ব্রিটিশ বাণিজ্যের পরিবর্তন

Submitted by avimanyu pramanik on Sun, 04/22/2012 - 10:45

ব্রিটিশ বাণিজ্যের পরিবর্তন (Changes in the British Commercial Policy)

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধ ইংরেজদের জয়লাভ এবং ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলার দেওয়ানি লাভের পর ভারতের সঙ্গে ব্রিটিশ কোম্পানির বাণিজ্যিক সম্পর্কের দ্রুত পরিবর্তন ঘটে । এতকাল কোম্পানিকে দেশীয় রাজা বা নবাবদের নানা বাধা-নিষেধের মধ্যে কাজ করতে হত । এখান তারা ব্যবসা বাণিজ্যের অবাধ অধিকার লাভ করে । দেওয়ানি লাভের সূত্রে প্রাপ্ত রাজস্ব কোম্পানি তার রপ্তানি বাণিজ্যে বেশি পরিমাণ বিনিয়োগ করতে শুরু করে ও অন্যদিকে দেশীয় শিল্পপতিদের শিল্পপ্রসারে বিভিন্নভাবে বাধাদান করতে শুরু করে । বিদেশে ভারতের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ছিল সুতি ও রেশম বস্ত্র । এই দুটি পণ্যের ক্ষেত্রে ইউরোপের বাজারে ভারতের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না । ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে কোম্পানির পরিচালন সভার নির্দেশে ভারতে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ ওই দুটি পণ্যের একচেটিয়া বাণিজ্য দখল করতে তত্পর হয় । দেশীয় কারিগরদের ভয় দেখিয়ে কোম্পানির কারখানায় কাজ করতে বাধ্য করা হয় । উনিশ শতকে ইংল্যান্ডের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যে নিম্নলিখত পরিবর্তনগুলি আসে—

(১) এই সময়ে ইংল্যান্ডে ভারতীয় শিল্পজাত দ্রব্য বিশেষত ভারতীয় বস্ত্রের রপ্তানির পরিমাণ ক্রমশ কমতে থাকে, কিন্তু ইংল্যান্ডে উৎপন্ন বিলিতি পণ্যের বিশেষত ইংল্যান্ডের ম্যাঞ্চেস্টার ও ল্যাঙ্কাশায়ারে মিলে তৈরি বস্ত্রের আমদানি বাড়তে থাকে ।

(২) ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভ এবং ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলার দেওয়ানি লাভের পরবর্তীকালে বাংলার রাজস্ব দিয়ে ভারত থেকে মাল কিনে ইউরোপে পাঠানো হত, কিন্তু ১৮৩৩ খ্রিটাব্দের পর থেকে ইংল্যান্ডের মাল ভারতে বিক্রি করে তার মুনাফা ইংল্যান্ডে পাঠানো হতে থাকে । এক সময় ব্রিটিশ বণিক কোম্পানির যে জাহাজগুলি ভারতীয় পণ্য নিয়ে ভারত থেকে ইউরোপে যেত, উনিশ শতকে সেই বণিক কোম্পানির জাহাজগুলিই ইংল্যান্ডের উৎপন্ন দ্রব্য নিয়ে বিক্রির জন্য ভারতে আসতে থাকে ।

(৩) এই সময়ে ভারত থেকে ইংল্যান্ডে শিল্পের বিভিন্ন কাঁচামালের, যেমন—  নীল, কাঁচা তুলা, রেশম, চা, কফি প্রভৃতির রপ্তানি বৃদ্ধি পায় ।

উনিশ শতকে ইংল্যান্ডের সঙ্গে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রকৃতিতে পরিবর্তনের প্রধান দুটি কারণ ছিল-

(১) ব্রিটিশ পণ্যের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় ভারতীয় পণ্যের পরাজয় :  ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন দ্বারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অবসান ঘটলে ভারতে ইংল্যান্ডের অন্যান্য বণিকদের অবাধ প্রবেশ ঘটে এবং শিল্পবিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডে উৎপন্ন অনেক উন্নতমানের ও সস্তা দামের পণ্যে বিশেষত ম্যাঞ্চেস্টার ও ল্যাঙ্কাশায়ারে মিলে তৈরি সুতি কাপড় ভারতের বাজার ছেয়ে যায় । এই সমস্ত মানে উন্নত কিন্তু দামে সস্তা পণ্যের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় ভারতীয় পণ্যের পরাজয় ছিল ভারতের রপ্তানি বাণিজ্য হ্রাস পাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ।

