অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলন

Submitted by avimanyu pramanik on Sun, 01/31/2021 - 15:21

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলন (The Non Co-operation Movement and the Peasants) :-

মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, দমনমূলক রাওলাট আইন, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড প্রভৃতির প্রতিবাদে গান্ধিজির নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেস ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু করলে বহু কৃষক এই আন্দোলনে যোগদান করে ।

১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে অযোধ্যা কর আইনে ব্রিটিশ সরকার প্রজাদের বেশকিছু সুযোগসুবিধা দেওয়া সত্বেও প্রজারা সেইসব সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় । এই আইন এড়িয়ে তালুকদারদের অবৈধভাবে নজরানা আদায়, জমি বেদখলি, বেগারি শস্যের পরিবর্তে নগদ টাকায় ভূমিরাজস্ব আদায় প্রভৃতি নানা রকমের অত্যাচার ও শোষণ করা ছিল প্রায় রোজকার ঘটনা । রাজনৈতিক ভাবধারা যুক্ত হওয়ার আগে থেকেই কিষান সভাগুলি এই সমস্ত শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল । ঝিঙ্গুরি সিং ও দূর্গাপাল সিং নামে দুই কৃষক নেতা রায়বেরিলি, প্রতাপগড় অঞ্চলের কৃষকবিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন । ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে বাবা রামচন্দ্র নামে একজন সন্ন্যাসীর নেতৃত্বে কিষান সভা যুক্তপ্রদেশের (বর্তমানে উত্তরপ্রদেশ) রায়বেরিলি, প্রতাপগড়, সুলতানপুর প্রভৃতি অঞ্চলে কৃষক আন্দোলনে এক নতুন গতির সঞ্চার করে । জোরজবরদস্তি করে কর আদায় বন্ধ করা, করের পরিমাণ হ্রাস করা, বেগার প্রথার অবসান, বেদখলি জমি দখলদারদের স্বার্থে চাষ করতে অস্বীকার করা, অত্যাচারী ভূস্বামীদের সামাজিক বয়কট ইত্যাদি ছিল তাঁর এই কিষাণ আন্দোলনের লক্ষ্য ।

১৯২০-২১ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লবী নেতা ভূপ সিং রাজস্থানে কৃষকবিদ্রোহের বীজ বপন করেন । ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে উইলকিনসনের রাজপুতানা এজেন্সি রিপোর্টে রাজস্থানের মেবারকে উপদ্রুত এলাকা হিসাবে চিহ্নিত করা হয় । সেই সময়ে বিজোলিয়া অঞ্চলের বিজয় সিং পথিক এবং মানিকলাল বর্মা নামে দুজন নেতা এক শক্তিশালী কিষাণ আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং তার ফলে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে জায়গিরদাররা প্রজাদের কিছু সুযোগসুবিধা দিতে বাধ্য হয় । মতিলাল জেজাওয়াত নামে উদয়পুরের এক মশলা ব্যবসায়ী নিজেকে গান্ধির দূত বলে ঘোষণা করে মেবারের ভিল উপজাতিদের সংগঠিত করতে সচেষ্ট হন । জয়নারায়ণ ব্যাস নামে আর একজন নেতা মেবারে কর বয়কট আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন । শেষ পর্যন্ত উদয়পুরের মহারাণার বিরুদ্ধে এই সমস্ত আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসতি হয় ।

অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাবে দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্র অঞ্চলেও কৃষক আন্দোলন শুরু হয় । ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অন্ধ্রপ্রদেশের উত্তর গোদাবরী অঞ্চলে রম্পা বিদ্রোহ হল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও ভয়াবহ কৃষক বিদ্রোহ । আল্লুরি শ্রীরাম রাজু এই আন্দোলনের নেতৃত্বে দেন । কোয়া ও রেড্ডি আদিবাসী কৃষকরা প্রত্যক্ষভাবে সরকারের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন গড়ে তোলে । রম্পা বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল—

