাইল যদি উলটে দেখো, তাহলে দেখতে পাবে বহু বছর আগে এখানকার একটি প্রধান সংবাদপত্রের পাতায় দিনের পর দিন একটি বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে । সে বিজ্ঞাপন নয়, সম্পূর্ণ একটি ইতিহাস । দিনের পর দিন ধারাবাহিকভাবে পড়ে গেলে সম্পূর্ণ একটি কাহিনি যেন জানা যায় । মনে হয় ছাপার লেখায় সত্যি যেন কান পাতলে কাতর আর্তনাদ শোনা যাবে । সে বিজ্ঞাপন অবশ্য 'নিরুদ্দেশে'র । প্রথমে দেখা যায় মায়ের কাতর অনুরোধ ছেলের প্রতি ফিরে আসার জন্য । অস্পষ্ট আড়ষ্ট ভাষা, কিন্তু তার ভিতর দিয়ে কী ব্যাকুলতা যে প্রকাশ পেয়েছে তা না পড়লে বোঝা যায় না । ধীরে ধীরে মায়ের কাতর অনুরোধ হতাশ দীর্ঘশ্বাসের মতো খবরের কাগজের পাতায় যেন মিলিয়ে যেতেও দেখা গেল । তারপর শোনা গেল পিতার গম্ভীর স্বর, একটু যেন কম্পিত তবু ধীর ও শান্ত—'শোভন ফিরে এসো । তোমার মা শয্যাগত । তোমার কি এতটুকু কর্তব্যবোধও নেই ।
বিজ্ঞাপন তারপরেও কিন্তু থামল না । পিতার স্বর ভারী হয়ে আসছে যেন; মনে হয় যেন গলাটা ধরা । 'শোভন, এখন না এলে তোমার মাকে আর দেখতে পাবে না ।'
কিন্তু শোভনের হৃদয় এতে বুঝি গলল না । দেখা গেল বিজ্ঞাপন সমানভাবে চলেছে, শুধু পিতার নিজেকে সামলাবার আর ক্ষমতা নাই । এবার তাঁর স্বরে কাতরতা—শুধু কাতরতা নয়, একান্ত দুর্বলতা— 'শোভন, জানো না আমাদের কেমন করে দিন যাচ্ছে ! এসো, আর আমাদের দুঃখ দিও না ।'
বিজ্ঞাপন ক্রমশ হতাশ হাহাকার হয়ে উঠল । তারপর একেবারে গেল বদলে । আর শোভনকে উদ্দেশ্য করে কিছু লেখা নাই । সাধারণ একটি বিজ্ঞপ্তি মাত্র । এই ধরনের এই চেহারার এই বয়সের একটি ছেলে । আজ এক বৎসর তার কোনো সন্ধান নেই । সন্ধান দিতে পারলে পুরস্কার পাওয়া যাবে ।
পুরস্কারের পরিমাণ ক্রমশই বাড়তে লাগল খবরের কাগজের পাতায় । দোহারা ছিপছিপে একটি বছর ষোলো-সতেরোর ছেলে । পরিচয়-চিহ্ন ঘাড়ের দিকে ডান কানের কাছে একটি বড়ো জড়ুল জীবিত না মৃত এইটুকু যদি কেউ সন্ধান দিতে পারে, তাহলেও পুরস্কার পাওয়া যাবে ।
সোমেশ চুপ করিল খানিকক্ষণের জন্য । জলের ছাটে শার্সির কাঁচ একেবারে ঝাপসা হইয়া গিয়াছে । ঘরের ভিতর ঠান্ডায় মনে হইতেছে একটা কম্বল-টম্বল জড়াইতে পারিলে ভালো হয় ।
বলিলাম —'এত গেল বিজ্ঞাপনের উপাখ্যান । আসল ব্যাপারের কিছু জানো নাকি ?'
