মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের সংজ্ঞা ও কাজ

Submitted by arpita pramanik on Mon, 11/26/2012 - 19:00

মানুষের স্নায়ুতন্ত্র ও জ্ঞানেন্দ্রিয়

উত্তেজিতা (Irritability) অর্থাৎ উত্তেজনায় সাড়া দেওয়া জীবের একটি বিশেষ ধর্ম । পরিবেশ থেকে আসা নানান রকম উদ্দীপনা (Stimuli) যেমন; চাপ, তাপ, ব্যথা, স্পর্শ, আলো, শব্দ, স্বাদ, গন্ধ ইত্যাদি গ্রহণের জন্য প্রাণীদেহে রিসেপ্টর (receptor) নামে এক রকমের গ্রাহক যন্ত্র থাকে । রিসেপ্টর থেকে গৃহীত উদ্দীপনা পরিবহনের জন্য প্রাণীদেহে অসংখ্য স্নায়ুকোষ (nerve cell) বা নিউরোন (neurone) থাকে । উচ্চতর প্রাণীদের ক্ষেত্রে এক বা একাধিক স্নায়ুকোষ দিয়ে গঠিত সাদা বা ধুসর রং -এর সরু সুতার মতো এক রকমের তন্তু সৃষ্টি হয়েছে, যাদের স্নায়ু বা নার্ভ (nerve) বলা হয় । প্রকৃতপক্ষে, স্নায়ুর সাহায্যেই স্নায়ুস্পন্দন গ্রাহকযন্ত্র বা রিসেপ্টর থেকে নিয়ন্ত্রক কেন্দ্র অর্থাৎ কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে এবং সেখান থেকে প্রেরকযন্ত্রে অর্থাৎ ইফেকটরে, যেমন, পেশি, গ্রন্থি ইত্যাদি স্থানে পৌছায় । স্নায়ুর সাহায্যেই প্রাণীদেহের বিভিন্ন যন্ত্র (organs) এবং তন্ত্রের (system) মধ্যে সমন্বয়সাধন ([co-ordination) করা সম্ভব্পর হয় । রিসেপটর দ্বারা গৃহীত উদ্দীপনা যখন নিউরোন বা স্নায়ুর মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে ইফেকটরে পৌঁছায় তখন তারা (ইফেকটরগুলো) উদ্দীপিত হয় । ফলে প্রাণীরা উত্তেজনায় সাড়া দেয় । প্রাণীদের উত্তেজনায় সাড়া দেওয়ার উদাহরণ হল :-

(ক)  চোখে হটাৎ উজ্জ্বল আলো পড়লে আমরা চোখ বন্ধ করি । 

(খ)  ত্বকে অর্থাৎ চামড়ায় সুঁচ ফোটালে আমরা ব্যথাপাই ও মুখ দিয়ে অস্ফুট আওয়াজ বের করি ।

(গ)  একটি কেন্নোর গায়ে কাঠি দিয়ে স্পর্শ করলে কেন্নোটি তত্ক্ষণাৎ গুটিয়ে যায় ।

(ঘ)  চলমান শামুকের মাংসল পায়ে একটি কাঠি দিয়ে স্পর্শ করলে শামুকটি তত্ক্ষণাৎ পা-টিকে খোলকের মধ্যে ঢুকিয়ে নেয় ।

প্রাণীদেহে এই শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াগুলি স্নায়ুতন্ত্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় । প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, উদ্ভিদদেহে কোনও স্নায়ুতন্ত্র নেই, তবু এরা বাইরের বিভিন্ন উদ্দীপকের প্রভাবে সাড়া দেয়,  যেমন :

(ক)  উদ্ভিদের কান্ড, শাখা-প্রশাখা প্রভৃতির আলোর দিকে বৃদ্ধি পাওয়া ।

(খ)  পদ্মফুল দিনের আলোয় ফুটে আবার অন্ধকারে বুঁজে যায় ।

(গ)   লজ্জাবতী লতা স্পর্শ করলে পত্রকগুলি তত্ক্ষণাৎ বুঁজে যায় ।

উদ্ভিদের এরকম উদ্দীপনায় সাড়া দেওয়া স্নায়ু তন্ত্রের সাহায্যে ঘটে না, এগুলি উদ্ভিদের একরকমের চলন (Movement) ।

