ব্রাহ্ম আন্দোলন — বিবর্তন, বিভাজন, বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 12/08/2020 - 20:45

ব্রাহ্ম আন্দোলন — বিবর্তন, বিভাজন, বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা:-

উনিশ শতকের বাংলায় ধর্মসংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজ উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে । একেশ্বরবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে রাজা রামমোহন রায় ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দের ২০শে আগস্ট 'ব্রাহ্মসভা' প্রতিষ্ঠা করেন । ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে জানুয়ারি ব্রাহ্মসভার নাম হয় ব্রাহ্মসমাজ । ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে সেপ্টেম্বর রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনের গতি কিছুদিনের জন্য স্তিমিত হয়ে গেলেও দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেওয়ার পর তাঁর নেতৃত্বে ব্রাহ্ম আন্দোলন আবার্ গতিশীল হয়ে ওঠে । ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৬ই অক্টোবর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে 'তত্ত্ববোধিনী সভা' প্রতিষ্ঠিত হয় । ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে তত্ত্ববোধিনী সভা ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে মিশে যায় । ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা' প্রকাশিত হয় । ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে যুক্ত হন । দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য ঘটলে কেশবচন্দ্র সেন ও তাঁর অনুগামীরা ব্রাহ্মসমাজ থেকে পৃথক হয়ে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে 'ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ' গঠন করেন । দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন ব্রাহ্মসমাজ 'আদি ব্রাহ্মসমাজ' নামে পরিচিত হয় । কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু, দ্বারকামোহন গঙ্গোপাধ্যায়, দুর্গামোহন দাস প্রমূখ তরুণ ব্রাহ্মদের সঙ্গে পুনরায় মতপার্থক্য দেখা দিলে তারা ভারতবর্ষীয় ব্রহ্মসমাজ থেকে পৃথক হয়ে গিয়ে ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই মে 'সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ' গঠন করেন । কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বাধীন ব্রাহ্মসমাজ 'নববিধান' নামে পরিচিত হয় । বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর উদ্যোগে ব্রাহ্ম আন্দোলন শহর ছাড়িয়ে বিভিন্ন জেলায় বিস্তার লাভ করে । বৈষ্ণব ধর্মের জনপ্রিয় ঐতিহ্য ও ব্রাহ্ম ধর্মাদর্শের মধ্যে সংযোগ তৈরিতে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ।

রাজা রামমোহন রায় একেশ্বরবাদের প্রচার ও পৌত্তলিকতাবাদের বিরোধিতার উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মসমাজ গড়ে তুলেছিলেন । তিনি বিদেশে চলে যাওয়ার পর সেখানে তাঁর মৃত্যু হলে আন্দোলনের গতি স্তিমিত হয়ে পড়ে । দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বদানের জন্য এগিয়ে এলে ব্রাহ্ম আন্দোলন আবার প্রাণ ফিরে পায় । দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করতেন ব্রাহ্ম আন্দোলন হল মূলত ধর্মীয় আন্দোলন । তিনি ব্রাহ্ম আন্দোলনকে একটি বিশেষ ধর্মমত এবং ব্রাহ্মসমাজকে এক স্বতন্ত্র ধর্ম সম্প্রদায়ে পরিণত করেন ও ব্রাহ্মসমাজের কার্যাবলীকে মূলত ধর্মসংস্কারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন । দেবেন্দ্রনাথের এই মতবাদের সঙ্গে কেশবচন্দ্র সেন ও তরুণ ব্রাহ্মদের মতবিরোধ দেখা দেয় । তরুণ ব্রাহ্মরা শুধুমাত্র একেশ্বরবাদ তত্ত্ব প্রচার ও পৌত্তলিকতা বিরোধী আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজকে সীমাবদ্ধ না রেখে জাতপাতের বৈষম্য বর্জন, নারী ও পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা, পৈতে পরিত্যাগ, মদ্যপান বর্জন ইত্যাদির ওপর জোর দেন । শেষপর্যন্ত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মদের পৈতে ব্যবহারের আবশ্যিকতার কথা ঘোষণা করলে কেশবচন্দ্র সেন ও তাঁর অনুগামীরা ব্রাহ্মসমাজ ছেড়ে বেরিয়ে এসে 'ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ' গঠন করেন ।

পরবর্তীকালে কেশবচন্দ্র সেনের খ্রিস্টধর্মের প্রীতি, ইংরেজি প্রীতি, হিন্দু দেবদেবী ও আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি বিশ্বাস ব্রাহ্মসমাজের তরুণ নেতারা মেনে নিতে পারেননি । কেশবচন্দ্র সেন হিন্দুমতে নিজের ১৪ বছরের নাবালিকা কন্যা সুনীতি দেবীর সঙ্গে কোচবিহারের নাবালক হিন্দু রাজপুত্র নৃপেন্দ্র নারায়ণের বিবাহ দেন । এই বিবাহকে কেন্দ্র করে 'ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ' দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে ভেঙে যায় । বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু, দ্বারকামোহন গঙ্গোপাধ্যায়, দুর্গামোহন দাস প্রমূখ তরুণ ব্রাহ্মরা ভারতবর্ষীয় ব্রহ্মসমাজ থেকে পৃথক হয়ে গিয়ে ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই মে 'সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ' গঠন করেন । কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বাধীন ব্রাহ্মসমাজ 'নববিধান' নামে পরিচিত হয় । কেশবচন্দ্র সেনের নববিধান ধীরে ধীরে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে । এরপর থেকে তরুণ ব্রাহ্মদের পরিচালনাধীন সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বেই ধর্ম ও সমাজসংস্কারের কাজ পরিচালিত হয় ।

ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলন ছিল শহরকেন্দ্রিক ও শিক্ষিত লোকেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল । হিন্দুধর্মের আচার, প্রথা ও কুসংস্কার থেকে ব্রাহ্মসমাজ সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হতে পারেনি । শহুরে দরিদ্র শ্রেণি বা গ্রামে গরিষ্ঠ শ্রেণির সঙ্গে এই আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক ছিল না । দরিদ্রতা দূরীকরণের ব্যাপারেও ব্রাহ্মনেতারা কোনো উদ্যোগ নেয়নি । তথাপি ব্রাহ্ম আন্দোলনের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না । ব্রাহ্মসমাজ পরিচালিত সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন পরবর্তীকালে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পটভূমি রচনা করেছিল । শিক্ষিত জনমানসে জাতীয়তাবাদী চেতনার সঞ্চার ঘটাতে ব্রাহ্ম আন্দোলন সফল হয়েছিল ।

****

Comments

Related Items

বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার বিকাশে ড.মহেন্দ্রলাল সরকারের কীরূপ অবদান ছিল ?

প্রশ্ন : বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার বিকাশে ড.মহেন্দ্রলাল সরকারের কীরূপ অবদান ছিল ?

'বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা' -কে প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলা হয় কেন ?

প্রশ্ন : 'বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা' -কে প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলা হয় কেন ?

হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল ?

প্রশ্ন : হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল ?

উনিশ শতকে নারীশিক্ষা বিস্তারে ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন কী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন ?

প্রশ্ন : উনিশ শতকে নারীশিক্ষা বিস্তারে ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন কী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন ?

'নীলদর্পণ' নাটক থেকে উনিশ শতকের বাংলার সমাজের কীরূপ প্রতিফলন পাওয়া যায় ?

প্রশ্ন : 'নীলদর্পণ' নাটক থেকে উনিশ শতকের বাংলার সমাজের কীরূপ প্রতিফলন পাওয়া যায় ?