আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে বক্তৃতাদান

Submitted by administrator on Mon, 04/01/2013 - 07:48

আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে বক্তৃতাদান:-

শিকাগো আর্ট ইনস্টিটিউটে ১৮৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে ধর্মসভা শেষ হবার পর বিবেকানন্দ পুরো দুই বছর পূর্ব ও কেন্দ্রীয় যুক্তরাষ্ট্রে বিশেষ করে শিকাগো, ডেট্রয়েট, বোস্টন এবং নিউইয়র্কে বক্তৃতা দেন । ১৮৯৫ সালের বসন্তকালের মধ্যে তাঁর অব্যাহত প্রচেষ্টার কারণে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন এবং তাঁর স্বাস্থ্য হয়ে পড়ে দুর্বল । তাঁর বক্তৃতাদান সফর স্থগিত করার পর স্বামীজি বেদান্ত ও যোগের উপর বিনা মূল্যে ব্যক্তি পর্যায়ে শিক্ষা দেয়া শুরু করেন । ১৮৯৫ সালের জুন থেকে দুই মাসব্যপী তিনি থাউজ্যান্ড আইল্যান্ড পার্কে তাঁর এক ডজন শিষ্যকে ব্যক্তি পর্যায়ে শিক্ষা দেয়ার জন্য ভাষণ দেন । বিবেকানন্দ এটিকে আমেরিকায় তাঁর প্রথম ভ্রমণের সবচেয়ে সুখী অংশ বলে বিবেচনা করতেন । তিনি পরে "নিউইয়র্ক বেদান্ত সোসাইটি" প্রতিষ্ঠা করেন । আমেরিকায় তাঁর প্রথম পরিদর্শনের সময় তিনি ইংল্যান্ডে ভ্রমণ করেন দুইবার- ১৮৯৫ এবং ১৮৯৬ সালে । সেখানে তাঁর বক্তৃতাসমূহ সফল ছিল । এখানে তিনি সাক্ষাৎ পান এক আইরিশ মহিলা মিস মার্গারেট নোবলের যিনি পরে সিস্টার নিবেদিতা নামে পরিচিত হন । ১৮৯৬ সালের মে মাসে তাঁর দ্বিতীয় ভ্রমণের সময় পিমলিকোতে এক গৃহে অবস্থানকালে স্বামীজি দেখা পান অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিখ্যাত ভারত বিশেষজ্ঞ ম্যাক্স মুলারের যিনি পাশ্চাত্যে রামকৃষ্ণের প্রথম আত্মজীবনী লেখেন । ইংল্যান্ড থেকে তিনি অন্যান্য ইউরোপিয়ান দেশেও ভ্রমণ করেন । জার্মানীতে তিনি আরেক ভারত বিশেষজ্ঞ পল ডিউসেনের সাথে সাক্ষাৎ করেন । তিনি দুটি শিক্ষায়তনিক প্রস্তাবও পান, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্য দর্শনের চেয়ার এবং কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও একই ধরণের প্রস্তাব । তিনি উভয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে পরিভ্রমণকারী সন্ন্যাসী হিসেবে তিনি এই ধরণের কাজে স্থিত হতে পারবেন না ।  তিনি কতিপয় অকৃত্রিম শিষ্যকে আকৃষ্ট করেন । তাঁর অন্যান্য শিষ্যদের মধ্যে ছিল জোসেফিন ম্যাকলিয়ড, মিস মুলার, মিস নোবল, ই.টি.স্টার্ডি, ক্যাপটেন এবং মিসেস সেভিয়ের- যারা অদ্বৈত আশ্রম প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন জে জে গুডউইন- যিনি তাঁর স্টেনোগ্রাফার হন এবং তাঁর শিক্ষা ও বক্তৃতাসমূহ রেকর্ড করেন । হেল ফ্যামিলি আমেরিকাতে তাঁর উষ্ণতম আতিথ্য কর্তাদের অন্যতম ছিলেন । তাঁর শিষ্যগণ-ফ্রেঞ্চ মহিলা ম্যাডাম লুই হন স্বামী অভয়ানন্দ এবং মিস্টার লিয়ন ল্যান্ডসবার্গ হন স্বামী কৃপানন্দ । তিনি কতিপয় অন্যান্য শিষ্যকে ব্রহ্মচারীতে দীক্ষা দেন । স্বামী বিবেকানন্দের ধারণাসমূহ বেশ কয়েকজন পন্ডিত ও বিখ্যাত চিন্তাবিদ কর্তৃক প্রশংসিত হয়- উইলিয়াম জেমস, জোসেফ রয়েস, সি.সি. এভারেট, হার্ভার্ড ধর্মশাস্ত্র বিদ্যালয়ের ডিন, রবার্ট জি ইনগারসোল, নিকোলা টেসলা, লর্ড কেলভিন এবং অধ্যাপক হারম্যান লুডউইক ফারডিন্যান্ড ভন হেলমহোলটজ । অন্যান্য ব্যক্তিত্ব যারা তাঁর কথাবার্তায় আকৃষ্ট হন তারা হলেন হ্যারিয়েট মনরো এবং এলা হুইলার উইলকক্স-দুজন বিখ্যাত আমেরিকান কবি, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উইলিয়াম জেমস; ব্রুকলিন এথিক্যাল এসোসিয়েশনের সভাপতি ডক্টর লুইজ জি জেনস; নরওয়ের পিয়ানোবাদক ওলে বুলের স্ত্রী সারা সি বুল; ফ্রান্সের অভিনেত্রী সারাহ বার্ণহারট এবং ফ্রান্সের অপেরা সঙ্গীতশিল্পী ম্যাডাম এমা ক্যালভি । পশ্চিমে থেকেও তিনি তাঁর ভারতীয় কাজে গতি আনেন । বিবেকানন্দ ভারতে অবস্থানরত তাঁর অনুসারী ও সন্ন্যাসী ভাইদের উপদেশ দিয়ে এবং অর্থ পাঠিয়ে বিরামহীনভাবে চিঠি লেখেন । পাশ্চাত্য থেকে পাঠানো তাঁর চিঠিসমূহ সে দিনগুলিতে সামাজিক কাজের জন্য তাঁর প্রচারাভিযানের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছিল । তিনি ভারতে তাঁর নিকট শিষ্যদের বড় কিছু করার জন্য অনুপ্রাণিত করতে ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যান ।  তাদের নিকট পাঠানো তাঁর চিঠিসমূহে তাঁর  সবচেয়ে কঠিন কিছু শব্দ ছিল । এ রকম একটি চিঠিতে তিনি স্বামী অক্ষরানন্দকে লিখেছিলেন, "খেতরী শহরের দরিদ্র ও নিচু শ্রেণীর ঘরে ঘরে যাও এবং তাদের ধর্মশিক্ষা দাও । ভূগোল এবং অন্যান্য বিষয়েও তাদের মৌখিক শিক্ষা দিও । অলসভাবে বসে থেকে, রাজকীয় খাবার খেয়ে আর "রামকৃষ্ণ, ও প্রভু !" বলে ভাল কিছু হবে না- যদি না তুমি দরিদ্রদের জন্য ভাল কিছু করতে পার ।" পরিণামস্বরুপ ১৮৯৫ সালে বেদান্ত শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিবেকানন্দের সরবরাহকৃত অর্থে মাদ্রাজে "ব্রহ্মাবদীন" নামে এক সাময়িকপত্র প্রকাশ করা শুরু হয়েছিল । পরবর্তীকালে (১৮৮৯) "ব্রহ্মাবদীনে" "দি ইমিটেশন অফ ক্রাইস্ট" এর প্রথম ছয় অধ্যায়ের বিবেকানন্দকৃত অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল ।  বিবেকানন্দ তাঁর শিষ্য ক্যাপ্টেন এবং মিসেস সেভিয়ের ও জে জে গুডউইনকে নিয়ে ১৮৯৬ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ইংল্যান্ড ছেড়ে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন । পথিমধ্যে তারা ফ্রান্স ও ইটালী ভ্রমণ করেন এবং লিওনার্ডো ডা ভিঞ্চির দি লাস্ট সাপার দর্শন করে ১৮৯৬ সালের ৩০শে ডিসেম্বর ভারতের উদ্দেশ্যে ন্যাপলস বন্দর ত্যাগ করেন । পরবর্তীতে মিস মুলার এবং সিস্টার নিবেদিতা ভারতে তাঁকে অনুসরণ করেন । সিস্টার নিবেদিতা তার বাকী জীবন ভারতীয় নারীদের শিক্ষায় এবং ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে নিয়োজিত করেন ।

***

 

Comments

Related Items