বংশগতি ও সম্পর্কিত কয়েকটি প্রয়োজনীয় সংজ্ঞা

Submitted by arpita pramanik on Mon, 12/17/2012 - 12:19

বংশগতি ও সম্পর্কিত কয়েকটি প্রয়োজনীয় সংজ্ঞা

বংশগতি (Heredity):- শিশু সন্তান জন্মানোর পর পরিবারের সেই নতুন সদস্যের সঙ্গে একই পরিবারের অন্য কোনও সদস্যের কিছু না কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায় । কেউ বলেন শিশুটি মায়ের মতো দেখতে হয়েছে,  কেউ বা বলেন শিশুটির চোখ দুটি বাবার মতো । আবার কেউ বলেন ঠাকুরমার মতো চুল পেয়েছে । এই সব মন্তব্যের মধ্যে কিছুটা বাড়াবাড়ি থাকলেও অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় বাবা-মা কিম্বা পিতৃমাতৃকূলের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য সন্তান-সন্ততিরা পেয়েই থাকে । বংশের এই সব বৈশিষ্ট্যগুলিকে বংশগত বৈশিষ্ট্য বলে । আর, যে পদ্ধতিতে এক জনু থেকে পরবর্তী জনুতে জীবের বংশগত বৈশিষ্ট্যগুলি সঞ্চারিত হয়, তাকে বংশগতি বলে ।

সংজ্ঞা:- যে প্রক্রিয়ায় পিতা-মাতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সন্তান-সন্ততির দেহে বংশপরম্পরায় সঞ্চারিত হয়, তাকে বংশগতি বলে

বংশগতির ফলে পিতা-মাতার বৈশিষ্ট্যাবলি সন্তান-সন্ততিতে সঞ্চারিত হয় । বংশের বংশগত বৈশিষ্ট্যগুলি পুরুষানুক্রমে এক জনু থেকে পরবর্তী জনুগুলিতে সঞ্চারিত হতে থাকে । জীবের এরকম বংশগত বৈশিষ্ট্যের সঞ্চারণকেই বংশগতি বা Heredity বলে ।

জিনতত্ত্বের জনক [Father of Genetics]:- 1866 খ্রিস্টাব্দে গ্রেগর জোহান মেন্ডেল [Gregor Johann Mendel] নামে একজন অস্ট্রিয়াবাসী (বর্তমানে চেকশ্লোভাকিয়ার অন্তর্গত) ধর্মযাজক বংশগতির মৌলিক সূত্রগুলি প্রথম আবিষ্কার করেন । মেন্ডেলের আবিষ্কৃত বংশগতির মৌলিক সূত্রগুলিকে মেন্ডেলতত্ত্ব বা মেন্ডেলবাদ [Mendelism] বলা হয় । বর্তমানে জিনতত্বের যেসব আধুনিক সূত্র বা তথ্য প্রচলিত আছে তা মেন্ডেলের আবিষ্কৃত তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এই কারণেই মেন্ডেলকে জিনতত্বের জনক [Father of Genetics] বলা হয় ।

বংশগতি সম্পর্কিত কয়েকটি প্রয়োজনীয় সংজ্ঞা (Some useful terms related to Heredity)

[1] অ্যালিল বা অ্যালিলোমর্ফ [Allele or Allilomorph]:-  সমসংস্থ ক্রোমোজোমের নির্দিষ্ট বিন্দুতে অবস্থিত বিপরীত বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রক উপাদানের এক-একটিকে অ্যালিল বা অ্যালিলোমর্ফ [Allele or Allilomorph] বলে ।  যেমন লম্বা-বেঁটে, সাদা-কালো ইত্যাদি জোড়া জোড়া বিপরীত বৈশিষ্ট্য নির্ধারণকারী জিন-যুগলের প্রত্যেকটিকে অ্যালিল বলে ।

[2]  প্রকট ও প্রচ্ছন্ন [Dominant and Recessive]:- দুটো বিপরীত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীবের মধ্যে পরনিষেক [cross] ঘটালে প্রথম অপত্য বংশে অর্থাৎ F1 জনুতে যে বৈশিষ্ট্যটি প্রকাশ পায় তাকে প্রকট [Dominant] বৈশিষ্ট্য এবং যে বৈশিষ্ট্যটি প্রকাশ পায় না অর্থাৎ সুপ্ত অবস্থায় থাকে তাকে প্রচ্ছন্ন [Recessive] বৈশিষ্ট্য বলে ।

[3]  খাঁটি অর্থাৎ বিশুদ্ধ এবং সংকর [Pure and Hybrid]:- যদি কোনও জীব বংশানুক্রমে তার বৈশিষ্ট্যগুলিকে হুবহু একই রকম বজায় রাখে তখন সেই বৈশিষ্ট্যগুলিকে খাঁটি অর্থাৎ বিশুদ্ধ [Pure] বলা হয়; অপরপক্ষে দুটি বিশুদ্ধ বিপরীত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীবের মধ্যে পরনিষেক ঘটানোর ফলে উত্পন্ন উভয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীবকে (যদিও কেবলমাত্র প্রকট বৈশিষ্ট্যই প্রকাশিত হয়) সংকর [Hybrid] বলে ।

[4]  সংকরায়ন [Hibridization]:- একই গণের অন্তর্ভুক্ত বিপরীত প্রলক্ষণযুক্ত দুটো জীবের মিলন ঘটিয়ে সংকর জীব সৃষ্টির পদ্ধতিকে সংকরায়ন বলে । যেমন : একটি বিশুদ্ধ কালো ও বিশুদ্ধ সাদা গিনিপিগের মিলন ঘটালে প্রথম অপত্য জনুতে সব সংকর কালো গিনিপিগের সৃষ্টি হবে ।