স্নায়ুতন্ত্রের সংজ্ঞা (Definition of Nervous System) :-  নিউরোন বা স্নায়ুকোষ দিয়ে গঠিত যে তন্ত্রের সাহায্যে উন্নত প্রাণীদেহে প্রয়োজন মতো উদ্দীপনা গ্রহণ, উদ্দীপনায় সাড়া দিয়ে পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা এবং দেহের বিভিন্ন অঙ্গ ও তন্ত্রের মধ্যে সমন্বয়সাধন করা হয়, তাকে স্নায়ুতন্ত্র বলে । 

স্নায়ুতন্ত্রের কাজ (Functions of Nervous System)

[১] সমন্বয়সাধন:- স্নায়ুতন্ত্র প্রাণীদেহের বিভিন্ন অঙ্গ ও তন্ত্রের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে তাদের কাজের মধ্যে সমন্বয় ঘটায় ।

[২] উদ্দীপনায় সাড়া দান:- বিভিন্ন উদ্দীপনায় প্রয়োজনমতো সাড়া দিয়ে পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে প্রাণীকে খাপ খাইয়ে বা মানিয়ে নিতে স্নায়ুতন্ত্র সাহায্য করে । 

[৩] পেশি ও গ্রন্থির কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ:- স্নায়ুতন্ত্র প্রাণীদেহের বিভিন্ন পেশির সংকোচন ও গ্রন্থির ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে ।

[৪]  মানসিক ও প্রতিবর্ত ক্রিয়া পরিচালন:- মানসিক অনুভূতি, বুদ্ধি, বিচার, চিন্তা ইত্যাদি মানসিক ক্রিয়া ও প্রতিবর্ত ক্রিয়া পরিচালনা করা স্নায়ুতন্ত্রের অন্যতম প্রধান কাজ ।

স্নায়ুতন্ত্রের উদ্দীপনা পরিবহনকারী উপাদান (Components for conduction of Stimuli of Nervous System)

পরিবেশ থেকে আগত বিভিন্ন উদ্দীপনা গ্রহন, উদ্দীপনায় সাড়া দেওয়া, দেহের বিভিন্ন যন্ত্র ও তন্ত্রের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা ইত্যাদি বিভিন্ন কাজ করার জন্যে স্নায়ুতন্ত্রে তিন রকমের উদ্দীপনা পরিবহনকারী উপাদান থাকে , যথা [i] গ্রাহক,  [ii] কারক  এবং [iii] বাহক

[i] গ্রাহক [Receptor]:- প্রাণীদেহে অবস্থিত এক বা একাধিক উদ্দীপক সংবেদনশীল কোষকে রেসেপটর বা গ্রাহক বলা হয় । রিসেপটর দেহের ত্বকে, পেশিতে, কন্ডরায় (tendon), জিহ্বায়, কর্ণে, নাসিকা এবং চক্ষুর মধ্যে অবস্থিত । উদ্দীপনা গ্রহণের প্রকৃতি এবং অবস্থান অনুযায়ী গ্রাহক নানা রকম হয়, যেমন : চাপ-গ্রাহক, তাপ-গ্রাহক, টান-গ্রাহক, স্পর্শ-গ্রাহক, স্বাদ-গ্রাহক, আলোক-গ্রাহক, বর্ণ-গ্রাহক, শব্দ-গ্রাহক, ঘ্রাণ-গ্রাহক, শৈত্য-গ্রাহক ইত্যাদি । যে সমস্ত গ্রাহকরা দেহের বাইরে থেকে উদ্দীপনা গ্রহন করে তাদেরকে বাহিঃগ্রাহক বলে এবং যে সমস্ত গ্রাহকরা দেহের অভ্যন্তর থেকে উদ্দীপনা গ্রহন করে তাদেরকে অন্তঃগ্রাহক বলে । 

[ii] কারক [Effectors]:- জীবদেহের যেসব যন্ত্র বিভিন্ন উদ্দীপনায় উদ্দীপিত হয়, তাদের ইফেকটর বা কারক বলে । বিভিন্ন পেশী এবং গ্রন্থি [Gland] হল ইফেকটর বা কারকের উদাহরণ ।

[iii] বাহক [Conductor]:- স্নায়ুতন্ত্রের যেসব উপাদানের মাধ্যমে গ্রাহক বা রিসেপটর কর্তৃক গৃহীত উদ্দীপনা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে পৌঁছায় বা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র থেকে সাড়া বা রেসপনস যাদের মাধ্যমে ইফেকটর বা কারকে পৌঁছায়, তাদের বাহক বলে বা কন্ডাক্টর বলে । নিউরোন এবং স্নায়ু বাহকের কাজ করে । বাহক দু'রকমের হয়, যথা: —সংজ্ঞাবহ বাহক এবং আজ্ঞাবহ বাহক । 

