সমভূমির বৈশিষ্ট্য কী ? উদাহরণসহ বিভিন্ন প্রকার সমভূমির বর্ণনা দাও

Submitted by avimanyu pramanik on Sun, 12/26/2021 - 14:30

প্রশ্ন:- সমভূমির বৈশিষ্ট্য কী ? উদাহরণসহ বিভিন্ন প্রকার সমভূমির বর্ণনা দাও ।

উত্তর : সমুদ্রপৃষ্ঠের একই সমতলে বা সামান্য উঁচুতে ৩০০ মিটারের মধ্যে অবস্থিত সমতল স্থলভাগকে সমভূমি (Plain) বলে । পৃথিবীর বেশিরভাগ সমভূমি সমুদ্র উপকূল এবং নদী অববাহিকায় গড়ে উঠেছে ।

সমভূমির বৈশিষ্ট্য :-

(১) সমভূমির উপরিভাগ সাধারণত সমতল হয়;

(২) সমভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বেশি উঁচু হয়না;

(৩) কোনো কোনো স্থানে সমভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বেশ কিছুটা উঁচু হয়, যেমন— উত্তর আমেরিকার রকি পর্বতের পাদদেশের সমভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বেশ খানিকটা উঁচু;

(৪) কোনো কোনো স্থানের সমভূমি আবার সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কিছুটা নীচে অবস্থিত হয়, যেমন— এশিয়া মহাদেশের কাস্পিয়ান সাগরের উপকূল ভাগের সমভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে নীচু;

(৫) কখনও কখনও সমভূমি সামান্য কিছুটা ঢেউখেলানো হয়, যেমন— বর্ধমান জেলার সমভূমি কিছুটা ঢেউ খেলানো ।

বিভিন্ন প্রকারের সমভূমি

উৎপত্তি ও ভূমিরূপ গঠনের বৈচিত্র্য অনুসারে পৃথিবীর সমভূমিগুলিকে প্রধান তিন ভাগে ভাগ করা যায়, যথা—

(ক) সঞ্চয়জাত সমভূমি,  (খ) ক্ষয়জাত সমভূমি এবং  (গ) ভূ-আন্দোলনের ফলে গঠিত সমভূমি ।

(ক) সঞ্চয়জাত সমভূমি : যুগ যুগ ধরে পলি সঞ্চিত হওয়ার ফলে নদী, সমুদ্র বা হ্রদ ভরাট হয়ে যে সমভূমির সৃষ্টি হয়, তাকে সঞ্চয়জাত সমভূমি বলা হয় । উৎপত্তি অনুসারে সঞ্চয়জাত সমভূমিকে আট ভাগে ভাগ করা হয়, যেমন—

(i) পলিগঠিত সমভূমি (Alluvial Plain):- অনেকদিন ধরে নদীর দুপাশে বা নদী মোহনায় নদীবাহিত পলি সঞ্চিত হয়ে এই ধরনের সমতল ভূভাগের সৃষ্টি হয় । উদাহরণ— উত্তর ভারতের সিন্ধু, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র সমভূমি এই রকমের সমভূমির উদাহরণ ।

(ii) প্লাবনসমভূমি এবং স্বাভাবিক বাঁধ (Flood Plain):- নদী তার নিম্নগতিতে সমুদ্রের কাছা কাছি চলে এলে নদীর ভূমির ঢাল হ্রাস পায় এবং নদী বাহিত শিলাখন্ড, নুড়ি, বালি প্রভৃতি নদীগর্ভে সঞ্চিত হতে থাকে যার ফলে নদীর গভীরতা ক্রমশ কমে যায় । বর্ষাকালে হঠাৎ নদীতে জল বেড়ে গেলে এই অগভীর নদী উপত্যকা অতিরিক্ত জল বহন করতে পারে না, এর ফলে নদীতে বন্যা দেখা দেয় । বন্যার জল দুকূল প্লাবিত করে এবং প্লাবিত অঞ্চলে বালি, কাদা, পলি প্রভৃতি সঞ্চিত হয়ে এক নতুন ভূমিরূপ বা প্লাবন সমভূমির সৃষ্টি হয় । নদীর দুই তীরে বালি, কাদা, পলি প্রভৃতি ক্রমাগত জমা হলে নদী তীর ধীরে ধীরে বাঁধের মতো উঁচু হয়ে যায় এই বাঁধ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়, তাই একে স্বাভাবিক বাঁধ বলে । পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গার গতিপথের দুপাশে প্লাবনভূমি ও স্বাভাবিক বাঁধ দেখা যায় । কলকাতা শহর গঙ্গার স্বাভাবিক বাঁধের উপর অবস্থিত ।

