নব নব সৃষ্টি — সৈয়দ মুজতবা আলী

Submitted by avimanyu pramanik on Thu, 07/22/2021 - 21:22

নব নব সৃষ্টি — সৈয়দ মুজতবা আলী

সংস্কৃত ভাষা আত্মনির্ভরশীল । কোনো নূতন চিন্তা, অনুভূতি কিংবা বস্তুর জন্য নবীন শব্দের প্রয়োজন হলে সংস্কৃত ধার করার কথা না ভেবে আপন ভান্ডারে অনুসন্ধান করে, এমন কোনো ধাতু বা শব্দ সেখানে আছে কি না যার সামান্য অদল বদল করে কিংবা পুরোনো ধাতু দিয়ে নবীন শব্দটি নির্মাণ করা যায় কি না । তার অর্থ অবশ্য এ নয় যে, সংস্কৃত কস্মিনকালেও বিদেশি কোনো শব্দ গ্রহণ করেনি । নিয়েছে, কিন্তু তার পরিমাণ এতই মুষ্টিমেয় যে, সংস্কৃতকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষা বলাতে কারও কোনো আপত্তি থাকার কথা নয় ।

প্রাচীন যুগের সব ভাষাই তাই । হিব্রু, গ্রিক, আবেস্তা এবং ঈষৎ পরবর্তী যুগের আরবিও আত্মনির্ভরশীল এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বয়ংসম্পূর্ণ ।

বর্তমান যুগের ইংরেজি ও বাংলা আত্মনির্ভরশীল নয় । আমরা প্রয়োজন মতো এবং অপ্রয়োজনেও ভিন্ন ভিন্ন ভাষা থেকে শব্দ নিয়েছি এবং নিচ্ছি । পাঠান-মোগল যুগে আইন-আদালত খাজনা-খারিজ নূতন রূপে দেখা দিল বলে আমরা আরবি ও ফার্সি থেকে প্রচুর শব্দ গ্রহণ করেছি । পরবর্তী যুগে ইংরেজি থেকে ইংরেজির মারফতে অন্যান্য ভাষা থেকে নিয়েছি এবং নিচ্ছি ।

বিদেশি শব্দ নেওয়া ভালো না মন্দ সে প্রশ্ন অবান্তর । নিয়েছি এবং এখনও সজ্ঞানে আপন খুশিতে নিচ্ছি এবং শিক্ষার মাধ্যমরূপে ইংরেজিকে বর্জন করে বাংলা নেওয়ার পর যে আরও প্রচুর ইউরোপীয় শব্দ আমাদের ভাষায় ঢুকবে, সে সম্বন্ধেও কারও কোনো সন্দেহ নেই । আলু-কপি আজ রান্নাঘর থেকে তাড়ানো মুশকিল, বিলিতি ওষুধ প্রায় সকলেই খান, ভবিষ্যতে আরও নূতন নূতন ওষুধ খাবেন বলেই মনে হয় । এই দুই বিদেশি বস্তুর ন্যায় আমাদের ভাষাতেও বিদেশি শব্দ থেকে যাবে, নূতন আমদানিও বন্ধ করা যাবে না ।

পৃথিবীতে কোনো জিনিসই সম্পূর্ণ অসম্ভব নয় । অন্তত চেষ্টা করাটা অসম্ভব নাও হতে পারে । হিন্দি উপস্থিত সেই চেষ্টাটা করছেন—বহু সাহিত্যিক উঠে পড়ে লেগেছেন, হিন্দি থেকে আরবি, ফার্সি এবং ইংরেজি শব্দ তাড়িয়ে দেবার জন্য । চেষ্টাটার ফল আমি হয়তো দেখে যেতে পারব না । আমার তরুণ পাঠকেরা নিশ্চয়ই দেখে যাবেন । ফল যদি ভালো হয় তখন তাঁরা না হয় চেষ্টা করে দেখবেন । (বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ সচ্ছন্দে লিখেছেন, 'আব্রু দিয়ে, ইজ্জৎ দিয়ে, ইমান দিয়ে, বুকের রক্ত দিয়ে ।' নজরুল ইসলাম 'ইনকিলাব'— 'ইনক্লাব' নয়— এবং 'শহিদ' শব্দ বাংলায় ঢুকিয়ে গিয়েছেন । বিদ্যাসাগর 'সাধু' রচনায় বিদেশি শব্দ ব্যবহার করতেন না, বেনামিতে লেখা 'অসাধু' রচনায় চুটিয়ে আরবি-ফার্সি ব্যবহার করতেন । আর অতিশয় নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পণ্ডিত হরপ্রসাদ আরবি-ফার্সি শব্দের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করা 'আহাম্মুখী' বলে মনে করতেন । 'আলাল' ও 'হুতোম' -এর ভাষা বিশেষ উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল; সাধারণ বাংলা এ-স্রোতে গা ঢেলে দেবে না বলে তার উল্লেখ এস্থলে নিষ্প্রয়োজন এবং হিন্দির বঙ্কিম স্বয়ং প্রেমচন্দ্র হিন্দিতে বিস্তর আরবি-ফার্সি ব্যবহার করেছেন ।)

