আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন

Submitted by avimanyu pramanik on Fri, 02/05/2021 - 19:04

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন (The Civil Disobedience Movement and the Working Class) :-

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হলে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের শ্রমিকরা এই আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করে । এই সময় বাংলায় শ্রমিক আন্দোলন যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে । শ্রমিক আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান ব্যাপ্তিতে ভীত হয়ে আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে 'শিল্পবিরোধ বিল' ও 'জননিরাপত্তা বিল' (Public Safety Bill) পাস করে । শিল্পবিরোধ বিলটির দ্বারা ধর্মঘট নিষিদ্ধ করা হয় এবং জননিরাপত্তা বিলটির দ্বারা শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয় । ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এই দমনমূলক আইনগুলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হয় । সরকার-বিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগে বহু শ্রমিক নেতাকে গ্রেপ্তার করে তাদেরকে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত করা হয় । অভিযুক্তদের মধ্যে তিনজন ইংরেজ ছিলেন— বেঞ্জামিন ফ্রান্সিস ব্রাডলে, ফিলিপ স্প্র্যাট ও হাচিনসন । এ ছাড়া বোম্বাই থেকে এস এ ডাঙ্গে, এস এস মিরাজকর, এস ভি ঘাটে, কে এন যোগলেকর, আর এস নিম্বকর, এ এ আলভে, জি আর কামলে প্রমূখ, বাংলা থেকে মুজফফর আহমেদ, কিশোরীলাল ঘোষ, গোপেন চক্রবর্তী, রাধারমণ মিত্র প্রমূখ, পাঞ্জাব থেকে সোহন সিং জোশি এবং যুক্তপ্রদেশ থেকে পি সি জোশি ও বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ নেতা গ্রেফতার হন । মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার রায়ে অধিকাংশ বন্দি দোষী সাব্যস্ত হন ও তাঁদের অনেকের দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড হয় । মামলা চলাকালীন এই সব নেতারা আদালতে প্রকাশ্যে মার্কসবাদের প্রচারকার্য চালিয়েছিলেন । ফলে অনেকেই সাম্যবাদের দিকে আকৃষ্ট হন । অধিকাংশ কমিউনিস্ট নেতা কারাবরণ করায় কমিউনিস্ট আন্দোলন কিছুটা গতি হারিয়ে ফেলে । রোমা রোলাঁ, আলবার্ট আইনস্টাইন প্রমূখ মণীষী মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান ।

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রথম স্বাধীনতা দিবস পালন করে । ৪র্থ ফেব্রুয়ারী পূর্ণ স্বরাজের দাবিতে বোম্বাই -এর প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে, এদের অধিকাংশই ছিলেন রেলশ্রমিক । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৬ই এপ্রিল লবণ আইন ভঙ্গ করে গান্ধিজি আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেন । আন্দোলন শুরুর দিনেই বোম্বাই -এর জি আই পি রেলওয়ে মেন'স ইউনিয়ন (Great Indian Peninsular Railway Men's Union) -এর শ্রমিকরা সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মে গান্ধিজি গ্রেপ্তার হন । গান্ধিজির গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সারা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে । মহারাষ্ট্রের শোলাপুরের বস্ত্রশিল্পের শ্রমিকেরা স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করে । ধর্মঘটি ভাঙার জন্য ধর্মঘটি শ্রমিকদের ওপর ব্রিটিশ পুলিশ ও সামরিক বাহিনী নির্মম অত্যাচার চালায় । ঐ সময় করাচির বন্দর শ্রমিক, কলকাতার কারখানা ও বন্দর শ্রমিক এবং মাদ্রাজের শিল্প শ্রমিকরা ব্রিটিশবিরোধী ধর্মঘটে শামিল হয় । ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ধর্মঘটি শ্রমিকদের ওপর ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচারের তীব্র প্রতিবাদ জানায় ।

