দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক

Submitted by avimanyu pramanik on Fri, 02/26/2021 - 18:19

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক (Initiatives Undertaken and Controversies Related to the Accession of Princely State with India):-

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের 'ভারতের স্বাধীনতা আইন' অনুসারে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট অবিভক্ত ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে এবং ভারত ও পাকিস্তান নাম দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় । স্বাধীনতা লাভের আগে বা দেশভাগের আগে পর্যন্ত ভারতীয় ভুখন্ডে ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ শাসনাঞ্চল ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোটোবড়ো মিলিয়ে ছয় শতাধিক দেশীয় রাজ্য অবস্থিত ছিল । এই সমস্ত দেশীয় রাজ্যগুলি ব্রিটিশ সরকারের সার্বভৌমত্বের অধীনে স্বশাসনের অধিকার ভোগ করত । ছোটো-বড়ো প্রায় ৫৬টি রাজ্যের অধীনে ছিল মোট ভারতীয় ভূখণ্ডের শতকরা ৪০ ভাগ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত দেশীয় রাজ্যগুলির সমষ্টিগত আয়তন ছিল সমগ্র ভারতীয় ভূখণ্ডের ৪০ ভাগ । এই সময়ে ভারতের মোট জনসংখ্যা ছিল ৩৯ কোটি, যার মধ্যে দেশীয় রাজ্যগুলির জনসংখ্যা ছিল ৯ কোটি । স্বাধীনতা লাভের পর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই সমস্ত রাজ্যগুলির ভবিষ্যৎ নিয়ে জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয় ।

স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই, মে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি -র প্রেরিত 'মন্ত্রী মিশন' বা 'ক্যাবিনেট মিশন' ঘোষণা করে যে, (i) ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর দেশীয় রাজ্যগুলির ওপর ব্রিটিশ আধিপত্যের অবসান ঘটবে । (ii) স্বাধীনতার পর ব্রিটিশ-শাসিত ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি 'ভারতীয় ইউনিয়ন' গঠন করা হবে । (iii) বিদেশনীতি নির্ধারণ, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপরে এই ভারতীয় ইউনিয়ন সরকারের কর্তৃত্ব বজায় থাকবে এবং অন্যান্য বিষয়ে দেশীয় রাজাগুলিতে নিজ নিজ শাসকদের অধিকার বজায় থাকবে ।

দেশীয় রাজ্যের রাজাগণ ক্যাবিনেট মিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে দাবি জানিয়ে বলেন যে, (i) প্রস্তাবিত ভারত ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে দেশীয় রাজাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার থাকবে । (ii) দেশীয় রাজারা তাদের হারানো ক্ষমতা ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ফিরে পাবেন । (iii) প্রতিটি দেশীয় রাজ্যের শাসনতন্ত্র, ভৌমিক অখন্ডতা এবং রাজবংশের উত্তরাধিকার বিষয়ক আইন কানুনগুলি বজায় থাকবে ।

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৪র্থ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হওয়া 'ভারতীয় স্বাধীনতা আইন' -এ বলা হয় ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর দেশীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের সম্পাদিত চুক্তির পরিসমাপ্তি ঘটবে । দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিজেদের স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখার অথবা ভারত বা পাকিস্তানের যে-কোনো একটি রাষ্ট্রে যোগদানের অধিকার দেওয়া হয় । এই আইন ঘোষিত হওয়ার সময় ইংল্যান্ডের অ্যাটর্নি জেনারেল হার্টলে শক্রস্ এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি বলেন যে, দুই শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে অবস্থিত হওয়ার জন্য দেশীয় রাজ্যগুলির অস্তিত্ব বিপন্ন হবে ও মহাদেশের অশান্তি বাড়বে । এ ছাড়া ভারত ও পাকিস্তান উভই দেশেরই ভৌগলিক সংহতি বিঘ্নিত হবে এবং উভয় দেশের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাতের সম্ভাবনা বাড়বে । তাই দেশীয় রাজ্যগুলির উচিত হবে ভারত বা পাকিস্তান যে-কোনো একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে নিজেদেরকে সংযুক্ত করা ।

