নারীশিক্ষা ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

Submitted by avimanyu pramanik on Wed, 12/02/2020 - 10:30

ঊনিশ শতকের সূচনালগ্ন পর্যন্ত নানা রকম সামাজিক বিধিনিষেধের ফলে বাংলায় নারীশিক্ষার বিশেষ প্রসার ঘটেনি । এরপর থেকে উনিশ শতকে ভারতে নারীশিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে কিছু সমষ্টিগত ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ শুরু হয় । সমষ্টিগত উদ্যোগে নব্যবঙ্গীয় গোষ্ঠী, খ্রিস্টান মিশনারি এবং ব্রাহ্মসমাজ নারীশিক্ষার প্রসারে উদ্যোগী হয় । সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত উদ্যোগে রাজা রামমোহন রায়, রাধাকান্ত দেব, বিদ্যাসাগর, বেথুন, ডেভিড হেয়ার প্রমুখ ব্যক্তি নারীশিক্ষার প্রসারে সচেষ্ট হন । নব্যবঙ্গীয় দলের সদস্যরা নারীশিক্ষার সপক্ষে জনমত গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালান । ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম কেরি ও মার্শম্যানের উদ্যোগে শ্রীরামপুরে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয় । ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে লণ্ডন মিশনারি সোসাইটির রবার্ট মে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন । ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে ক্যালকাটা ব্যাপটিস্ট মিশন সোসাইটির নেতৃত্বে কলকাতায় 'ক্যালকাটা ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি' গড়ে ওঠে । আনুষ্ঠানিকভাবে এই সোসাইটি বাংলায় নারীশিক্ষা আন্দোলনের সূচনা ঘটায় । নারীশিক্ষার প্রসারে উদ্যোগ নিতে রাধাকান্ত দেব ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে ডব্লিউ এইচ পিয়ার্স -কে এক পত্রের দ্বারা অনুরোধ জানান এবং ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি 'স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ক' নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন । মিস কুক ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে 'ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল' প্রতিষ্ঠা করেন । চার্চ মিশনারি সোসাইটির কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য নিয়ে মেরি অ্যান কুক ২২টি নারী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন । লেডি আমহার্স্টের উদ্যোগে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় 'দ্য লেডিজ সোসাইটি ফর নেটিভ ফিমেল এডুকেশন' । এই সোসাইটি কলকাতায় ও মফসসল্ এলাকায় ৩০টি বালিকা বিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব নেয় । এদের উদ্যোগেই কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় 'সেন্ট্রাল স্কুল' । বেথুন সাহেব ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মে প্রতিষ্ঠা করেন 'হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়' বর্তমানে এটি 'বেথুন স্কুল' নামে পরিচিত । মেয়েদের উচ্চশিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে বেথুন সাহেব কলকাতায় একটি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন । এটি বর্তমানে 'বেথুন কলেজ' নামে পরিচিত । সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ 'ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়' প্রতিষ্ঠিত হয় ।

উনিশ শতকে বাংলায় নারীশিক্ষা প্রসারে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর । তিনি উপলব্ধি করেন যে, একমাত্র শিক্ষাই পারে নারীসমাজকে প্রকৃতরূপে আধুনিক ও কুসংস্কারমুক্ত করে তুলতে । স্ত্রীজাতিকে শিক্ষিত করতে না পারলে সমাজ, সভ্যতা ও জাতির জীবনধারায় স্থায়ী বা প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নয় । সে সময় সমাজে এক প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা ছিল যে নারীরা শিক্ষা লাভ করলে অকালে বিধবা হবে । এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করার জন্য তিনি সচেষ্ট হন এবং নারীশিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্র হিসেবে গ্রামাঞ্চলকে বেছে নেন । কারণ গ্রামগুলিতেই কুসংস্কার ছিল বেশি । নারীশিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে বেথুন সাহেব, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তির সাহায্যে দক্ষিণারঞ্জনের বাড়িতে গড়ে তোলা হয় 'ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল' । বিদ্যাসাগর এই বিদ্যালয়ের ছাত্রী যোগাড়ে উদ্যোগী হয়েছিলেন । বেথুন সাহেবের মৃত্যুর পর তিনি বেথুন স্কুলের সম্পাদকের ভার নেন ।