[5]  সমসংকর বা হোমোজাইগাস ও বিষমসংকর বা হেটেরোজাইগাস [Homozygous and Heterozygous]:- দুটো একই রকম বৈশিষ্ট্য সমন্বিত [যেমন; বিশুদ্ধ দীর্ঘ (TT) বা খর্ব (tt)] গ্যামেটের মিলনের ফলে যে বিশুদ্ধ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জাইগোট উত্পন্ন হয় তাকে হোমোজাইগোট বলে এবং হোমোজাইগোট থেকে সৃষ্ট জীবকে সমসংকর বা হোমোজাইগাস বলা হয়; আবার বিপরীত অর্থাৎ পৃথক বৈশিষ্ট্য সমন্বিত [যেমন; T এবং t] দুটি গ্যামেটের মিলনের ফলে যে সংকর জাইগোট উত্পন্ন হয় তাকে হেটেরোজাইগোট বলে এবং হেটেরোজাইগোট থেকে সৃষ্ট জীবকে বিষমসংকর বা হেটেরোজাইগাস বলে ।

[6]  ফেনোটাইপ ও জেনোটাইপ [Phenotype and Genotype]:- কোনো জীবের বৈশিষ্ট্যগুলির বাহ্যিক প্রকাশ ওই জীবের ফেনোটাইপ [Phenotype] বলে । আবার জীবের জিনের গঠন বা জিন-সংযুক্তির দ্বারা নির্ধারিত বৈশিষ্ট্যকে ওই জীবের জেনোটাইপ [Genotype]  বলে ।

[7]  জনু [Generation]:-  সংকরায়ণ অর্থাৎ পরনিষেককালে নির্বাচিত বিশুদ্ধ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীব দুটোকে জনিতৃ জনু [parental Generation] বা সংক্ষেপে 'P' জনু বলে । সংকরায়ণের ফলে উত্পন্ন (জনিতৃ জনু থেকে) জীবকে প্রথম অপত্য জনু [First fillial generation] বা সংক্ষেপে 'F1' জনু বলে । প্রথম অপত্য জনু থেকে উত্পন্ন দুটো জীবের মধ্যে সংকরায়ণ ঘটালে যে অপত্যের সৃষ্টি হবে তাদের দ্বিতীয় অপত্য জনু [Second fillial generation] বা সংক্ষেপে F2 জনু বলা হয় । 

[8]  একসংকর বা দ্বিসংকর জনন [Monohybrid and Dihybrid cross]:-  একজোড়া বিপরীত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সংকরায়ণ ঘটানোকে একসংকর জনন বলে । অপরপক্ষে, দু'জোড়া বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সংকরায়ণ ঘটানোকে দ্বিসংকর জনন বলে ।

*****

Related Items

কোশের গঠন ও বৈশিষ্ট্য

যে কোশে সংগঠিত নিউক্লিয়াস এবং পর্দাঘেরা কোশঅঙ্গাণু থাকে না সেই রকম কোশকে প্রোক্যারিওটিক কোশ বা আদি কোশ বলে । যে কোশে সুগঠিত বা সংগঠিত নিউক্লিয়াস এবং পর্দাঘেরা কোশ-অঙ্গাণু থাকে, সেই রকম কোশকে ইউক্যারিওটিক কোশ বা আদর্শ কোশ বলে । ...

অ্যাড্রিনালিন (Adrenaline)

অ্যাড্রিনাল গ্রন্থির মেডালা অঞ্চল থেকে অ্যাড্রিনালিন হরমোন নিঃসৃত হয় । অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিদ্বয় বৃক্ক দুটির ওপর অবস্থিত । অ্যাড্রিনালিনকে এপিনেফ্রিন ও বলা হয় । অ্যাড্রিনালিন প্রাণীদের সংকটকালীন বা জরুরিকালীন হরমোন নামে পরিচিত, কারণ বিপদকালে এই হরমোন দেহকে ...

ভাইরাস, জীবাণু, রোগ এবং স্বাস্থ্যবিধি

রোগসৃষ্টিকারী ভাইরাসের রোগসংক্রমণ প্রক্রিয়া, উপকারী ব্যাকটিরিয়া, মানবদেহে রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটিরিয়া, উপকারী ছত্রাক, অপকারী ছত্রাক, ক্ষতিকর প্রোটোজোয়া, রোগ এবং স্বাস্থ্যবিধি, টীকাকরণ এবং অনাক্রম্যতাকরণ, সাধারণ জীবাণু নাশকের ব্যবহার ...

অভিযোজন (Adaptation)

প্রত্যেক জীব সব সময়েই চেষ্টা করে তার পারিপার্শ্বিক পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে বা মানিয়ে নিতে এবং সেই পরিবেশ থেকে নানান রকমের সুবিধা পেতে । পরিবেশের বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজেকে ঠিক মতো মানিয়ে নিয়ে সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকা এবং বংশবৃদ্ধি ...

জৈব বিবর্তন বা অভিব্যক্তি (Evolution)

ল্যাটিন শব্দ 'Evolver' থেকে Evolution কথাটির উত্পত্তি হয়েছে । আর Evolution কথাটির অর্থ 'ক্রমবিকাশ' । পৃথিবীতে প্রথম উত্পন্ন জীব ছিল এককোশী এবং সরল প্রকৃতির । ওই এককোশী সরল জীব থেকে ধারাবাহিক পরিবর্তনের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত জটিল ..