সমুদ্রস্রোতের প্রভাব (Effects of Ocean Currents)

Submitted by avimanyu pramanik on Wed, 10/20/2021 - 18:00

সমুদ্রস্রোতের প্রভাব (Effects of Ocean Currents) : ভৌগলিক পরিবেশ ও মানুষের কাজকর্মের ওপর পৃথিবীর বিভিন্ন সমুদ্রে প্রবাহিত সমুদ্রস্রোতের নানা রকম প্রভাব দেখা যায় । যেমন —

(১) মগ্নচড়া সৃষ্টি (Creation of Sand Bars) : শীতল সমুদ্রস্রোতের সঙ্গে ভেসে আসা হিমশৈলগুলি উষ্ণ সমুদ্রস্রোতের সংস্পর্শে গলে যায় । তখন হিমশৈলে আবদ্ধ নুড়ি, বালি, কাঁকর, আবর্জনা প্রভৃতি অগভীর সমুদ্রবক্ষে সঞ্চিত হয়ে নিমজ্জিত চড়ার সৃষ্টি করে । একে মগ্নচড়া বা ব্যাংক বলে । যেমন, উত্তর আমেরিকার নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্বে গড়ে ওঠা গ্র্যান্ড ব্যাংক একটি বিখ্যাত মগ্নচড়া । এই মগ্নচড়াগুলি বাণিজ্যিক মৎস্য আহরণের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।

(২) বাণিজ্যিক মৎস্য আহরণের ক্ষেত্রের সৃষ্টি (Business and Commerce) : উষ্ণ ও শীতল সমুদ্রস্রোতের মিলনস্থলে হিমশৈলের গলনের ফলে হিমশৈলবাহিত পদার্থের সঞ্চয় ঘটে মগ্নচড়ার সৃষ্টি হয় । এই মগ্নচড়ায় আবর্জনার প্রাচুর্যে ও সূর্যরশ্মির প্রবেশের ফলে মাছেদের খাদ্য প্ল্যাংকটন প্রচুর পরিমাণে জন্মায় । ফলে সামুদ্রিক মাছের ঝাঁক উষ্ণ ও শীতল স্রোতের মিলনস্থলে বাস করে এবং মগ্নচড়াগুলি বাণিজ্যিক মৎস্য আহরণক্ষেত্র হিসেবে গড়ে ওঠে । যেমন, নিউফাউন্ডল্যান্ডের গ্র্যান্ড ব্যাংক পৃথিবীর একটি বিখ্যাত বাণিজ্যিক মৎস্য আহরণক্ষেত্র । এছাড়া ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ, নরওয়ে ও জাপানের উপকূলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মৎসচারণ ক্ষেত্রগুলি গড়ে উঠেছে ।

(৩) উপকূলের জলবায়ুর ওপর প্রভাব (Impact on Coastal Temperature) : উষ্ণ ও শীতল সমুদ্রস্রোত উপকূলের জলবায়ুর ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে । শীতল স্রোত উপকূলের জলবায়ুকে অপেক্ষাকৃত শীতল রাখে । উষ্ণ স্রোত উপকূলের জলবায়ুকে অপেক্ষাকৃত উষ্ণ রাখে । যেমন, আটলান্টিক মহাসাগরে উষ্ণ উত্তর আটলান্টিক স্রোতের প্রভাবে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের উপকূল অঞ্চল সারা বছর বরফমুক্ত থাকে এবং উষ্ণ কুরোশিয়ো স্রোতের প্রভাবে জাপানের প্রচন্ড ঠান্ডা হ্রাস পায় । আবার শীতল ল্যাব্রাডর স্রোতের প্রভাবে কানাডার পূর্ব উপকূলভাগ বছরে আট নয় মাস বরফাচ্ছাদিত থাকে ।

(৪) জলবায়ুর পরিবর্তন (Changes of Climate) : সমুদ্রস্রোতের প্রভাবে আঞ্চলিক জলবায়ুরও পরিবর্তন ঘটে । যেমন—

(i) উষ্ণ ও শীতল স্রোতের মিলনস্থলে ঘন কুয়াশা ও ঝড়ঝঞ্ঝার  সৃষ্টি হয় । উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের উপর দিয়ে প্রবাহিত উষ্ণ ও আর্দ্র বায়ু এবং শীতল ল্যাব্রাডার স্রোতের উপর দিয়ে প্রবাহিত শীতল ও শুষ্ক বায়ু পরস্পর সংমিশ্রণের ফলে নিউ ফাউন্ডল্যান্ড উপকূলে প্রবল ঝড় ও ঘন কুয়াশার সৃষ্টি হয় । এইজন্য এই অঞ্চলে জাহাজ চলাচল বিপজ্জনক । 

(ii) উষ্ণ স্রোতের ওপর জলীয়বাষ্পপূর্ণ বায়ু ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টিপাত এবং শীতল স্রোতের ওপর জলীয়বাষ্প ঘনীভূত হয়ে তুষারপাত ঘটায় । এই কারণে ইংল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলে বৃষ্টিপাত এবং কানাডার ল্যাব্রাডর উপকূলে তুষারপাত ঘটে ।