(২) ব্রিটিশ সরকারের বৈষম্যপূর্ণ শুল্কনীতি : উনিশ শতকে ইংল্যান্ডে উৎপাদিত শিল্পদ্রব্যের সুরক্ষা ও ভারতীয় শিল্পোদ্যোগকে ব্যাহত করার জন্য ব্রিটিশ সরকার সুপরিকল্পিতভাবে বৈষম্যমূলক শুল্কনীতি গ্রহণ করেছিল । উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, ১৭৯৭ সালে ভারতীয় ক্যালিকো বস্ত্রের ওপর যেখানে ১৮ শতাংশ আমদানি শুল্ক ছিল, সেখানে ১৮২৪ সালে তা বেড়ে গিয়ে ৬৭.৫ শতাংশে পরিণত হয় । ব্রিটিশ সরকারের এই অসম শুল্কনীতির ফলে ব্রিটিশ পণ্যের সঙ্গে ভারতীয় পণ্যের  পিছু-হটা ছিল ভারতের রপ্তানি বাণিজ্য হ্রাস পাওয়ার দ্বিতীয় কারণ ।

উনিশ শতকে ভারতের বাণিজ্যের প্রকৃতিতে পরিবর্তনের ফল :- 

(১) ভারতের হস্তশিল্প এবং বিখ্যাত তাঁতশিল্প ধ্বংশ হয়ে যায়;

(২) ইংল্যান্ডের কাপড় কল এবং অন্যান্য শিল্প-কারখানাগুলি ভারতে মাল বিক্রি করে ফুলে-ফেঁপে ওঠে ।

(৩) উনিশ শতকে ভারত শিল্পজাত পণ্যের রপ্তানিকারী দেশ থেকে আমদানিকারী দেশে পরিণত হয় ।

(৪) এক সময়ের শিল্পপ্রধান ভারত উনিশ শতকে ইংল্যান্ডের নিছক একটি কাঁচামাল সরবরাহকারী দেশে পরিণত হয়েছিল ।

অবাধ বাণিজ্যনীতি:- ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে সনদ আইনের এর মাধ্যমে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার লোপ পায় এবং অবাধ বাণিজ্যনীতি চালু হয় । আমদানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় ইংল্যান্ডের বড় বড় কারখানায় তৈরি সস্তাদামের শিল্পসামগ্রীতে ভারতের বাজার ছেয়ে যায়, ফলে দেশীয় শিল্প ক্রমশ পিছু হটতে থাকে । ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের পর কিছু সময়ের জন্য ইউরোপের বাজারে ভারতের রপ্তানি বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে যায় ।

শিল্পবিপ্লব:- সপ্তদশ শতকের শেষভাগে এবং অষ্টাদশ শতকের প্রথম ভাগে শিল্পক্ষেত্রে নানান বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে শিল্প ক্ষেত্রে-

(১) উন্নত যন্ত্রপাতির প্রচলন,

(২) কলকারখানায় লোহা ও বাষ্পশক্তির ব্যবহারে বড়ো বড়ো কলকারখানার উৎপত্তি,

(৩) যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি,

(৪) আধুনিক প্রযুক্তি, মূলধন, কাঁচামাল ও অভিজ্ঞ শ্রমিকের সহায়তায় শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে যে আমূল পরিবর্তন ঘটে, এক কথায় তা শিল্পবিপ্লব নামে পরিচিত । ইংল্যান্ডেই সর্বপ্রথম শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয় এবং পরে তা ইউরোপের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে ।

শিল্পবিপ্লবের ফল :-

(১) উৎপাদনের পরিমাণ অভাবনীয় ভাবে বেড়ে যায় এবং ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটে,

(২) ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে বড়ো বড়ো কলকারখানা গড়ে ওঠে,

(৩) রেল পথের প্রসার হয় এবং

(৪) বাষ্পীয় ইঞ্জিন চালিত জাহাজের প্রচলন শুরু হয় ।

*****

Related Items

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার (Pritilata Waddedar)

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার (Pritilata Waddedar):-

বিশ শতকে ব্রিটিশ-বিরোধী বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ব্যর্থতার ফলে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন যথেষ্ট সক্রিয় হয়ে ওঠে । সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে বাংলার নারীসমাজ প্রথমদিকে পরোক্ষভাবে অংশ নি

দীপালি সংঘ (Dipali Sangha)

দীপালি সংঘ (Dipali Sangha):-

বিংশ শতকে জাতীয় কংগ্রেসের উদ্যোগে জাতীয় আন্দোলগুলি ভারতবাসীর স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণ করতে ব্যর্থ হলে বাংলায় ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বৈপ্লবিক আন্দোলন সক্রিয় হয়ে ওঠে । এই সময় নারীদের সংগঠিত করে বিপ্লবী কার্যকলাপে শামি

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ (Nature of Women's Role in the Armed Revolution Struggles):-

বিশ শতকে ব্রিটিশ-বিরোধী বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ব্যর্থতার ফলে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন যথেষ্ট সক্রিয় হয়ে ওঠে । সশস্ত্র বিপ্

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে নারী আন্দোলন

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে নারী আন্দোলন (Women's Participation in the Quit India Movement):-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই আগস্ট মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দেয় । এই

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে নারী আন্দোলন

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে নারী আন্দোলন (Women's Participation in the Civil Disobedience Movement):-

১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে সারা বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় । এই অর্থনৈতিক মন্দা ঔপনিবেশিক ভারতের অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করে । ভারতের কৃষিজাত পণ্