(iii) ব-দ্বীপ সমভূমি (Deltaic Plain) : নদীর মোহনায় নদীবাহিত পলি, নুড়ি, কাঁকর, কাদা, বালি, ইত্যাদি জমে অনেকটা মাত্রাহীন ‘ব’ -এর মত যে সমতল ভূভাগ সৃষ্টি হয় তাকে ব-দ্বীপ সমভূমি বলে ।

উদাহরণ: গঙ্গা নদীর ব-দ্বীপটি হল পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ সমভূমি ।

(iv) উপকূল সমভূমি (Coastal Plain) : উপকূলের কাছাকাছি সমুদ্রের অগভীর অংশ নদীবাহিত পলিদ্বারা ভরাট হয়ে যে সমতল ভূমি সৃষ্টি হয় তাকে উপকূল সমভূমি বলে । দিঘার নিকটবর্তী জুনপুটে পলি জমে এরকম সমভূমির সৃষ্টি হয়েছে ।

(v) হ্রদ সমভূমি: নদীবাহিত বালি, নুড়ি, কাঁকর, পলি প্রভৃতি দ্বারা কোনো হ্রদ ভরাট হলে কালক্রমে যে সমভূমির সৃষ্টি হয় তাকে হ্রদ সমভূমি বলে । কাশ্মীর উপত্যকা ও উত্তরবঙ্গের তাল সমভূমি অঞ্চল হ্রদ ভরাট হয়ে সৃষ্টি হয়েছে ।

(vi) লাভা সমভূমি (Lava Plain) : আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ফলে পৃথিবীর ভিতরকার গলিত লাভা ভূগর্ভের ফাটল দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে অনেক সময় যে সমতল ভূমির সৃষ্টি করে, তাকে লাভা সমভূমি বলে । দাক্ষিণাত্যের উত্তর-পশ্চিম দিকের কিছু অংশে লাভা সমভূমি দেখা যায় ।

(vii) হিমবাহ সমভূমি : যেসব সমভূমি হিমবাহের প্রবল চাপ, ঘর্ষণ প্রভৃতি কারণের ফলে সৃষ্টি হয়, তাদের হিমবাহ সমভূমি বলে । ভারতের কাশ্মীর ও কুমায়ুন অঞ্চলে এই ধরনের সমভূমি দেখা যায় ।

(viii) লোয়েস সমভূমি (Loess Plain) : মরুভূমির সূক্ষ্ম বালিরাশি কখনও কখনও বহুদূরে উঁড়ে গিয়ে সঞ্চিত হয়ে যে সমভূমি সৃষ্টি করে তাকে লোয়েস সমভূমি বলে । যেমন— চিনের হোয়াংহো নদীর অববাহিকায় এই ধরনের সমভূমি দেখা যায় ।

(খ) ক্ষয়জাত সমভূমি:  নীচু মালভূমি ও পার্বত্য অঞ্চল বহুদিন ধরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যে সমভূমির সৃষ্টি হয়, তাকে ক্ষয়জাত সমভূমি বলে ।

ক্ষয়জাত সমভূমিকে প্রধানত দু ভাগে ভাগ করা যায়, যথা— (i) সমপ্রায় ভূমি এবং (ii) পাদদেশীয় সমভূমি বা পেডিমেন্ট

(i) সমপ্রায় ভূমি:  নদীর জলপ্রবাহ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে প্রাচীন মালভূমি এবং উচ্চভূমি বহুদিন ধরে ক্ষয় পেতে পেতে এক সময় উঁচু-নীচু ঢেউ খেলানো ভূমি বা প্রায়-সমতলভূমিতে পরিণত হয়, এদের সমপ্রায় ভূমি বলে । যেমন— ঝাড়খন্ড রাজ্যের ছোটনাগপুর মালভূমির কোনো কোনো অংশ সমপ্রায় ভূমি এবং এদের মধ্যে পরেশনাথ ও পাঞ্চেত পাহাড় দুটি হল মোনাডনক ।