(i) সরকারি বনবিভাগের আইনের মাধ্যমে রম্পা উপজাতির বন থেকে জ্বালানি সংগ্রহ এবং অরণ্যে অবাধ গোচারণে বাধা দান ।

(ii) অরণ্য ও পার্বত্য অঞ্চলে রাস্তা তৈরি ও অন্যান্য গঠনমূলক কাজে আদিবাসীদের শ্রমদান করতে বাধ্য করার সরকারি প্রচেষ্টা ।

এর ফলে কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয় । ব্যাস্টিয়ন নামে অন্ধ্রপ্রদেশের গুডেমের জনৈক ব্রিটিশদের তহশিলদার বলপ্রয়োগ করে রাস্তা তৈরির কাজে আদিবাসীদের নিযুক্ত করতে চেষ্ট করলে তার প্রতিবাদে রম্পা বিদ্রোহের সূচনা ঘটে । আল্লুরি শ্রীরাম রাজুর মৃত্যুর পর এই আন্দোলন ক্রমশ স্তিমিত হয়ে পড়ে এবং আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় ।

ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার ত্রুটি, সুদখোর মহাজনদের নির্লজ্জ শোষণ, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষণ এবং কৃষক ও উপজাতিদের ওপর নির্মম অত্যাচার ও দমননীতি প্রভৃতির কারণে ও তার প্রতিবাদে বিভিন্ন সময়ে কৃষক, শ্রমিক, তাঁতি, কারিগর, জেলে, মুচি, মেথর, ব্যবসায়ী, শিল্পী, ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ বিচ্ছিন্ন ভাবে হলেও সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সামিল হয়েছিল । এইসব বিদ্রোহগুলির মধ্যে দক্ষিণ ভারতে সবচেয়ে ব্যাপক ও ভয়াবহ আকারের কৃষক আন্দোলন ছিল কেরল অঞ্চলের মালাবার জেলার মোপালা কৃষক আন্দোলন । টিপু সুলতানের পতনের পর মালাবারে ব্রিটিশ কর্তৃত্ব স্থাপিত হয় । ব্রিটিশ সরকারের ভূমিবন্দোবস্ত নিয়ম অনুসারে হিন্দু সম্প্রদায়ের নায়ার ও নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণ জমিদাররা স্বত্ব স্থাপন করে । এই বিদ্রোহের কারণগুলি হল :-

(ক) ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভাস্কো-ডা-গামার ভারতে আগমনের পর এখানে পোর্তুগিজরা মশলার বাজার দখল, লুঠপাট ও জবরদস্তি ধর্মান্তকরণ চালাতে থাকে যা মালাবারের মোপলা বা মুসলিম কৃষকদের শ্বেতাঙ্গবিদ্বেষী করে তোলে ।

(খ) ধর্মযুদ্ধে শহিদ হওয়ার জিগির তুলে জায়ন-আল-দিন 'তুহফাৎ-আল-মুজাহিদিন' ও 'কোতুপালি মালা'  -এর বিখ্যাত গান লিখেছিলেন ।

(গ) ব্রিটিশ শাসকরা উঁচু জাতের হিন্দু 'নাম্বুদ্রি' ও 'নায়ার' জেনমি (জমিদার) দের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে উদ্যোগ নিলে অসংখ্য মুসলিম 'ইজারাদার' বা 'কনমদার' ও কৃষক বা 'বেরুসপট্টমদার' যারা 'মোপলা' নামে পরিচিত, তাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে ।

(ঘ) ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে মালাবারে মসজিদের সংখ্যা ছিল ৬৩৭টি, ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে মসজিদের সংখ্যা বেড়ে ১০৫৮টি হয় । তিরুরঙ্গাডির মালব্রুমের তালঙ্গদের নেতা সৈয়দ আলাবি ও তাঁর পুত্র সৈয়দ ফদল ক্রমশ মোপলা সমাজের ধর্মীয় তথা রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতা হয়ে ওঠেন ।

