সানফ্রান্সিসকো সম্মেলন ও সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের উৎপত্তি

Submitted by avimanyu pramanik on Thu, 04/26/2012 - 18:02

সানফ্রান্সিসকো সম্মেলন ও সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের উৎপত্তি (San Francisco Conference)

১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে এবং ২৬শে জুন সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের রূপরেখাকে চূড়ান্ত রূপ দিতে আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো শহরে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন বসে । এই সম্মেলনে বিশ্বের ৫১টি দেশের প্রতিনিধিবৃন্দ সম্মিলিতভাবে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের গঠন ও কার্যাবলী সংক্রান্ত একটি দলিলে স্বাক্ষর করেন যেটি 'সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সনদ' (United Nation Charter) নামে অভিহিত হয় । এই ৫১টি দেশকে জাতিপুঞ্জের প্রাথমিক সদস্যরূপে (Original Member of United Nation) গণ্য করা হয় । এই সনদে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, গঠন এবং কর্মধারা স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয় । ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে অক্টোবর থেকে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ আনুষ্ঠানিক ভাবে কাজ শুরু করে ।

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ১নং ধারাতে চারটি প্রধান উদ্দেশ্যের কথা বলা হয় —

(১) আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য যুদ্ধের বীজ পৃথিবী থেকে বিনষ্ট করা ।

(২) পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির সমানাধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রকে বিশ্ব পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করা ও জাতিগুলির মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও সদ্ভাব গড়ে তোলা । মানবতা সংক্রান্ত সমস্যাদির সমাধান এবং মানুষের মৌলিক অধিকারগুলির প্রতি মর্যাদা দানের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ব্যবস্থা করা ।

(৩) বিশ্বের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং বৈজ্ঞানিক উন্নতির দ্বারা বিশ্বমানবের মধ্যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সম্প্রসারিত করা ।

(৪) এই সব লক্ষ্য পূরণে এবং জাতিসমূহের কর্মপ্রয়াসকে সংহত করার লক্ষ্যে একটি স্থায়ী কেন্দ্র গড়ে তোলা । 

মোট কথা যুদ্ধমুক্ত সুখী পৃথিবীর স্বপ্ন বাস্তবায়িত করাই হল সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের প্রধান লক্ষ্য ।

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের নীতি :

(১) সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ কিংবা তার সদস্য রাষ্ট্র অন্য কোনো সদস্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না ।

(২) সকল সদস্য রাষ্ট্রই বিশ্বশান্তি, নিরাপত্তা ও ন্যায় বিচারকে লঙ্ঘন না করেই সকল আন্তর্জাতিক বিবাদের শান্তিপূর্ণ মিমাংসা করবে । তারা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শনের নীতি থেকে বিরত থাকবে ।

(৩) জাতিপুঞ্জের সনদ অনুসারে সকল সদস্য রাষ্ট্রই এই বিশ্ব সংস্থাকে তার কাজে সাহায্য করবে এবং এই সংস্থা যদি কোনো রাষ্ট্রের প্রতি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে তবে কোনো ভাবেই তার পাশে দাঁড়াবে না ।

(৪) বিশ্বশান্তি যাতে কোনো রূপেই বিঘ্নিত না হয় সেজন্য যে সব রাষ্ট্র জাতিপুঞ্জের সদস্য নয় সমিলিত জাতিপুঞ্জ তাদের যথাযত তার সনদ মেনে চলতে প্রয়াস চালাবে ।

(৫) জাতিপুঞ্জের সকল সদস্য রাষ্ট্র সম মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের অধিকারী ।

সদস্যপদ গ্রহণ : পৃথিবীর যে কোনো শান্তিকামী রাষ্ট্রই জাতিপুঞ্জের সদস্যপদ গ্রহণ করতে পারে । শুরুতে ৫১টি রাষ্ট্র এর সদস্য হয়েছিল । পরে নিরাপত্তা পরিষদের সুপারিশ ক্রমে সাধারণ পরিষদের অনুমোদন লাভ করে আরও অনেক দেশ এর সদস্য হয় । বর্তমানে জাতিপুঞ্জের সদস্য দেশের সংখ্যা ১৯৩ । নিরাপত্তা পরিষদ ইচ্ছা করলে সাধারণ পরিষদের কাছে কোনো দেশের সদস্যপদ বাতিলের সুপারিশ করতে পারে ।

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (U.N.O) প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন পর্যায়

১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ঘটনাপুঞ্জের নানা ঘাতপ্রতিঘাতের বিবর্তনের মধ্য দিয়েই সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের উৎপত্তি হয়েছে । ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে ইংল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিনিধিগণ লন্ডন ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করেন । ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৯ই আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে প্রিন্স অফ ওয়েলস নামে একটি যুদ্ধজাহাজে পৃথিবীতে স্থায়ী শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে একটি আট দফা সুত্র সম্বলিত আটলান্টিক সনদ (Atlantic charter) নামে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন । এই সনদে যে আটটি নীতির কথা বলা হয়েছিল তার মধ্যে ভবিষ্যৎ জাতিপুঞ্জের বীজ সুপ্ত ছিল । পরবর্তী সময়ে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ওয়াশিংটন সম্মেলনে ২৬টি দেশের প্রতিনিধিবর্গ আটলান্টিক সনদের মূল নীতিগুলি মেনে নিয়ে ‘সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ঘোষণাপত্র‘ নামক এক দলিলে স্বাক্ষর করেন । ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে ডাম্বারটন ওকস সম্মেলনে এই ব্যবস্থাকে সমর্থন জানিয়ে একটি রূপরেখা তৈরি করা হয় । অবশেষে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো শহরে বিশ্বের ৫১টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিবর্গ মিলিত হয়ে জাতিপুঞ্জের সনদে প্রথম স্বাক্ষর করেন ও ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে অক্টোবর থেকে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ আনুষ্ঠানিক ভাবে কাজ শুরু করে । সেই জন্য ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে অক্টোবর সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসাবে পালন করা হয় ।

*****

Related Items

শ্রীরামপুর মিশন প্রেস কিভাবে একটি অগ্রনী মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল ?

প্রশ্ন : শ্রীরামপুর মিশন প্রেস কিভাবে একটি অগ্রনী মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল ?

উঃ- ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৩৮ বছর বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনায় শ্রীরামপুর মিশনের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।

বাংলায় মুদ্রণ শিল্পের বিকাশে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের কীরূপ অবদান ছিল ?

প্রশ্ন : বাংলায় মুদ্রণ শিল্পের বিকাশে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের কীরূপ অবদান ছিল ?

১৮৫৭ -এর মহাবিদ্রোহকে কি সামন্ত-শ্রেণির বিদ্রোহ বলা যায় ?

প্রশ্ন : ১৮৫৭ -এর মহাবিদ্রোহকে কি সামন্ত-শ্রেণির বিদ্রোহ বলা যায় ?

উঃ- ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের সময় থেকেই এই বিদ্রোহের চরিত্র বা প্রকৃতি নিয়ে বিভিন্ন ধারার ইতিহাসচর্চার নানা ধরনের গবেষণালব্দ মতামত পাওয়া যায় ।

কী উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক সরকার অরণ্য আইন প্রণয়ন করেন ?

প্রশ্ন : কী উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক সরকার অরণ্য আইন প্রণয়ন করেন ?

এদেশের চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে কলিকাতা মেডিকেল কলেজের কীরূপ ভূমিকা ছিল ?

প্রশ্ন : এদেশের চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে কলিকাতা মেডিকেল কলেজের কীরূপ ভূমিকা ছিল ?