ভারতীয় নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতা লাভের পূর্বেই উপলব্ধি করেছিলেন যে, ভারতের অভ্যন্তরভাগে অবস্থিত কোনো দেশীয় রাজ্য পাকিস্তানে যোগ দিলে বা স্বাধীন থাকলে তা স্বাধীন ভারতের সার্বভৌমত্বের পক্ষে বিপজ্জনক হবে । ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুন ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ঘোষণা করে যে, ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার পর দেশীয় রাজ্যগুলির স্বাধীন অস্তিত্ব ভারত স্বীকার করবে না । দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির উদ্যোগকে সফল করার জন্য কংগ্রেস নেতা বল্লভভাই প্যাটেল -এর দায়িত্বে 'দেশীয় রাজ্য দপ্তর' নামে এক দপ্তর গঠন করা হয় । এই দপ্তরের মাধ্যমে ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলির মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলা হয় ।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল বলিষ্ঠ কূটনীতি ও সামরিক শক্তি উভয়ের প্রয়োগ ঘটিয়ে দুই পর্যায়ে প্রায় একশোর ওপর দেশীয় রাজ্যকে ভারতভুক্ত করেন । প্রথমে তিনি দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতভুক্ত হওয়ার জন্য অনুরোধ করেন । পরে তিনি কঠোর সামরিক নীতি প্রয়োগের হুমকি দেয় । সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল কঠোর ভাষায় বলেন, দেশীয় রাজ্যগুলি ভারতরাষ্ট্রে যোগ না দিলে একদিকে যেমন তারা তাদের নিজেদের প্রজাদের রোষের মুখোমুখি হবে, অপরদিকে তেমনি ভারতের সামরিক শক্তিও চুপ করে থাকবে না । সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল তাঁর স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সচিব ভি পি মেনন -এর কুটকৌশল এবং মাউন্টব্যাটেনের সহযোগিতায় ভারতের সঙ্গে দেশীয় রাজ্যগুলির সংযুক্তিকরণে সফল হন । ভারত স্বাধীন হওয়ার তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রায় সমস্ত দেশীয় রাজ্য ভাতা, খেতাব ও অন্যান্য সুযোগসুবিধার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে 'ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাক্সেসান' (Instrument of Accession) -নামে ভারতভুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করে ভারতরাষ্ট্রে যোগ দেয় ।

দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতরাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে কয়েকটি পদ্ধতি গ্রহণ করা হয় । (i) ভারত রাষ্ট্রের প্রদেশগুলির সঙ্গে তার সন্নিহিত দেশীয় রাজ্যগুলির সংযুক্তি করা হয় । যেমন— উড়িষ্যা ও মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির সংযুক্তি, উত্তরপ্রদেশের সঙ্গে গাড়োয়াল, রামপুর ও বেনারসের সংযুক্তি, পাঞ্জাবের সন্নিহিত দেশীয় রাজ্যগুলিকে পাঞ্জাবের সঙ্গে, মাদ্রাজের দেশীয় রাজ্যগুলিকে মাদ্রাজের সঙ্গে, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে কোচবিহারকে, খাসি পার্বত্য দেশীয় রাজ্যগুলিকে আসামের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয় । (ii) কয়েকটি দেশীয় রাজ্যকে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করে একটি বৃহৎ রাজ্যে রূপান্তর করা হয় । যেমন— রাজস্থান, মধ্যভারত, সৌরাষ্ট্র, ত্রিবাঙ্কুর-কোচিন ও পেপসু (PEPSU) বা Patiala and East Punjab States Union । (iii) কয়েকটি দেশীয় রাজ্যকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয় । যেমন— হিমাচল প্রদেশ, কচ্ছ, বিলাসপুর, ভোপাল, ত্রিপুরা ও মনিপুর ইত্যাদি । এইভাবে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারির মধ্যে ২১৬টি দেশীয় রাজ্যকে তাদের সন্নিহিত প্রদেশগুলির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয় ও ২৭৫টি দেশীয় রাজ্য পাঁচটি রাজ্যে রূপান্তরিত হয় এবং ৬১টি দেশীয় রাজ্যকে ৭টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয় ।