'জানি ! শোভনকে আমি জানতাম । সে যে কোনো ভয়ংকর অভিমানের বশে বাড়ি ছেড়ে এসেছিল তা মনে কোরো না । বাড়ি ছাড়াটাই তার কাছে একান্ত সহজ । ছুতোটা যা হোক কিছু হলেই হলো । পৃথিবীতে দু-একটা লোক আসে জন্ম থেকেই একেবারে নির্লিপ্ত মন নিয়ে । তারা ঠিক কঠিনহৃদয় নয় । বরং বলা যেতে পারে তাদের মন তৈলাক্ত । পিচ্ছিল বলে তারা কোথাও ধরা পড়ে না, কিছুই তাদের মনে দাগ দিতে পারে না । শুনলে আশ্চর্য হবে, খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের সংবাদ জানলেও সেগুলো সে অনুসরণই করেনি । কোনোদিন চোখে পড়েছিল হয়তো—তারপর অনায়াসে সেগুলো গেছল ভুলে । বাড়ির বাইরে যে সমস্ত দুঃখ অসুবিধায় অন্য কেউ হলে হয়রান হয়ে পড়ত তার ভেতরেই সে পেয়েছে মুক্তির স্বাদ । অন্য কেউ যাই ভাবুক সে নিজেকে একটি ছোটো সংসারের আদরের ছেলে হিসেবে শুধু ভাবতে পারেনি । কিন্তু বিজ্ঞাপন যেদিন হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল, সেদিন কেন বলা যায় না তার উদাসীন মনও বিচলিত হয়ে উঠল । বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়েছিল একটু অসাধারনভাবে ! ক্লান্তভাবে চলতে চলতে একদিন হঠাৎ থেমে যায়নি, হঠাৎ যেন একটা ভয়ংকর দুর্ঘটনায় সংবাদপত্রের পাতা স্তব্ধ হয়ে গেল । শোভনের চেহারার বর্ণনার বদলে হঠাৎ একদিন দেখা গেল,—
'শোভন, তোমার মার সঙ্গে আর তোমার বুঝি দেখা হলো না । তিনি শুধু তোমারই নাম করছেন এখনো ।' তারপর আর কোনো বিজ্ঞাপন দেখা গেল না ।
প্রায় দুই বৎসর তখন কেটে গেছে । শোভন একদিন হঠাৎ গিয়ে হাজির তার দেশে । একটা ব্যাপারে শোভনের প্রকৃতির খানিকটা পরিচয় পাবে । সে কথাটা আগে বলিনি । শোভন সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে নয় । সম্পন্ন বললেও তাদের ঠিক বর্ণনা করা হয় না । তাদের প্রাচীন জমিদারি অনেক দুর্দিনের ভেতর দিয়ে এসেও তখনও তেমন ক্ষয় পায়নি । শোভনই তার একমাত্র উত্তরাধিকারী ।'
সোমেশ একটু থামতেই আমি বললাম, 'যাক শেষটকু আর না বললেও চলবে । বুঝতে পেরেছি ।'
সোমেশ একটু হাসিয়া কোনো উত্তর না দিয়া বলিয়া চলিল—'দু-বছর স্বাধীন জীবনে দুঃখ-কষ্ট গায়ে না মাখলেও তার ছাপ শোভনের অপর তখন পড়েছে । দু-বছরে সে অনেক পরিবর্তিত হয়েছে । কিন্তু তাই বলে তাদের কর্মচারীরা তাকে চিনতে পারবে না এতটা আশঙ্কা করেনি ।'
শোভন দেশে পৌঁছে সোজাসুজি তাদের বাড়ি ঢুকছিল, প্রথমে তাকে বাধা দিলেন তাদের পুরানো নায়েবমশাই । 'কাকে চান ?'
শোভন হেসে বললে—'কাউকে না, বাড়িতে যেতে চাই ।'
নায়েবমশাই তার দিকে খানিক তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তারপর একটু স্মিতহাস্যে বললেন—'ওঃ কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কেন, আসুন, বারবাড়িতে একটু বিশ্রাম করুন ।'
শোভন অবাক হয়ে বললে—'সে কি ? কী হয়েছে নায়েবমশাই ?'
'না, না, হয়নি কিছু !'
'মা ভালো আছেন ?' শোভনের প্রশ্নে এবার সত্যি ব্যাকুলতা ছিল ।
নায়েবমশাই তেমনি অদ্ভুত হাসি হেসে বললেন— 'ভালো আছেন বইকি ! আসুন আমার সঙ্গে ।'
শোভন তবু বললে—'কিন্তু ভেতরে গেলেই তো হয় ।'
নায়েবমশাই একটু যেন কঠিন স্বরে বললেন— 'না হয় না, আপনি আমার সঙ্গে আসুন ।'
শোভন রীতিমতো বিমূঢ় অবস্থায় আবার নায়েবমশাইকে অনুসরণ করে বারবাড়িতে গিয়ে উঠল । দু-বছরে সেখনে কিছু কিছু পরিবর্তন হয়েছে । পুরানো সরকার তাদের নেই । নতুন দুটি লোক সেখানে বসে খাতা লিখছে । তার পরিচিত বৃদ্ধ খাজাঞ্চিমশাইকে দেখে সে যেন আশ্বস্ত হলো ।
নায়েবমশাই তাকে একটা চেয়ারে বসতে বলে খাজাঞ্চমশাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন—'ইনি ভেতরে যেতে চাইছেন !'