এস্থলে আর একটি কথা বলে রাখা ভালো । রচনার ভাষা তার বিষয়বস্তুর উপর নির্ভর করে । শংকরদর্শনের আলোচনায় ভাষা সংস্কৃতশব্দবহুল হবেই, পক্ষান্তরে মোগলাই রেস্তোরাঁর বর্ণনাতে ভাষা অনেকখানি 'হুতোম'-ঘ্যাঁষা হয়ে যেতে বাধ্য । 'বসুমতী'র সম্পাদকীয় রচনার ভাষা এক—তাতে আছে গাম্ভীর্য, 'বাঁকা চোখে'র ভাষা ভিন্ন—তাতে থাকে চটুলতা ।

বাংলায় যে-সব বিদেশি শব্দ ঢুকেছে তার ভিতরে আরবি,ফার্সি এবং ইংরেজিই প্রধান । সংস্কৃত শব্দ বিদেশি নয়, এবং পোর্তুগিজ, ফরাসি ,স্প্যানিশ শব্দ এতই কম যে, সেগুলো নিয়ে অত্যধিক দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই ।

বাংলা ভিন্ন অন্য যে-কোনো ভাষার চর্চা আমরা করি না কেন, সে ভাষার শব্দ বাংলাতে ঢুকবেই । সংস্কৃত চর্চা এদেশে ছিল বলে বিস্তর সংস্কৃত শব্দ বাংলায় ঢুকেছে, এখনও আছে বলে অল্পবিস্তর ঢুকছে, যতদিন থাকবে ততদিন আরও ঢুকবে বলে আশা করতে পারি । স্কুল-কলেজ থেকে যে আমরা সংস্কৃত চর্চা উঠিয়ে দিতে চাই না তার অন্যতম প্রধান কারণ বাংলাতে এখনও আমাদের বহু সংস্কৃত শব্দের প্রয়োজন, সংস্কৃত চর্চা উঠিয়ে দিলে আমরা অন্যতম প্রধান খাদ্য থেকে বঞ্চিত হব ।

ইংরেজির বেলাতেও তাই । বিশেষ করে দর্শন, নন্দনশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা ইত্যাদি জ্ঞান এবং ততোধিক প্রয়োজনীয় বিজ্ঞানের শব্দ আমরা চাই । রেলের ইঞ্জিন কী করে চালাতে হয়, সে সম্বন্ধে বাংলাতে কোনো বই আছে বলে জানি নে, তাই এসব টেকনিক্যাল শব্দের প্রয়োজন যে আরও কত বেশি সে সম্বন্ধে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা এখনও আমাদের মনের মধ্যে নেই । সুতরাং ইংরেজি চর্চা বন্ধ করার সময় এখনও আসেনি ।

একমাত্র আরবি-ফার্সি শব্দের বেলা অনায়াসে বলা যেতে পারে যে, এই দুই ভাষা থেকে ব্যাপকভাবে আর নূতন শব্দ বাংলাতে ঢুকবে না । পশ্চিম বাংলাতে আরবি-ফার্সি চর্চা যাবো-যাবো করছে, পূর্ব বাংলায়ও এ-সব ভাষার প্রতি তরুণ সম্প্রদায়ের কৌতুহল অতিশয় ক্ষীণ বলে তার আয়ু দীর্ঘ হবে বলে মনে হয় না এবং শেষ কথা, আরব-ইরানে অদূর ভবিষ্যতে যে হঠাৎ কোনো অভূতপূর্ব জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা আরম্ভ হয়ে বাংলাকে প্রভাবিত করবে তার সম্ভাবনাও নেই ।

কিন্তু যে-সব আরবি-ফার্সি শব্দ বাংলাতে ঢুকে গিয়েছে তার অনেকগুলো যে আমাদের ভাষাতে আরও বহুকাল ধরে চালু থাকবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই এবং দ্বিতীয়ত কোনো কোনো লেখক নূতন বিদেশি শব্দের সন্ধান বর্জন করে পুরোনো বাংলার— 'চন্ডী' থেকে আরম্ভ করে 'হুতোম' পর্যন্ত—অচলিত আরবি-ফার্সি শব্দ তুলে নিয়ে সেগুলো কাজে লাগাবার চেষ্টা করছেন । কিছুদিন পূর্বেও এই এক্সপেরিমেন্ট করা অতিশয় কঠিন ছিল, কিন্তু অধুনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে অনেক ছাত্র-ছাত্রীকে বাধ্য হয়ে পুরোনো বাংলা পড়তে হয়— তারা এই সব শব্দের অনেকগুলো অনায়াসে বুঝতে পারবে বলে অচলিত অনেক আরবি-ফার্সি শব্দ নূতন মেয়াদ পাবে ।