জাতীয় কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৬ই জুলাই দিনটিকে 'গান্ধি দিবস' হিসেবে ঘোষণা করে । ওই দিন ৫০ হাজার শ্রমিক হরতালে অংশগ্রহণ করে এবং ৪৯টি কারখানার শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে কর্মবিরতি পালন করে । মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা, সরকারি দমন নীতি, AITUC -এর ভাঙ্গন প্রভৃতি কারণে কমিউনিস্টরা এই সময় জাতীয় আন্দোলনের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে শ্রমিক আন্দোলনে কমিউনিস্ট নেতৃত্বের শূন্যস্থানে কংগ্রেসি নেতৃবর্গ নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন । ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে কমিউনিস্টরা আবার শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে শুরু করলে কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় ভূমিকায় শোলাপুর, নাগপুর ও বোম্বাই -এ ব্যাপকভাবে শ্রমিক ধর্মঘট পালিত হয় । কমিউনিস্টদের প্রভাব দমন করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে জুলাই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে । সে সময় কমিউনিস্ট পার্টি গোপনে কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি -র সঙ্গে মিলিত হয়ে শ্রমিক আন্দোলন পরিচালনা করতে থাকে । কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের নেতৃবৃন্দ মনে করতেন, শুধু স্বাধীনতা সংগ্রাম নয়, দেশের শ্রমিক-কৃষকদেরও স্বার্থরক্ষার প্রয়োজন রয়েছে । এই দলের চারটি মূল কর্মসূচি ছিল—(i) শীঘ্র স্বাধীনতা অর্জন, (ii) জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থী মনোভাবাপন্ন নেতাদের একজোট করা, (iii) জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটিয়ে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া, (iv) কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণিকে একজোট করা ও তাদের অর্থনৈতিক দাবিগুলি পূরণের চেষ্টা করা । নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি, শোষিত শ্রমিক ও কৃষকশ্রেণিকে একজোট করে সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করাই ছিল কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের মূল লক্ষ্যে । সারা ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে সর্বত্র কংগ্রেস প্রার্থীদের সমর্থন জানিয়ে মিছিল ও সভা সমাবেশের আয়োজন করে । জাতীয় কংগ্রেস নির্বাচনী ইস্তাহারে শ্রমিকদের স্বার্থে ন্যায় মজুরি, ৮ ঘণ্টা কাজ, শ্রমবিরোধের মিমাংসা, ইউনিয়ন গঠন ও ধর্মঘটের অধিকার প্রভৃতি কর্মসূচি ঘোষণা করে । নির্বাচনে ১১টির মধ্যে ৭টি প্রদেশে কংগ্রেসি মন্ত্রিসভা গঠিত হয় । নির্বাচনের সাফল্যে শ্রমিকশ্রেণি প্রবল উৎসাহে বাংলার চটকলগুলিতে, কানপুর, বোম্বাই, আমেদাবাদ ও মাদ্রাজের কাপড়ের কলগুলিতে, কুলচি ও হিরাপুরে মার্টিন বার্ন লৌহ-ইস্পাত কারখানায় এবং অসমের ডিগবয়ে খনিজ তেল শিল্পে শ্রমিক ধর্মঘটে শামিল হয় ।

****

Comments

Related Items

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ (Students' Role in Armed Revolutionary Struggles) :-

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরাধীন জাতির মুক্তি সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে । ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও জাতীয

রশিদ আলি দিবস (Rasid Ali Day)

রশিদ আলি দিবস (Rasid Ali Day) :-

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি লালকেল্লার সামরিক আদালতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন রশিদ আলিকে কোর্ট মার্শাল করে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলে এই অবিচারের প্রতিবাদে ও তাঁর মুক্তির দাবিতে

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Quit India Movement) :-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই আগস্ট মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ড

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Civil Disobedience Movement):-

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দিলে সেই আন্দোলনে ভারতের ছাত্রসম

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Non Co-operation Movement):-

মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, দমনমূলক রাওলাট আইন, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অপশাসন প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে গান্ধিজির নেতৃত্বে জা