(ঙ) এখানকার চেরুমর নামে অস্পৃশ্য সম্প্রদায় মোপলা বিদ্রোহে যোগ দিলে দক্ষিণ মালাবারে ভাল্লুভেনাড় ও এলেনাড় তালুকে মোপলা আন্দোলন গণরূপ নেয় ।

১৯২০ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস ও খিলাফতীদের ঐক্য এইসব জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করে । গান্ধি, শওকত আলি, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, হাকিম আজমল খাঁ প্রমুখ জাতীয় স্তরের নেতাগণ মালাবার পরিভ্রমণ করে কৃষকদের অনুপ্রাণিত করেন ও মালাবারের বিভিন্ন স্থানে কংগ্রেস খিলাফত কমিটি গঠন করেন । ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ২১শে ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ সরকার খিলাফত সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে । এরপর ইয়াকুব হাসান, গোপাল মেনন, মাধবন নায়ার প্রমুখ নেতাদের কারারুদ্ধ করা হলে মোপালা বিদ্রোহের নেতৃত্ব স্থানীয় নেতাদের হাতে চলে যায় । মোপলাদের ধর্মীয় নেতা আলি মুসালিয়ারকে গ্রেপ্তার করার জন্য পুলিশ একটি মসজিদের ওপর আক্রমণ চালালে এক অত্যন্ত উত্তেজক পরিস্থিতির উদ্ভব হয় । মালাবারের বহুস্থানে খিলাফতীদের নেতৃত্বে সাধারণতন্ত্র স্থাপিত হয় । সরকারি তথ্য অনুসারে প্রায় ১০ হাজার বিদ্রোহী গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করে । মোপালা বিদ্রোহ ক্রমশঃ হিংসাশ্রয়ী হয়ে পড়লে অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে এই বিদ্রোহের যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে যায় । বিচ্ছিন্ন বসতি ও অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য এই আন্দোলন শেষপর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় । সামরিক আইন জারি করে ব্রিটিশ সরকার বলপূর্বক এই আন্দোলন দমন করে ।

*****

Comments

Related Items

সংক্ষেপে মহাবিদ্রোহের (১৮৫৭) চরিত্র বিশ্লেষণ কর ।

প্রশ্ন : সংক্ষেপে মহাবিদ্রোহের (১৮৫৭) চরিত্র বিশ্লেষণ কর ।

শিক্ষাবিস্তারে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক কী ? উচ্চশিক্ষার বিকাশে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা আলোচনা কর ।

প্রশ্ন : শিক্ষাবিস্তারে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক কী ? উচ্চশিক্ষার বিকাশে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা আলোচনা কর ।

নিরাপত্তা পরিষদের কার্যাবলী কী ? সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভা ও নিরাপত্তা পরিষদের মধ্যে পার্থক্যগুলি উল্লেখ কর ।

প্রশ্ন : নিরাপত্তা পরিষদের কার্যাবলী কী ? সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভা ও নিরাপত্তা পরিষদের মধ্যে পার্থক্যগুলি উল্লেখ কর ।

নিরাপত্তা পরিষদের কাজ :

বান্দুং সন্মেলন কবে অনুষ্ঠিত হয় ? এই সন্মেলনের গুরুত্ব নির্ণয় কর । বান্দুং সম্মেলনের নেতৃত্বদানকারী দেশের নাম লেখ ।

প্রশ্ন : বান্দুং সন্মেলন কবে অনুষ্ঠিত হয় ? এই সন্মেলনের গুরুত্ব নির্ণয় কর । বান্দুং সম্মেলনের নেতৃত্বদানকারী দেশের নাম লেখ ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া ও আফ্রিকার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাফল্যের কারণগুলি কী ?

প্রশ্ন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া ও আফ্রিকার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাফল্যের কারণগুলি কী ?