(ii) পাদদেশীয় সমভূমি বা পেডিমেন্ট : ক্রমাগত জল এবং বায়ুর ক্ষয় ও সঞ্চয় কাজের ফলে মরুভূমি অঞ্চলে পর্বতের ঢাল ও পাদদেশভাগ যখন পাথরে ঢাকা ঢালু সমতল ভূমিতে পরিণত হয় তখন তাকে পাদদেশীয় সমভূমি বা পেডিমেন্ট বলে । যেমন— আফ্রিকা মহাদেশের সাহারা মরুভূমি অঞ্চলে অ্যাটলাস পর্বতের পাদদেশে পেডিমেন্ট দেখা যায় ।

(গ) ভূ-আন্দোলনের ফলে গঠিত সমভূমি: ভূমিকম্পের ফলে এই ধরনের সমভূমির সৃষ্টি হয় ।

(i) উন্নত সমভূমি- ভূমিকম্পের ফলে ভূপৃষ্ঠের নীচু স্থান উঁচু হয়ে উন্নত সমভূমির সৃষ্টি করে, যেমন- ভারতের করমন্ডল উপকূল ।

(ii) অবনত ভূমি- ভূমিকম্পের ফলে ভূপৃষ্ঠের কোনো উঁচু স্থান বসে গিয়ে অবনত সমভূমি সৃষ্টি করে । তুরানের নিম্ন সমভূমি অবনত সমভূমির উদাহরণ ।

*****

Comments

Related Items

সমুদ্রস্রোত (Ocean Currents)

সমুদ্রস্রোত (Ocean Currents) : সমুদ্রের জলরাশি নিয়মিতভাবে, নির্দিষ্ট দিকে একস্থান থেকে অন্যস্থানে প্রবাহিত হয় । সমুদ্রজলের এই প্রবাহকে সমুদ্রস্রোত বলে । সমুদ্রস্রোত সাধারণত একমুখী হয় । বায়ুপ্রবাহ দ্বারা তাড়িত হয়ে সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয় বলে এর গতিব

বারিমন্ডল (Hydrosphere)

বারিমন্ডল (Hydrosphere) : সৃষ্টির প্রথম অবস্থায় পৃথিবী ছিল এক উত্তপ্ত জ্বলন্ত মণ্ডল । ধীরে ধীরে শীতল ও ঘনীভূত হয়ে তরল অবস্থায় আসে এবং অবিরাম তাপ বিকিরণ করে পৃথিবী ক্রমশ শীতল ও সংকুচিত হয় । আর সংকোচনের ফলে ভূপৃষ্ঠের গায়ে উঁচুনীচু আবরণের সৃষ্টি হয় । এই সম

পৃথিবীর জলবায়ু অঞ্চল (Major climatic regions of the world)

পৃথিবীর জলবায়ু অঞ্চল (Major climatic regions of the world) : পৃথিবীর যে সকল অঞ্চলে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে মোটামুটি একই ধরনের বা সমধর্মী জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়, সেই সকল অঞ্চলকে এক-একটি জলবায়ু অঞ্চল বলা হয় । পৃথিবীর মুখ্য জলবায়ু অঞ্চলগুলি হল —

বিভিন্ন প্রকারের বৃষ্টিপাত (Types of Rainfall)

বিভিন্ন প্রকারের বৃষ্টিপাত (Types of Rainfall) : উৎপত্তির কারণ ও বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য অনুসারে বৃষ্টিপাতকে সাধারণত তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, যথা:- (১) পরিচলন বৃষ্টিপাত, (২) শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত এবং (৩) ঘূর্ণবাত বৃষ্টিপাত ।

অধঃক্ষেপণ (Precipitation)

অধঃক্ষেপণ (Precipitation) : সূর্যের উত্তাপে ভূপৃষ্ঠের সমুদ্র, হ্রদ, নদী, পুকুর, খাল, বিল প্রভৃতি জলরাশি থেকে জল জলীয়বাষ্পে পরিণত হয় । জলীয়বাষ্পপূর্ণ বাতাস হাল্কা হওয়ার দরুন ঊর্ধগামী হয় । উপরের বায়ুমণ্ডলের প্রবল শৈত্যের সংস্পর্শে এলে ঘনিভবনের ফলে জলীয়বাষ