বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে নারী আন্দোলন

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 02/08/2021 - 18:12

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে নারী আন্দোলন (Women and the Anti-partition Movement):-

সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনকালে লর্ড কার্জন প্রশাসনিক অজুহাত দেখিয়ে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ২০শে জুলাই সরকারিভাবে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে বাংলা তথা ভারতে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত হয় । নারীরাও ঘরের কোণ ছেড়ে বেরিয়ে এসে এই আন্দোলনে দলে দলে অংশ গ্রহণ করেন । 

♦ ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গের দিন প্রভাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে হিন্দু মুসলিম ভ্রাতৃত্বের বন্ধন হিসেবে যে রাখী বন্ধন উৎসব অনুষ্ঠিত হয় তাতে প্রবল উৎসাহে মেয়েরা অংশ গ্রহণ করেন এবং কলকাতা সহ গ্রামে-গঞ্জের মন্দিরে, স্নানের ঘাটে সর্বত্র এই উৎসব ছড়িয়ে দেয় । রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর আহ্বানে যে 'অরন্ধন উপবাস দিবস' পালিত হয় তাতেও মেয়েরা সক্রিয়ভাবে অংশ নেয় । বঙ্গভঙ্গের দিন বিকালে দুই বাংলার ঐক্যের প্রতীক রূপে কলকাতার আপার সার্কুলার রোডে যে মিলন মন্দিরের ভিত্তি স্থাপিত হয় তাতেও মেয়েরা শামিল হয় ।

♦ স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম ধারা বয়কট আন্দোলনে নারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেয় । বিদেশী শাড়ি, চুড়ি সহ রান্নাঘরে বিলাতি লবণ, মসলা ও বিদেশী ওষুধের ব্যবহার বন্ধ করে, বিদেশি শিক্ষালয় ত্যাগ করে, বিদেশী পণ্যাগারের সামনে পিকেটিং -এ অংশ নিয়ে নারীরা প্রতিবাদ আন্দোলনে শামিল হয় । কলকাতায় আয়োজিত এক মহিলা সভায় নাটোরের মহারানি বিদেশি পণ্য বর্জনের আহ্বান জানান । নদীয়ার মঙ্গলগঞ্জের জমিদার লক্ষণচন্দ্র আসের বিধবাপত্নী, জলপাইগুড়িতে অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্ত, ময়মনসিংহে পুষ্পলতা গুপ্তা, কাশীতে সুশীলা বসু, কলকাতায় হেমাঙ্গিনী দাস প্রমূখ নারী বিদেশি পণ্য বয়কট করার আহ্বান জানান ।

♦ বিদেশী দ্রব্য বর্জনের পাশাপাশি নারীরা স্বদেশী দ্রব্য তৈরি ও ব্যবহারের আহ্বান জানায় । স্বদেশী দ্রব্যের ব্যবহার বাড়াতে স্বর্ণকুমারী দেবী 'সখী সমিতি' ও সরলাদেবী চৌধুরানী 'লক্ষীরভাণ্ডার' স্থাপন করেন । নারীদের দ্বারা সম্পাদিত বিভিন্ন পত্রিকা যেমন— সরলাদেবী চৌধুরানী সম্পাদিত 'ভারতী' সরযুবালা সম্পাদিত 'ভারত মহিলা' বঙ্গভঙ্গ বিরোধী প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় । স্বদেশি আন্দোলন চলাকালীন মুসলিম নারী খায়রুন্নেসা 'নবনূর' পত্রিকায় ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে 'স্বদেশানুরাগ' নামে একটি কবিতা লিখে বাংলার নারীসমাজকে স্বাদেশিকতাবোধে উদ্বুদ্ধ করেন । চারণ কবি মুকুন্দ দাস বাংলার নারী সমাজের উদ্দেশ্যে গান বাঁধেন "পরো না রেশমি চুড়ি বঙ্গনারী কভু হাতে আর পরো না ।" অবলা বসুর উদ্যোগে মেরী কার্পেন্টার হলে প্রায় এক হাজার মহিলা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে স্বদেশী শপথ নেয় । মহিলারা স্বদেশি পণ্যের ব্যাপক ব্যবহার করার পাশাপাশি স্বদেশি তহবিলে টাকা পয়সা এমনকি সোনার গয়না পর্যন্ত দান করেন ।

♦ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন— সরলাদেবী চৌধুরানী, কুমুদিনী বসু, সুবালা আচার্য, হেমাঙ্গিনী দাস, নির্মালা সরকার, লীলাবতী মিত্র প্রমুখরা । কলকাতার বাইরে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন— মুর্শিদাবাদের গিরিজা সুন্দরী, বরিশালের সরোজিনী দেবী, বীরভূমের দু'কড়িবালা দেবী, খুলনার লাবণ্যপ্রভা দত্ত, ঢাকার ব্রহ্মময়ী সেন ।

সীমাবদ্ধতা : বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করলেও তাদের আন্দোলনের কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল—

♦ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীদের অধিকাংশই ছিলেন উচ্চমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দু পরিবারভুক্ত । কৃষক পরিবারের বা মুসলিম পরিবারের তেমন কোন নারী প্রত্যক্ষভাবে এই আন্দোলনে যোগ দেয়নি । মুসলিম পরিবারের খায়রুন্নেসা অবশ্য 'নবনূর' নামক পত্রিকায় 'স্বদেশানুরাগ' নামক রচনা প্রকাশ করে স্বদেশী আন্দোলনের প্রসারে সচেষ্ট হন ।

♦ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীরা প্রায়ই সবাই ছিলেন শহুরে ও অভিজাত । গ্রামের সাধারণ মেয়েদের অংশগ্রহণ এই আন্দোলনে ছিল না ।

♦ সর্বোপরি নারীরা স্বাধীনভাবে এই আন্দোলন পরিচালনা করতে পারেননি, তাদের আন্দোলনসূচী ছিল পূর্ব নির্দিষ্ট ও নিয়ন্ত্রিত ।

****

Comments

Related Items

বিংশ শতকের ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা আলোচনা কর ।

প্রশ্ন : বিংশ শতকের ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা আলোচনা কর ।

মানুষ, প্রকৃতি ও শিক্ষার সমন্বয় বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও ।

প্রশ্ন : মানুষ, প্রকৃতি ও শিক্ষার সমন্বয় বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও ।

ঊনিশ শতকের বাংলায় সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজগুলির কীরূপ ভূমিকা ছিল ?

প্রশ্ন : ঊনিশ শতকের বাংলায় সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজগুলির কীরূপ ভূমিকা ছিল ?

হায়দ্রাবাদ রাজ্যটি কীভাবে ভারতভুক্ত হয়েছিল ?

প্রশ্ন : হায়দ্রাবাদ রাজ্যটি কীভাবে ভারতভুক্ত হয়েছিল ?

সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো : দেশবিভাগ (১৯৪৭) জনিত উদবাস্তু সমস্যা ।

প্রশ্ন : সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো : দেশবিভাগ (১৯৪৭) জনিত উদবাস্তু সমস্যা ।