সংজ্ঞাবহ বাহক:- যে বাহকের মাধ্যমে উদ্দীপনা রিসেপটর থেকে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে পৌঁছায় তাকে সংজ্ঞাবহ বাহক বলে ।

আজ্ঞাবহ বাহক:- যে বাহকের মাধ্যমে সাড়া কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র থেকে ইফেক্টরে পৌঁছায় তাকে আজ্ঞাবহ বাহক বলে ।

রিসেপটর ও ইফেকটর-এর পার্থক্য (Difference between Receptor and Effectors)

বৈশিষ্ট্য রিসেপটর (গ্রাহক) ইফেকটর (কারক)
১. কাজ রিসেপ্টর উদ্দীপনা গ্রহন করে । ইফেকটর উদ্দীপনায় সাড়া দেয় ।
২. অবস্থান সংজ্ঞাবহ স্নায়ুর শুরুতে অবস্থান করে । আজ্ঞাবহ বা চেষ্টীয় স্নায়ুর শেষে অবস্থান করে ।
৩. উদাহরণ ত্বক, চক্ষু, কর্ণ, জিহ্বা প্রভৃতি জ্ঞানেনন্দ্রিয় গ্রাহক অঙ্গ হিসেবে কাজ করে । পেশি ও গ্রন্থি কারক হিসেবে কাজ করে ।

*****

Related Items

গিনিপিগের দ্বি-সংকর জননের পরীক্ষা

মেন্ডেলের দ্বি-সংকর জনন প্রক্রিয়াটি প্রাণীদেহেও ঘটানো যেতে পারে । একটি বিশুদ্ধ প্রলক্ষণযুক্ত কালো (রঙ) ও অমসৃণ (রোম) গিনিপিগের সঙ্গে একটি বিশুদ্ধ প্রলক্ষণযুক্ত সাদা (রঙ) ও মসৃণ (রোম) গিনিপিগের সংকরায়ণ ঘটালে প্রথম অপত্য জনুতে সব কালো ও অমসৃণ গিনিপিগ ...

গিনিপিগের একসংকর জননের পরীক্ষা

উদ্ভিদের মতো প্রাণীদের মধ্যেও একসংকর পরীক্ষা ঘটানো যেতে পারে । জনিতৃ জনুর একটি বিশুদ্ধ কালো গিনিপিগের সঙ্গে একটি বিশুদ্ধ সাদা গিনিপিগের সংকরায়ণ ঘটালে প্রথম অপত্য জনুতে শুধু মাত্র সংকর কালো গিনিপিগের সৃষ্টি হবে এখানে কালো রঙটি সাদার ওপর প্রকট ...

মেন্ডেল তাঁর পরীক্ষার জন্য মটর গাছ নির্বাচনের কারণ

বাগানের মিষ্টি মটর গাছে নিম্নলিখিত নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলি থাকায় মেন্ডেল তাঁর পরীক্ষার জন্য মটর গাছকে নমুনা হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন । মটর গাছ দ্রুত বংশবিস্তারে সক্ষম, তাই অল্প সময়ের মধ্যে বংশানুক্রম কয়েকপুরুষ ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব । মটর ফুল উভলিঙ্গ হওয়ায় মটর ...

মেন্ডেলের দ্বিসংকর পরীক্ষা

একই প্রজাতিভুক্ত দু'জোড়া বিকল্প চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন দু'টি জীবের সংকরায়ণ কে দ্বিসংকর জনন বা ডাই-হাইব্রিড ক্রস বলে । দ্বি-সংকর জননের পরীক্ষা থেকে মেন্ডেলের ধারণা হয়েছিল, জনিতৃ জনুর বৈশিষ্ট্যগুলি যে শুধুমাত্র অপত্য জনুতে আলাদাভাবে সঞ্চারিত হয় তাই নয়, উপরন্তু এই ...

মেন্ডেলের এক সংকর পরীক্ষা

একই প্রজাতিভুক্ত বিপরীতধর্মী এক-চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন দুটি জীবের মধ্যে যে যৌন জনন সম্পন্ন হয়, তাকে একসংকর জনন বা মনোহাইব্রিড ক্রস বলে । দুটি পৃথক পরীক্ষার সাহায্যে একসংকর পরনিষেক ব্যাখ্যা করা হল, একসংকর পরীক্ষা থেকে মেন্ডেল নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন ...