Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 01/04/2021 - 22:31

হিন্দু মেলা (Hindu Mela) :-

ঊনিশ শতকে বাংলায় যেসমস্ত রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল 'হিন্দুমেলা' । পণ্ডিত রাজনারায়ণ বসুর অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় নবগোপাল মিত্র ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে চৈত্রসংক্রান্তির দিন কলকাতায় 'হিন্দুমেলা' -র প্রতিষ্ঠা করেন । এজন্য সংগঠনটি 'চৈত্রমেলা' নামেও পরিচিত ছিল । হিন্দু মেলার প্রথম সম্পাদক ছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সহকারী সম্পাদক ছিলেন নবগোপাল মিত্র । হিন্দুমেলার সদস্যদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিলেন রাজা কমলকৃষ্ণ বাহাদুর, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, রমানাথ ঠাকুর, পিয়ারি চরণ সরকার, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কৃষ্টদাস পাল প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ । হিন্দুমেলা প্রসঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বাল্যকথায় লিখেছেন "কলিকাতার প্রান্তবর্তী কোনো একটি উদ্যানে বৎসরে তিন-চার দিন ধরে এই মেলা চলত । সেখানে দেশি জিনিসের প্রদর্শনী, জাতীয় সংগীত, বক্তৃতাদি বিভিন্ন উপায়ে লোকের দেশানুরাগ উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা হত ।"

ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার হিন্দুমেলার তিনটি উদ্দেশ্য ছিল বলে উল্লেখ করেছেন । এগুলি হল — (i) জাতীয় ভাবের প্রসার ঘটানো, (ii) দেশাত্মবোধ সৃষ্টি করা, এবং (iii) হিন্দুদের মধ্যে আত্মনির্ভরশীলতার মনোভাব গঠন করা । গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দুমেলার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন— "আমাদের এই মিলন সাধারণ ধর্মকর্মের জন্য নহে, কোনো বিষয় সুখের জন্য নহে, কোনো আমোদপ্রমোদের জন্যও নহে, ইহা স্বদেশের জন্য, ইহা ভারত ভূমির জন্য ।" গবেষক যোগেশচন্দ্র বাগল 'হিন্দুমেলার ইতিবৃত' রচনায় মেলার প্রথম অধিবেশনের এক বিবরণ দিয়েছেন । এই বিবরণ থেকে জানা যায়, হিন্দু মেলার উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ছয়টি কমিটি গঠিত হয় । প্রথম কমিটির কাজ ছিল হিন্দুদের মধ্যেকার বিদ্বেষভাব দূর করে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা । দ্বিতীয় কমিটির কাজ ছিল এক বছরে সমাজের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের বিবরণী তৈরি করা । তৃতীয় কমিটির কাজ ছিল দেশীয় বিদ্যাশিক্ষার উন্নতি ও প্রসারে নিয়োজিত স্বদেশিদের সম্মান জানানো । চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ কমিটিগুলির কাজ ছিল দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে শিল্পজাত পণ্য সংগ্রহ করে সেগুলি মেলায় প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা ।

জাতীয়তার আদর্শ ও উদ্দেশ্যগুলিকে জনসমক্ষে প্রচার করার জন্য হিন্দুমেলা 'ন্যাশনাল পেপার' নামে এক পত্রিকা প্রকাশ করে এবং এই পত্রিকার ছাপাখানার নাম দেওয়া হয় 'ন্যাশনাল প্রেস' । এ ছাড়াও হিন্দুমেলার তত্ত্বাবধানে একটি ন্যাশনাল স্কুল ও একটি ন্যাশনাল জিমনেশিয়াম গড়ে তোলা হয় । হিন্দুমেলা উপলক্ষে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত গান "মিলে সব ভারত সন্তান এক তান মান প্রাণ, গাও ভারতের যশোগান", মনোমোহন বসুর রচিত গান "দিনের দিন সবে দীন ভারত হয়ে পরাধীন" এবং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত গান "লজ্জায় ভারত যশ গাহিব কী করে" ইত্যাদি স্বদেশি ভাবনার প্রসারে সাহায্য করে । স্বদেশবাসীর স্বজাত্যবোধ চেতনা ও স্বাবলম্বন বৃত্তির উন্মেষে এই মেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় । তাই এই মেলার দ্বিতীয় অধিবেশনে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন "হিন্দুমেলা হল খাঁটি স্বদেশি মেলা ।"

হিন্দুমেলার পরবর্তীকালে 'ভারত্সভা' -র প্রতিষ্ঠার পর ভারতসভা সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠলে হিন্দুমেলা ক্রমে গুরুত্বহীন হয়ে পড়তে থাকে । 

*****

Comments

Related Items

'হুতোম প্যাঁচার নকশা' গ্রন্থে উনিশ শতকের বাংলার কীরূপ সমাজচিত্র পাওয়া যায় ?

প্রশ্ন : 'হুতোম প্যাঁচার নকশা' গ্রন্থে উনিশ শতকের বাংলার কীরূপ সমাজচিত্র পাওয়া যায় ?

স্বাধীনতার পরে ভাষার ভিত্তিতে ভারত কীভাবে পুনর্গঠিত হয়েছিল ?

প্রশ্ন : স্বাধীনতার পরে ভাষার ভিত্তিতে ভারত কীভাবে পুনর্গঠিত হয়েছিল ?

দলিত আন্দোলন বিষয়ে গান্ধি-আম্বেদকর বিতর্ক নিয়ে একটি টীকা লেখ ।

প্রশ্ন : দলিত আন্দোলন বিষয়ে গান্ধি-আম্বেদকর বিতর্ক নিয়ে একটি টীকা লেখ ।

কারিগরি শিক্ষার বিকাশে 'বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট' -এর কী ভূমিকা ছিল ?

প্রশ্ন : কারিগরি শিক্ষার বিকাশে 'বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট' -এর কী ভূমিকা ছিল ?

ছাপা বইয়ের সঙ্গে শিক্ষাবিস্তারের সম্পর্ক বিশ্লেষণ কর ।

প্রশ্ন : ছাপা বইয়ের সঙ্গে শিক্ষাবিস্তারের সম্পর্ক বিশ্লেষণ কর ।