মহাবিদ্রোহের বিস্তার ও জনগণের অংশ গ্রহণ

Submitted by administrator on Wed, 05/15/2013 - 22:11

মহাবিদ্রোহের বিস্তার :-

(১) মঙ্গল পান্ডের নেতৃত্বে কলকাতার উত্তরে ব্যারাকপুরে সিপাহি বিদ্রোহ প্রথমে শুরু হয় ।

(২) এই বিদ্রোহের সংবাদ লক্ষ্ণৌ -এর সিপাহিদেরও সংক্রামিত করেছিল ।

(৩) লক্ষ্ণৌ -এর পরে বিদ্রোহ মীরাটে প্রসারিত হয় । ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে এপ্রিল মীরাট সেনা ছাউনিতে ৮০ জন সৈনিক প্রকাশ্যে ওই কার্তুজ ব্যবহার করতে অস্বীকার করে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ।

(৪) মীরাট থেকে এই বিদ্রোহ দ্রুত গতিতে দিল্লীতে ছড়িয়ে পড়ে । দিল্লীতে সিপাহিরা স্ত্রী-পুরুষ-শিশু নির্বিচারে ইংরেজদের হত্যা করে । দিল্লি পৌঁছে বিদ্রোহীরা লাল কেল্লা দখল করে । পরে বৃদ্ধ বাহাদুর শাহকে সিংহাসনে বসিয়ে তাঁকে দিল্লির বাদশারূপে ঘোষণা করেন । 

(৫) এর পর বিদ্রোহ গাঙ্গেয় প্রদেশগুলিতে ও মধ্যভারতে ছড়িয়ে পড়ে । ফিরোজপুর, মজফ্‌ফর নগর ও আলিগড়ে সিপাহিরা বিদ্রোহী হয় ।

(৬) এরপর পাঞ্জাবের অন্তর্গত নৌসরা ও হতমর্দনেও বিদ্রোহ সংক্রমিত হয় । অযোধ্যা ও উত্তরপ্রদেশের নানা অঞ্চলে বিদ্রোহ তীব্র আকার ধারণ করে । অযোধ্যার সম্পত্তিচ্যুত তালুকদাররা বিদ্রোহে যোগ দেন ।

(৭) রোহিলাখন্ডের পূর্বতন সর্দাররা এই বিদ্রোহে যোগ দেন । এদের মধ্যে বেরিলির খান বাহাদুর, নাজিরাবাদের মহম্মদ খাঁ, গোরখপুরের মহম্মদ হাসান প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য ।

(৮) ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে বাংলার চট্টগ্রামের সিপাহিরা বিদ্রোহী হন । কিন্তু সেখানে জনসাধারণের সমর্থন না পাওয়ায় সিপাহিরা পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন ।

(৯) নর্মদা নদীর দক্ষিণাঞ্চলে শান্তি একরকম অক্ষুন্নই ছিল, যদিও সিপাহিদের মধ্যে উত্তেজনার অভাব ছিল না ।

(১০) রাজস্থানেও বিদ্রোহ সংক্রামিত হয় । কিন্তু রাজপুত শাসকরা ব্রিটিশদের প্রতি অনুগত থাকায় সেখানে বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারেনি ।

মহাবিদ্রোহে জনগণের অংশ গ্রহণ:- ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী ভারতীয় সিপাহিদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জনগণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংগ্রামে নামা ছিল ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের গণবিদ্রোহের একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ।

(ক) মহাবিদ্রোহে জনগণের প্রত্যক্ষভাবে অংশ গ্রহণ : অযোধ্যা, দিল্লী, মধ্যভারত, বিহার প্রভৃতি অঞ্চলে বিদ্রোহ প্রকৃত গণবিদ্রোহের রূপ ধারণ করেছিল, যেমন—

(১) গ্রামাঞ্চলে কোম্পানি প্রবর্তিত নতুন ভূমিরাজস্ব আইন দ্বারা সুরক্ষিত সুদখোর মহাজন ও নতুন জমিদারদের  বাড়িঘর ও কাছারি লুঠ করা হয় । যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় ডাকাতরাও এই সব লুঠতরাজে অংশ নিয়েছিল ।

(২) ব্যবসায়ী ও মহাজনদের ওপর কর বসিয়ে বিদ্রোহী সিপাহিদের খাদ্যশস্য ও যুদ্ধের রসদপত্র কেনা হয় ।