শোভনের কাছে নায়েবমশাই -এর গলার স্বর কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হলো । খাজাঞ্চিমশাই নাকের ওপরকার চশমাটা একটু আঙুল দিয়ে তুলে তার দিকে চেয়ে বললেন— 'ওঃ ইনি আজই এসেছেন বুঝি !'
'হ্যাঁ, এইমাত্র ।'
শোভন এবার অধীরভাবে বলে উঠল, 'আপনারা কী বলতে চান স্পষ্ট করে বলুন । মার কি কিছু হয়েছে ? বাবা কেমন আছেন ?'
চারিধারের সব কটা দৃষ্টি তার ওপর অদ্ভুতভাবে নিবদ্ধ । খানিকক্ষণ সকলেই নীরব । তারপর নায়েবমশাই বললেন, —'তাঁরা সবাই ভালো আছেন । কিন্তু এখন তো আপনার সঙ্গে দেখা হবে না ।'
এবার শোভন ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল—'কেন দেখা হবে না ? আপনাদের কি মাথা খারাপ হয়েছে । আমি চললুম ।'
শোভন উঠল । কিন্তু নায়েবমশাই দরজার কাছে সামান্য কিছু এগিয়ে গিয়ে শান্তভাবে বললেন— 'দেখুন, মিছিমিছি কেলেংকারি করে লাভ নেই । তাতে ফল হবে না কিছু ।'
হঠাৎ শোভনের কাছে সমস্ত ব্যাপারটা ভয়ংকরভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠল । সে বিস্মিত ভীত কন্ঠে বলল—'আপনারা কি আমাকে চিনতে পারছেন না ?
সকলে নীরব ।
'আমি শোভন,—বুঝতে পারছেন না আমি শোভন ?'
নায়েবমশাই এবার বললেন— 'আপনি একটু দাঁড়ান, আমি আসছি ।' পাশের ঘরে গিয়ে টেবিলের একটা ড্রয়ার খুলে তিনি একটা জিনিস এনে শোভনের হাতে দিলেন । তারই একটা পুরানো ফটো, সাধারণভাবে তোলা । এখন অস্পষ্ট হয়ে এসেছে একটু ।
নায়েবমশাই বললেন,—'চেনেন একে ?'
শোভন বিস্মিত কন্ঠে বললে,—'এ তো আমারই ফটো । দেখুন ভালো করে আপনারাই মিলিয়ে । নাঃ, এ অসহ্য ।
চুলগুলো মুঠি করে ধরে সে বসে পড়ল ।
নায়েবমশাই তার সঙ্গে বসে বললেন— 'দেখুন, কিছু মনে করবেন না । আপনার সঙ্গে একটু মিল আছে সত্যি । কিন্তু এর আগে আরো দুজনের সঙ্গে ছিল । মায় জড়ুল পর্যন্ত । আমাদের এ নিয়ে গোলমাল করতে মানা আছে । আমরা কিছু হাঙ্গামা করব না । আপনি এখন চলে যেতে পারেন ।'
শোভন উদভ্রান্তভাবে সকলের দিকে চেয়ে দেখল । সকলের দৃষ্টিতে অবিশ্বাস ।
কাতরভাবে বলল,— 'একবার শুধু আমি মা-বাবার সঙ্গে দেখা করব । আপনারা বিশ্বাস করছেন না । কিন্তু একবার আমায় শুধু দেখা করতে দিন ।'
নায়েবমশাই হতাশভাবে হাতের ভঙ্গি করে বললেন— 'শুনুন তাহলে, সাতদিন আগে শোভন মারা গেছে । তার মৃত্যুর খবর আমরা পেয়েছি ।'
শোভন এই অবস্থাতে না হেসে পারলে না, বললে— 'কেমন করে মারা গেল ?'