(iii) প্রশান্ত মহাসাগরে পেরু ও ইকুয়েডর উপকূল দিয়ে মাঝে মাঝে প্রচন্ড উষ্ণ স্রোত প্রবাহের ফলে এল নিনোর প্রভাবে পূর্ব আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশসমূহে আবহাওয়ার অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটে ।

(৫) পোতাশ্রয় বরফ মুক্ত (Frost-free Harbours) উষ্ণ স্রোতের প্রভাবে শীতপ্রধান দেশের বন্দর ও পোতাশ্রয় বরফ মুক্ত থাকে ।

(৬) জাহাজ চলাচল (Navigation) : স্রোতের অভিমুখে জাহাজ চালানো সুবিধাজনক । সমুদ্রস্রোতের অনুকূলে জাহাজ সহজে দ্রুতগতিতে চালানো সম্ভব হয় ।

শৈবাল সাগর : সমুদ্রস্রোতের চক্রাকার আবর্তনের ফলে সৃষ্ট জলাবর্তের মাঝের স্রোতহীন অংশে শৈবাল, আগাছা প্রভৃতি জন্মায় । একে শৈবাল সাগর বলে । সাধারণত মহাসাগরের মধ্যভাগের স্রোতহীন, শৈবাল বা আগাছাভরা শান্ত অংশই হল শৈবাল সাগর (Sargasso Sea) । প্রশান্ত মহাসাগরে বিশাল শৈবাল সাগর দেখা যায় ।

হিমপ্রাচীর : সমুদ্রে উষ্ণ স্রোতের ঘন নীল জলের পাশ দিয়ে প্রবাহিত শীতল স্রোতের ঘন সবুজ জলের মাঝের স্পষ্ট বিভেদরেখাকে হিমপ্রাচীর বলে । নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের কাছে উত্তরমুখী উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোত ও দক্ষিণমুখী শীতল ল্যাব্রাডর স্রোতের মাঝে হিমপ্রাচীর দেখা যায় ।

*****

Comments

Related Items

সমুদ্রস্রোত (Ocean Currents)

সমুদ্রস্রোত (Ocean Currents) : সমুদ্রের জলরাশি নিয়মিতভাবে, নির্দিষ্ট দিকে একস্থান থেকে অন্যস্থানে প্রবাহিত হয় । সমুদ্রজলের এই প্রবাহকে সমুদ্রস্রোত বলে । সমুদ্রস্রোত সাধারণত একমুখী হয় । বায়ুপ্রবাহ দ্বারা তাড়িত হয়ে সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয় বলে এর গতিব

বারিমন্ডল (Hydrosphere)

বারিমন্ডল (Hydrosphere) : সৃষ্টির প্রথম অবস্থায় পৃথিবী ছিল এক উত্তপ্ত জ্বলন্ত মণ্ডল । ধীরে ধীরে শীতল ও ঘনীভূত হয়ে তরল অবস্থায় আসে এবং অবিরাম তাপ বিকিরণ করে পৃথিবী ক্রমশ শীতল ও সংকুচিত হয় । আর সংকোচনের ফলে ভূপৃষ্ঠের গায়ে উঁচুনীচু আবরণের সৃষ্টি হয় । এই সম

পৃথিবীর জলবায়ু অঞ্চল (Major climatic regions of the world)

পৃথিবীর জলবায়ু অঞ্চল (Major climatic regions of the world) : পৃথিবীর যে সকল অঞ্চলে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে মোটামুটি একই ধরনের বা সমধর্মী জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়, সেই সকল অঞ্চলকে এক-একটি জলবায়ু অঞ্চল বলা হয় । পৃথিবীর মুখ্য জলবায়ু অঞ্চলগুলি হল —

বিভিন্ন প্রকারের বৃষ্টিপাত (Types of Rainfall)

বিভিন্ন প্রকারের বৃষ্টিপাত (Types of Rainfall) : উৎপত্তির কারণ ও বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য অনুসারে বৃষ্টিপাতকে সাধারণত তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, যথা:- (১) পরিচলন বৃষ্টিপাত, (২) শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত এবং (৩) ঘূর্ণবাত বৃষ্টিপাত ।

অধঃক্ষেপণ (Precipitation)

অধঃক্ষেপণ (Precipitation) : সূর্যের উত্তাপে ভূপৃষ্ঠের সমুদ্র, হ্রদ, নদী, পুকুর, খাল, বিল প্রভৃতি জলরাশি থেকে জল জলীয়বাষ্পে পরিণত হয় । জলীয়বাষ্পপূর্ণ বাতাস হাল্কা হওয়ার দরুন ঊর্ধগামী হয় । উপরের বায়ুমণ্ডলের প্রবল শৈত্যের সংস্পর্শে এলে ঘনিভবনের ফলে জলীয়বাষ