(৩) দিল্লী, লক্ষ্ণৌ, বারবেরিলি প্রভৃতি শহরের জনসাধারণ তাদের বল্লম, টাঙ্গি, ছুরি, দা, কাস্তে প্রভৃতি নিয়ে বিদ্রোহী সিপাহিদের সঙ্গে যোগ দেয় এবং কোম্পানির অনুগত সেনাদের সঙ্গে হাতাহাতি লড়াই চালায় ।

(৪) দিল্লী, অযোধ্যা, কানপুর, লক্ষ্ণৌ প্রভৃতি অঞ্চলে রাস্তাঘাট নষ্ট করে গোরু, মোষ, ঘোড়ার গাড়ি ও স্থানীয় নৌকা গুলি সরিয়ে ফেলে কোম্পানির সেনাবাহিনীর রসদপত্র সরবরাহের কাজে বাধা দেওয়া হয় ।

(খ) মহাবিদ্রোহে জনগণের পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ:- ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহে ভারতের জনগণ পরোক্ষভাবেও অংশ নিয়েছিল, যেমন—

(১) স্থানীয় ভৃত্য, পরিচারক ও আয়ারা তাদের কাজকর্ম বন্ধ করে দিয়ে ইংরেজদের বিপদে ফেলে ।

(২) বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় জনগণ ইংরেজদের কাছে বিদ্রোহী সিপাহিদের গতিবিধি সম্পর্কে কোনো আগাম খবর না দিয়ে এবং

(৩) নানারকম গুজব রটিয়ে ইংরেজদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করে ।

পরিশেষে বলতে হয়, যদিও ভারতীয় জনগণের একটা বড়ো অংশ, যেমন— বোম্বাই, মাদ্রাজ, পশ্চিম পাঞ্জাব, বাংলা প্রভৃতি এবং ভারতের ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি ইংরেজ কোম্পানির বিরুদ্ধে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেনি, তবুও ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যে গণবিদ্রোহের রূপ ধারণ করেছিল, একথা অস্বীকার করা যায় না ।

*****

Related Items

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে কী কী কারণে ইউরোপীয় দেশগুলির গণতন্ত্রের পতন ঘটে ? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ আলোচনা কর ।

প্রশ্ন:- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে কী কী কারণে ইউরোপীয় দেশগুলির গণতন্ত্রের পতন ঘটে ? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ আলোচনা কর ।

হিটলার কীভাবে পররাজ্য গ্রাস শুরু করেছিলেন ? হিটলারের আক্রমণ প্রতিহত না করে পশ্চিমী গণতান্ত্রিক শক্তিগুলি কোন নীতি গ্রহণ করেছিল এবং কেন ? এর ফল কী হয়েছিল ?

প্রশ্ন:- হিটলার কীভাবে পররাজ্য গ্রাস শুরু করেছিলেন ? হিটলারের আক্রমণ প্রতিহত না করে পশ্চিমী গণতান্ত্রিক শক্তিগুলি কোন নীতি গ্রহণ করেছিল এবং কেন ? এর ফল কী হয়েছিল ?

(ক) পোল্যান্ড-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি, (খ) মিউনিখ চুক্তি, (গ) রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি— এই চুক্তিগুলি হিটলার কেন স্বাক্ষর করেছিলেন ?

প্রশ্ন:- (ক) পোল্যান্ড-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি, (খ) মিউনিখ চুক্তি,  (গ) রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি— এই  চুক্তিগুলি হিটলার কেন স্বাক্ষর করেছিলেন ?

নাৎসি দলের পররাষ্ট্রনীতির মূল উদ্দেশ্য কী ছিল ?

প্রশ্ন:- নাৎসি দলের পররাষ্ট্র নীতির মূল উদ্দেশ্য কী ছিল ?

জার্মানির নাৎসি দলের পররাষ্ট্রনীতির মূল উদ্দেশ্য —

(ক) ইউরোপ তথা সারা বিশ্বে জার্মানিকে প্রধান শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা ।

(খ) ভার্সাই সন্ধির অপমান জনক চুক্তিগুলি অমান্য করা ।

নাৎসি দলের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য কী ছিল ? নাৎসি দল জার্মানিতে কীভাবে সরকারি ক্ষমতা দখল করে ?

প্রশ্ন :- নাৎসি দলের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য কী ছিল ? নাৎসি দল জার্মানিতে কীভাবে সরকারি ক্ষমতা দখল করে ?

হিটলার বা তাঁর নাৎসি দলের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ছিল:-