তার কণ্ঠস্বরের বিদ্রুপ উপেক্ষা করে নায়েবমশাই বললেন— 'মারা গিয়েছে রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়ে অপঘাতে । নাম-ধাম পরিচয় পাওয়া সম্ভব হয়নি । কিন্তু যারা দুর্ঘটনার সময় উপস্থিত ছিল তাদের কয়েকজন খবরের কাগজে আমাদের বিজ্ঞাপন দেখে আমাদের সব কথা জানিয়েছেন । হাসপাতালেও আমরা খবর নিয়েছি । সেখানকার ডাক্তারের বর্ণনাও আমাদের সঙ্গে মিলে গিয়েছে ।'
শোভন এরপর কী করত বলা যায় না, কিন্তু সেই সময় দেখা গেল তার বাবা বাড়ি থেকে বেরুচ্ছেন । মানুষের সঙ্গে ঝড়ে ভাঙা গাছের যে এতদূর সাদৃশ্য হতে পারে, সাহিত্যের উপমা পড়েও কখনও তার মনে হয়নি । তাঁর চলার গতিতে পর্যন্ত যেন ভয়ংকর দুর্ঘটনার পরিচয় আছে ।
সকলে কিছু বুঝে ওঠাবার আগেই শোভন দৌড়ে ঘর থেকে বার হয়ে গেল । নায়েব ও কর্মচারীরা ব্যাপারটা বুঝে যখন তার পিছু নিলে, তখন সে বাবার কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়েছে ।
'বাবা !'
বৃদ্ধ থমকে দাঁড়ালেন । সে মুখের বেদনাময় বিমূঢ়তা শোভনের বুকে ছুরির মতো বিঁধল ।
'বাবা আমায় চিনতে পারছ ?'
বৃদ্ধ স্খলিতপদে এক পা এগিয়ে আবার থমকে গেলেন । প্রবল ভাবাবেগ তাঁর বার্ধক্যের শিথিল মুখকে বিকৃত করে দিচ্ছে ।
তখন নায়েবমশাই ও কর্মচারীরা এসে পড়েছেন ।
বৃদ্ধ কম্পিত হাত তুলে, কম্পিত স্বরে বললেন— 'কে ?'
নায়েবমশাই শোভনের কাঁধে দৃঢ় ভাবে হাত রেখে বললেন— 'না, কেউ না । সেই সেবারের মতো— এই নিয়ে তিন বার হলো !'
একজন কর্মচারী বললে— 'আমরা আসতে দিইনি, হঠাৎ আমাদের হাত ছাড়িয়ে—'
বৃদ্ধ তাকে থামিয়ে বললেন— 'কিছু বোলো না, চলে যেতে দাও ।' বৃদ্ধ শেষ বার শোভনের দিকে কাতরভাবে চেয়ে আবার ঘরের দিকে ফিরলেন ।
শোভন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল । নায়েবমশাই তাকে কী বলছিলেন । অনেকক্ষণ সে কিছু শুনতে পায়নি । কখন সে আবার বারবাড়িতে এসে বসেছে, তাও তার মনে নেই ।
আচ্ছন্নতা তার কাটল খানিক বাদে । ভেতর বাড়ি থেকে একজন কর্মচারী নায়েবমশাইকে এসে কী বলছে । নায়েবমশাই তাকে কী বলছেন ঠিক শোনা যাচ্ছে না । না, এইবার বোঝা যাচ্ছে । নায়েবমশাই-এর হাতে অনেকগুলো টাকার নোট । কণ্ঠস্বরে তাঁর মিনতি ।
শোভনকে একটা কাজ করতে হবে । বাড়ির কর্ত্রী মুমূর্ষু, ছেলের মৃত্যুসংবাদ তিনি শোনেননি । তাঁকে কিছু জানানো হয়নি । এখনও তিনি তাকে দেখবার আশা করে আছেন —সেই জন্যই বুঝি তিনি মৃত্যুতেও শান্তি পেতে পাচ্ছেন না । শোভনকে তাঁর হারানো ছেলে হয়ে একবার দেখা দিতে হবে । মুমূর্ষর নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে কোনো কিছু ধরা পড়বে না । হারানো ছেলের সঙ্গে তার সত্যি সাদৃশ্য আছে । মৃত্যুপথযাত্রীকে এই শেষ সান্ত্বনাটুকু দেবার জন্যে জমিদার নিজে তাঁকে কাতর অনুরোধ জানিয়েছেন । তার এতে কোনো ক্ষতি নেই .......
নায়েবমশাই নোটের তাড়াটা শোভনের হাতে গুঁজে দিলেন ।
সোমেশ চুপ করিল । খানিকক্ষণ বাইরের বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নাই । আমি অবশেষে বলিলাম— 'সোমেশ তোমার কানের কাছে একটা জড়ুল আছে ।'
সোমেশ হাসিয়া বলিল,— 'সেই জন্যেই গল্প বানানো সহজ হলো ।'
কিন্তু কেন বলা যায় না—শীতের বাদলের এই শীতল প্রায়ান্ধকার অস্বাভাবিক অপরাহ্ণে তার হাসিটাই বিশ্বাস করিতে আমার প্রবৃত্তি হইল না ।
*****