এই পরিস্থিতির সামনে জীবন্মৃত এসব শব্দের একটা নূতন খতেন নিলে ভালো হয় ।

ভারতীয় মক্তব-মাদ্রাসায় যদিও প্রচুর পরিমাণে আরবি ভাষা পড়ানো হয়েছিল, তবু কার্যত দেখা গেল ভারতীয় আর্যগণ ইরানি আর্য সাহিত্য অর্থাৎ ফার্সির সৌন্দর্যে অভিভূত হলেন বেশি । উর্দু সাহিত্যের মূল সুর তাই ফার্সির সঙ্গে বাঁধা—আরবির সঙ্গে নয় । হিন্দি গদ্যের উপরও বাইরের যে প্রভাব পড়েছে সেটা ফার্সি—আরবি নয় ।

একদা ইরানে যে রকম আর্য ইরানি ভাষা ও সেমিতি আরবি ভাষার সংঘর্ষে নবীন ফার্সি জন্মগ্রহণ করেছিল, ভারতবর্ষে সেই সংঘর্ষের ফলে সিন্ধি, উর্দু ও কাশ্মীরি সাহিত্যের সৃষ্টি হয় । কিন্তু আরবির এই সংঘর্ষ ফার্সির মাধ্যমে ঘটেছিল বলে কিংবা অন্য যে-কোনো কারণেই হোক, ভারতবর্ষীয় এ তিন ভাষা ফার্সির মতো নব নব সৃষ্টি দিয়ে ঐশ্বর্যশালী সাহিত্যসৃষ্টি করতে পারল না । উর্দুতে কবি ইকবালই এ তত্ত্ব সম্যক হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন ও নূতন সৃষ্টির চেষ্টা করে উর্দুকে ফার্সির অনুকরণ থেকে কিঞ্চিৎ নিষ্কৃতি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন ।

বাঙালির সর্বশেষ্ঠ সাহিত্যসৃষ্টি তার পদাবলি কীর্তনে । এ সাহিত্যের প্রাণ এবং দেহ উভয়ই খাঁটি বাঙালি । এ সাহিত্যে শুধু যে মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণ বাংলায় খাঁটি কানুরূপ ধারণ করেছেন তাই নয়, শ্রীমতি শ্রীরাধাও যে একেবারে খাঁটি বাঙালি মেয়ে সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই । ভাটিয়ালির নায়িকা, বাউলের ভক্ত, মুরশিদিয়ার আশিক ও পদাবলির শ্রীরাধা একই চরিত্র একই রূপে প্রকাশ পেয়েছেন ।

বাঙালির চরিত্রে বিদ্রোহ বিদ্যমান । তার অর্থ এই যে, কী রাজনীতি, কী ধর্ম, কী সাহিত্য, যখনই যেখানে সে সত্য শিব সুন্দরের সন্ধান পেয়েছে তখনই সেটা গ্রহণ করতে চেয়েছে; এবং তখন কেউ 'গতানুগতিক পন্থা' 'প্রাচীন ঐতিহ্য' -এর দোহাই দিয়ে সে প্রচেষ্টায় বাধা দিতে গেলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে । এবং তার চেয়েও বড়ো কথা,—যখন সে বিদ্রোহ উচ্ছৃঙ্খলতায় পরিণত হতে চেয়েছে, তখন তার বিরুদ্ধে আবার বিদ্রোহ করেছে । 

এ বিদ্রোহ বাঙালি হিন্দুর ভিতরই সীমাবদ্ধ নয় । বাঙালি মুসলমানও এ কর্মে পরম তৎপর । ধর্ম বদলালেই জাতির চরিত্র বদলায় না । 

( সংক্ষেপিত ও সম্পাদিত)

******

Comments

Related Items

কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি কাব্যাংশে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ছবি কিভাবে ধরা পড়েছে তা লেখ ।

প্রশ্ন: কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি কাব্যাংশে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ছবি কিভাবে ধরা পড়েছে তা লেখ

'দাম' গল্পে সুকুমার কোন উপলব্ধিতে পৌঁছেছে তা আলোচনা কর ।

প্রশ্ন : 'দাম' গল্পে সুকুমার কোন উপলব্ধিতে পৌঁছেছে তা আলোচনা কর

ইলিয়াসের জীবনে কিভাবে বিপর্যয় ঘনিয়ে এসেছিল ?

প্রশ্ন:-  ইলিয়াসের জীবনে কিভাবে বিপর্যয় ঘনিয়ে এসেছিল ?

"এটা খুব জ্ঞানের কথা'' । —কার কোন কথাকে জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে ? এবং কেন ?

প্রশ্ন : "এটা খুব জ্ঞানের কথা'' । —কার কোন কথাকে জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে ? এবং কেন ?

হিমালয় দর্শন — বেগম রোকেয়া

হিমালয় দর্শন  — বেগম রোকেয়া