তিনি নিজের পরিচিত, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের কন্যাসন্তানদের এই বিদ্যালয়ে ভর্তির অনুরোধ জানান । মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ কন্যা সৌদামিনী সহ বহু অভিজাত পরিবারের মেয়েরা বিদ্যাসাগরের এই আহ্বানে সাড়া দেন । এই বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের তিনি গাড়ি করেই নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছিলেন । এই গাড়ির দু-দিকে লেখা থাকত স্ত্রীশিক্ষা সপক্ষে প্রচার— "কন্যাপেবং পালনীয়া শিক্ষানীয়াতি যত্নতঃ" অর্থাৎ কন্যাকে যত্নসহকারে পালন ও শিক্ষাদান করাতে হবে । নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে দেশবাসীকে সচেতন করার জন্য তিনি সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেন— "স্ত্রী শিক্ষিত ও জ্ঞানসম্পন্ন হইলে শিশু সন্তানদিগকে শিক্ষা দিতে পারবেন ।"

১৮৫৭-৫৮ খ্রিস্টাব্দে বিশেষ বিদ্যালয় পরিদর্শক থাকাকালীন তিনি বর্ধমান, হুগলি, মেদিনীপুর জেলায় মোট ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন । এই বিদ্যালয়গুলিতে ১৩,০০০ মেয়ে পড়াশোনার সুযোগ পায় । তাঁর নিজের জন্মস্থান মেদনীপুরের বীরসিংহ গ্রামে মা ভগবতী দেবীর স্মৃতিরক্ষার্থে 'ভগবতী বিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠা করেন । নারীশিক্ষার প্রসারের ব্যাপারে এটিই ছিল বিদ্যাসাগরের সর্বশেষ প্রচেষ্টা । বিদ্যাসাগর আশা করেছিলেন তিনি যে সকল বিদ্যালয়গুলি গড়ে তুলেছিলেন সেগুলি পরিচালনার জন্য ব্রিটিশ সরকার আর্থিক সাহায্য দেবে । কিন্তু প্রথমবার সরকারি তরফে এই বিদ্যালয়গুলির খাতে কিছু টাকা মঞ্জুর হলেও পরবর্তীকালে সেরকমভাবে আর কোনো আর্থিক সাহায্য মেলেনি । তাই এই বিদ্যালয়গুলি পরিচালনার জন্য বিদ্যাসাগর 'নারীশিক্ষা ভাণ্ডার' নামে একটি তহবিল গঠন করেন । তিনি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন সহ বহু খরচের দায়ভার নিজে বহন করতেন । স্ত্রীশিক্ষার সঠিক প্রসারের উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগর মেদিনীপুর, হুগলি, বর্ধমানসহ বিভিন্ন জেলায় স্ত্রীশিক্ষা সম্মিলনী নামে সংগঠন গড়ে তোলেন ।

*****

Related Items

শ্রীরামপুর মিশন প্রেস কিভাবে একটি অগ্রনী মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল ?

প্রশ্ন : শ্রীরামপুর মিশন প্রেস কিভাবে একটি অগ্রনী মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল ?

উঃ- ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৩৮ বছর বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনায় শ্রীরামপুর মিশনের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।

বাংলায় মুদ্রণ শিল্পের বিকাশে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের কীরূপ অবদান ছিল ?

প্রশ্ন : বাংলায় মুদ্রণ শিল্পের বিকাশে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের কীরূপ অবদান ছিল ?

১৮৫৭ -এর মহাবিদ্রোহকে কি সামন্ত-শ্রেণির বিদ্রোহ বলা যায় ?

প্রশ্ন : ১৮৫৭ -এর মহাবিদ্রোহকে কি সামন্ত-শ্রেণির বিদ্রোহ বলা যায় ?

উঃ- ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের সময় থেকেই এই বিদ্রোহের চরিত্র বা প্রকৃতি নিয়ে বিভিন্ন ধারার ইতিহাসচর্চার নানা ধরনের গবেষণালব্দ মতামত পাওয়া যায় ।

কী উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক সরকার অরণ্য আইন প্রণয়ন করেন ?

প্রশ্ন : কী উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক সরকার অরণ্য আইন প্রণয়ন করেন ?

এদেশের চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে কলিকাতা মেডিকেল কলেজের কীরূপ ভূমিকা ছিল ?

প্রশ্ন : এদেশের চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে কলিকাতা মেডিকেল কলেজের কীরূপ ভূমিকা ছিল ?