বিশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলনের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 02/08/2021 - 14:30

বিশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলনের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ (Women's Movements in the Twentieth Century):-

বিশ শতকের ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনগুলির মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চারটি জাতীয় আন্দোলন হল—(i) ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশি আন্দোলন, (ii) ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন, (iii) ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলন, (iv) ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারত ছাড়ো আন্দোলন । এই চারটি আন্দোলন পর্বে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণের পাশাপাশি সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনেও নারীসমাজ অসীম সাহসের পরিচয় রাখে । দীপালি সংঘের মতো নারী সংগঠন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, বীণা দাসের মতো নারীরা বিশ শতকের ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনগুলিতে দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা নেয় ।

ঊনিশ শতক থেকেই পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার, পাশ্চাত্য ভাবধারার অনুপ্রবেশ, ইউরোপের নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, ভারতের জাতীয় নবজাগরণ এবং নারীশিক্ষা বিস্তারের প্রচেষ্টা প্রভৃতি নারীদের জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটাতে সাহায্য করে । রামমোহন রায়ের সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং জ্যোতিরাও গোবিন্দরাও ফুলের বিধবা বিবাহ প্রচলনের আন্দোলন, ডিরোজিও ও নব্যবঙ্গীয়দের নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তির স্বপক্ষে জনমত গঠন, ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে নারীশিক্ষার আন্দোলন, মহারাষ্ট্রে পণ্ডিতা রমাবাই, মাদ্রাজে ভগিনী শুভলক্ষী, বাংলার মুসলিম মেয়েদের শিক্ষিত করার বিষয়ে বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেনের ঐকান্তিক প্রয়াস প্রভৃতি ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয় আন্দোলনে নারীদের অংশ গ্রহণের প্রেক্ষাপট তৈরি করে দেয় । সম্ভবত স্বদেশি আন্দোলনের সময় বাংলার রাজনীতিতে ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নারীরা সক্রিয় ও স্বতঃস্ফূর্ত ভূমিকা গ্রহণ করে । বিশ শতকের নারী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, —

(i) এই সময় কোনো বড় মাপের নেত্রীর আবির্ভাব হয়নি ।

(ii) তারা তাদের নিজস্ব পরিসরে এই আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছিল ।

(iii) বিদেশি দ্রব্য ও বস্ত্র বয়কট, রেশমি চুড়ি ভেঙে ফেলা এবং অনশন বা উপবাসের মাধ্যমে তারা প্রতিবাদে শামিল হয় ।

(iv) শহরের শিক্ষিত ও বড় ঘরের মহিলারা তাদের অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে এসে সভাসমিতি ও মিছিলে যোগ দেয় এবং পিকেটিং -এ অংশ গ্রহণ করে ।

(v) সাধারণ নিম্নবিত্ত ঘরের মহিলারাও তাদের গহনা ও টাকা স্বদেশি তহবিলে দান করে ।

(vi) আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীদের অধিকাংশই ছিলেন উচ্চবর্গের বাঙালি হিন্দু পরিবারভুক্ত । কৃষক পরিবারের বা মুসলিম পরিবারের তেমন কোন নারী প্রত্যক্ষভাবে এই আন্দোলনে যোগ দেয়নি ।

(vii) আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীরা প্রায়ই সবাই ছিলেন শহুরে ও অভিজাত । গ্রামের সাধারণ মেয়েদের অংশগ্রহণ এই আন্দোলনে ছিল না ।

(viii) সর্বোপরি নারীরা স্বাধীনভাবে এই আন্দোলন পরিচালনা করতে পারেননি, তাদের আন্দোলনসূচী ছিল পূর্ব নির্দিষ্ট ও নিয়ন্ত্রিত । 

(ix) যে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা গান্ধিবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল, সেই পরিবারের মহিলারাও এইসব আন্দোলনে সক্রিয় ছিল । অনেক ক্ষেত্রে পুরুষ সদস্যরাই তাদের আন্দোলনে বাড়ির মহিলাদের উদবুদ্ধ করত ।

বিশ শতকে নারী আন্দোলনে সাম্যবাদ বা কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রভাবে ১৯২০ ও ১৯৩০ -এর দশকে মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বহু মহিলা কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তারা মজদুর শ্রেণিকে সঙ্ঘবদ্ধ করতে ও রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় । ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে সারা ভারতে ছাত্র ফেডারেশনে মহিলাদের সদস্যসংখ্যা ছিল ৫০ হাজার ৩০০ জন । তেভাগা আন্দোলন ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনে মহিলাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল । সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের নারী বাহিনী 'রানি ঝাঁসি রেজিমেন্ট' প্রমাণ করে নারীরা সশস্ত্র আন্দোলনেও পিছিয়ে ছিল না ।

****

Comments

Related Items

'হুতোম প্যাঁচার নকশা' গ্রন্থে উনিশ শতকের বাংলার কীরূপ সমাজচিত্র পাওয়া যায় ?

প্রশ্ন : 'হুতোম প্যাঁচার নকশা' গ্রন্থে উনিশ শতকের বাংলার কীরূপ সমাজচিত্র পাওয়া যায় ?

স্বাধীনতার পরে ভাষার ভিত্তিতে ভারত কীভাবে পুনর্গঠিত হয়েছিল ?

প্রশ্ন : স্বাধীনতার পরে ভাষার ভিত্তিতে ভারত কীভাবে পুনর্গঠিত হয়েছিল ?

দলিত আন্দোলন বিষয়ে গান্ধি-আম্বেদকর বিতর্ক নিয়ে একটি টীকা লেখ ।

প্রশ্ন : দলিত আন্দোলন বিষয়ে গান্ধি-আম্বেদকর বিতর্ক নিয়ে একটি টীকা লেখ ।

কারিগরি শিক্ষার বিকাশে 'বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট' -এর কী ভূমিকা ছিল ?

প্রশ্ন : কারিগরি শিক্ষার বিকাশে 'বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট' -এর কী ভূমিকা ছিল ?

ছাপা বইয়ের সঙ্গে শিক্ষাবিস্তারের সম্পর্ক বিশ্লেষণ কর ।

প্রশ্ন : ছাপা বইয়ের সঙ্গে শিক্ষাবিস্তারের সম্পর্ক বিশ্লেষণ কর ।