স্বাধীনতা লাভের পর ভারতীয় ভূখণ্ডের প্রায় সমস্ত দেশীয় রাজ্য ভারতরাষ্ট্রে যোগদান করলেও জুনাগড়, জম্মু-কাশ্মীর এবং হায়দ্রাবাদ স্বাধীন অস্তিত্ব রক্ষায় অনড় থাকে । এই তিনটি দেশীয় রাজ্যকে ভারতভুক্ত করার ক্ষেত্রে সমস্যা ও বিতর্ক দেখা দেয় । ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরু ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল -এর মধ্যে বিতর্ক বাধে । সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল চেয়েছিলেন জুনাগর ও হায়দ্রাবাদের ভারতভুক্তি হোক কিন্তু কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তি না হলেও চলবে । জওহরলাল নেহরুর ইচ্ছা ছিল কাশ্মীর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হোক । কাশ্মীর নিয়ে জওহরলাল নেহরুর ইচ্ছাকে বল্লভভাই প্যাটেল সম্মান দেন । অবশেষে এই তিনটি দেশীয় রাজ্যকে ভারতরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয় । কাশ্মীরকে ভারতভুক্তির সময় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিবাদ বাধে । এই সমস্যা সমাধানের জন্য নেহরু সরকার জাতিপুঞ্জে সমস্যার কথা উত্থাপন করলে বির্তকের সৃষ্টি হয় ।

দেশীয় রাজ্যগুলি ভারতে যোগ দিলেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বেশকিছু ফরাসি ও পোর্তুগিজ উপনিবেশ রয়ে যায় । এগুলির মধ্যে বাংলার চন্দননগর, মাদ্রাজের পণ্ডিচেরি, পশ্চিম উপকূলে মাহে ইত্যাদি ফরাসি উপনিবেশ এবং গোয়া, দমন ও দিউ, দাদরা-নগরহাভেলি ইত্যাদি পোর্তুগিজদের উপনিবেশ প্রধান ছিল । এই উপনিবেশগুলির জনগণ স্বাধীনতা লাভের জন্য স্বাধীন ভারতে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করে । ফরাসি সরকার তাদের উপনিবেশগুলি স্বাধীন ভারতের হাতে তুলে দিলেও পোর্তুগিজ সরকার ইংল্যান্ড ও আমেরিকার গোপন মদতে তাদের উপনিবেশগুলি স্বাধীন ভারতের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি হয়নি । শেষপর্যন্ত সেনাবাহিনীর সাহায্যে ভারত সরকার গোয়া ও পোর্তুগিজ অধিকৃত অন্যান্য অঞ্চলগুলির দখল নেয় । এইভাবে দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি সম্পন্ন হয় ।

*****

Comments

Related Items

বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন (Indian universities Act, 1904)

লর্ড কার্জন প্রতিক্রিয়াশীল শাসক হলেও শিক্ষার ব্যাপারে তিনি খুবই উৎসাহী ছিলেন । লর্ড কার্জন স্যার টমাস র‍্যালের সভাপতিত্বে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে 'র‍্যালে কমিশন' গঠন করেছিলেন । এটি 'ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন' নামেও পরিচিত । স্যার টমাস র‍্যালে ছিলেন বড়লাটের কার্যনির্বাহক সমিতির আইন সদস্য । এই কমিশন ...

হান্টার কমিশন (Hunter Education Commission)

১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে লর্ড রিপণের সময় উইলিয়াম হান্টারের নেতৃত্বে হান্টার কমিশন গঠিত হয় । এই কমিশনের কাজ ছিল দেশে ইংরেজি শিক্ষার অগ্রগতি পর্যালোচনা করা । শিক্ষার প্রসারে হান্টার কমিশনের ভূমিকা এক অভিনব অধ্যায়ের সূচনা করেছিল । হান্টার কমিশনের সুপারিশগুলি ছিল ....

উডের ডেসপ্যাচ (Wood's Despatch of 1854)

শিক্ষা সংক্রান্ত নানা সমস্যার সমাধান করার জন্য ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির পরিচালক সমিতির সভাপতি স্যার চার্লস উড 'শিক্ষা বিষয়ক প্রস্তাব' (Wood's Education Despatch) নামে একটি শিক্ষা নীতি রচনা করে ভারতে পাঠান । ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে চার্লস উডের সুপারিশ ...

বহু বিকল্পীয় প্রশ্নোত্তর (M.C.Q) - বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ

বহু বিকল্পীয় প্রশ্নোত্তর (M.C.Q) - বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ:-

মাধ্যমিকের নমুনা প্রশ্ন:-

১. ভারতে 'হাফটোন' প্রিন্টিং পদ্ধতি প্রবর্তন করেন—     [মাধ্যমিক-২০১৭]

বহু বিকল্পীয় প্রশ্নোত্তর (M.C.Q) - সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা

বহু বিকল্পীয় প্রশ্নোত্তর (M.C.Q) - সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা:-

মাধ্যমিকের নমুনা প্রশ্ন:-

১. ভারতের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হল—       [মাধ্যমিক -২০১৭]