উনিশ শতকের বাংলা — ধর্মসংস্কার : বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 12/08/2020 - 10:06

উনিশ শতকে প্রচলিত হিন্দুধর্ম এক সংকটের সম্মুখীন হয় । পৌত্তলিকতা, বহু দেবতার আরাধনা প্রভৃতি বিষয়ে প্রচলিত হিন্দুধর্মে নানান বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল । এসবের বিরুদ্ধে উনিশ শতকের বাংলায় রাজা রামমোহন রায়, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ মনীষীদের উদ্যোগে হিন্দু ধর্মের সংস্কারকার্য শুরু হয় । হিন্দু ধর্মের সংকটের কারণ মোটামুটি দুটি । প্রথমত, প্রচলিত হিন্দুধর্ম ও সমাজে প্রচলিত কুপ্রথার ফলে হিন্দুধর্মের মধ্যে অনৈক্য প্রকট হয়ে উঠে । জাতিভেদ প্রথা ও ধর্মের নামে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ হিন্দুধর্মে অনেকেই আস্থা হারিয়ে ফেলে । রক্ষনশীল ও গোঁড়া হিন্দু নেতারা সংস্কার আন্দোলনে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল । দ্বিতীয়ত, খ্রিস্টান মিশনারিদের লাগাতার প্রচারের ফলে বহু মানুষ খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল । মিশনারিরা প্রাচলত হিন্দুধর্মকে কঠোরভাবে আক্রমণ করতে শুরু করে । সমাজের ওপর তলার কিছু মানুষও তাদের প্রচারে আকৃষ্ট হয়ে প্রচলিত হিন্দুধর্মের প্রতি আস্থা হারিয়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন । ফলে হিন্দুধর্মের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ছিল ।

এইসব আক্রমণের হাত থেকে প্রচলিত হিন্দুধর্মকে রক্ষা করার জন্য রামমোহন রায়কে এই কাজে ব্রতী হতে গিয়ে ঘরে-বাইরে উভয় দিক থেকেই প্রচন্ড বাধার সম্মুখীন হতে হয় । বাংলায় কিছু রক্ষণশীল ও কট্টর নেতা সর্বপ্রকার সংস্কারের বিরোধী ছিলেন । পৌত্তলিকতা ও একেশ্বরবাদী নিয়ে রামমোহনের সাথে গোঁড়া হিন্দুদের তীব্র তর্কবিতর্ক হয় । সুব্রহ্মণ্য স্বামী, রাধাকান্ত দেব, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার প্রমূখ হিন্দু সমাজের নেতাদের সঙ্গে তাঁর তীব্র মতবিরোধ ছিল । খ্রিস্টান মিশনারিরা রামমোহনের প্রচলিত হিন্দুধর্মের বিরোধিতায় উল্লসিত হয়ে আশা করেছিল যে, তিনি খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করবেন । কিন্তু তিনি তাদের এই আশাকে নিরাশায় পরিণত করে মিশনারিদের সঙ্গেও তিনি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন । গোঁড়া হিন্দু নেতাদের আচরণ তাঁকে ব্যথিত করলেও তিনি প্রচলিত হিন্দুধর্ম ত্যাগ করা বা নতুন কোন ধর্ম প্রচার করার কথা ভাবেননি । খ্রিস্টান মিশনারিদের আক্রমণের হাত থেকে শাশ্বত প্রচলিত হিন্দুধর্মকে রক্ষা করা ও বাংলায় বৈদান্তিক হিন্দুধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই হল রামমোহনের সবচেয়ে বড় অবদান । গোঁড়া হিন্দুধর্মের সঙ্গে মতের মিল না হওয়ায় তিনি ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন । রামমোহন রায়ের পর ব্রাহ্মসমাজ বাংলার ধর্মসংস্কার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় ।

উনিশ শতকের বাংলায় ধর্মসংস্কার আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এই আন্দোলন মূলত সমাজের ওপর তলার শিক্ষিত ও ভদ্রলোক শ্রেণির মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল । শিক্ষিত ও উচ্চবর্ণের মানুষেরাই ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল । সাধারণ অশিক্ষিত ও খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে এই আন্দোলনের মর্ম বোঝা কঠিন ছিল । ধর্মীয় যুক্তিতর্কের জটিলতা নিয়ে তাদের তেমন আগ্রহ বা উৎসাহ ছিল না । সেই তুলনায় রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব মাটির অনেক কাছাকাছি ছিলেন ও তাঁর আবেদন সমাজের সবরকম মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল । উনিশ শতকের প্রথমার্ধের আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল হিন্দুধর্মের সংস্কার এবং খ্রিস্টান মিশনারিদের হিন্দুধর্মবিরোধী প্রচার থেকে প্রচলিত হিন্দুধর্মকে রক্ষা করা । ব্রাহ্মসমাজও প্রচলিত হিন্দুধর্মের সংস্কার চেয়েছিল । কিন্তু নব্যহিন্দু আন্দোলন হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবনের ওপর যতটা জোর দিয়েছিল, সংস্কারের দিকে ততটা নয় । উনিশ শতকের বাংলায় প্রচলিত হিন্দুধর্ম তার পুরোনো মর্যাদা ও গৌরব অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হয়েছিল ।

*****

Comments

Related Items

বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন (Indian universities Act, 1904)

লর্ড কার্জন প্রতিক্রিয়াশীল শাসক হলেও শিক্ষার ব্যাপারে তিনি খুবই উৎসাহী ছিলেন । লর্ড কার্জন স্যার টমাস র‍্যালের সভাপতিত্বে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে 'র‍্যালে কমিশন' গঠন করেছিলেন । এটি 'ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন' নামেও পরিচিত । স্যার টমাস র‍্যালে ছিলেন বড়লাটের কার্যনির্বাহক সমিতির আইন সদস্য । এই কমিশন ...

হান্টার কমিশন (Hunter Education Commission)

১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে লর্ড রিপণের সময় উইলিয়াম হান্টারের নেতৃত্বে হান্টার কমিশন গঠিত হয় । এই কমিশনের কাজ ছিল দেশে ইংরেজি শিক্ষার অগ্রগতি পর্যালোচনা করা । শিক্ষার প্রসারে হান্টার কমিশনের ভূমিকা এক অভিনব অধ্যায়ের সূচনা করেছিল । হান্টার কমিশনের সুপারিশগুলি ছিল ....

উডের ডেসপ্যাচ (Wood's Despatch of 1854)

শিক্ষা সংক্রান্ত নানা সমস্যার সমাধান করার জন্য ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির পরিচালক সমিতির সভাপতি স্যার চার্লস উড 'শিক্ষা বিষয়ক প্রস্তাব' (Wood's Education Despatch) নামে একটি শিক্ষা নীতি রচনা করে ভারতে পাঠান । ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে চার্লস উডের সুপারিশ ...

বহু বিকল্পীয় প্রশ্নোত্তর (M.C.Q) - বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ

বহু বিকল্পীয় প্রশ্নোত্তর (M.C.Q) - বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ:-

মাধ্যমিকের নমুনা প্রশ্ন:-

১. ভারতে 'হাফটোন' প্রিন্টিং পদ্ধতি প্রবর্তন করেন—     [মাধ্যমিক-২০১৭]

বহু বিকল্পীয় প্রশ্নোত্তর (M.C.Q) - সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা

বহু বিকল্পীয় প্রশ্নোত্তর (M.C.Q) - সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা:-

মাধ্যমিকের নমুনা প্রশ্ন:-

১. ভারতের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হল—       [মাধ্যমিক -২০১৭]