প্রতিবর্ত ক্রিয়া (Reflex action)

Submitted by arpita pramanik on Thu, 11/29/2012 - 23:26

প্রতিবর্ত ক্রিয়া (Reflex action)

প্রাণীদেহে নির্দিষ্ট উত্তেজনার প্রভাবে যে তাত্ক্ষনিক, স্বতঃস্ফুর্ত ও অনৈচ্ছিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়,  তাকে প্রতিবর্ত ক্রিয়া বলে ।  প্রতিবর্ত ক্রিয়ার দুটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল —

(i) এই ক্রিয়া অনৈচ্ছিক এবং (ii) এটি সুষুম্নাকান্ড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত । সুতরাং সুষুম্নাকান্ড দিয়ে নিয়ন্ত্রিত প্রাণীদের অনৈচ্ছিক সাড়াকে প্রতিবর্ত ক্রিয়া বলা হয় ।

উদাহরণ :-  কোনও গরম বস্তুতে আচমকা হাত ঠেকে গেলে, সঙ্গে সঙ্গে হাতটির সরে আসা হল প্রতিবর্ত ক্রিয়ার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ ।

প্রতিবর্ত ক্রিয়ার ব্যাখ্যা :- রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে হটাৎ পায়ে কাঁটা বিঁধলে পা-টি তত্ক্ষণাৎ মাটি থেকে সরে যায় । এটি প্রতিবর্ত ক্রিয়ার একটি উদাহরণ । প্রতিবর্ত ক্রিয়াটি নিম্নরূপে ঘটে :  

(i)  পায়ের নিম্নতলের চামড়ায় অবস্থিত গ্রাহক বা রিসেপ্টের বেদনা অনুভূতি গ্রহণ করে ।

(ii)  এই বেদনা অনুভূতি রিসেপটর থেকে অন্তর্বাহী নিউরোন দিয়ে সুষুম্নাকান্ডে পৌঁছায় ।

(iii)  সুষুম্নাকান্ড থেকে সাড়া বহির্বাহী নিউরোন দিয়ে কারক বা ইফেক্টরে অর্থাৎ পায়ের পেশিতে পৌঁছায় ।

(iv)  এর পর পায়ের পেশিগুলি সংকুচিত হয়, ফলে পা-টি ভাঁজ হয়ে কাঁটা থেকে সরে যায় ।

প্রতিবর্ত ক্রিয়ার শ্রেণিবিভাগ (Classification of reflex action)

রুশ বিজ্ঞানী প্যাভলভ [Pavlov] প্রতিবর্ত ক্রিয়াকে দু-ভাগে ভাগ করেছেন; যথা -

(1) সহজাত বা শর্তবিহীন প্রতিবর্ত ক্রিয়া

(2) অভ্যাসগত বা শর্তাধীন প্রতিবর্ত ক্রিয়া ।

(1) সহজাত বা শর্তবিহীন প্রতিবর্ত ক্রিয়া [Congenital or Unconditional reflex action]:-  যে সমস্ত প্রতিবর্ত ক্রিয়া জন্মগত অর্থাৎ জন্মের সঙ্গে সঙ্গে বংশগত সুত্রে পূর্বপুরুষ থেকে প্রাপ্ত হয়, তাকে সহজাত প্রতিবর্ত ক্রিয়া বলে । এই প্রতিবর্ত ক্রিয়া শর্ত নিরপেক্ষ হওয়ায় একে শর্তবিহীন প্রতিবর্ত ক্রিয়াও বলে ।

জন্মের সঙ্গে সঙ্গে শিশুর স্তন্যপানের ইচ্ছা, উজ্জ্বল আলোকে চোখ বন্ধ হওয়া, লোভানীয় খাদ্যের উপস্থিতিতে লালা নিঃসরণ বিশেষ সময়ে মল-মুত্রের বেগ অনুভব করা ইত্যাদি সহজাত বা শর্তবিহীন প্রতিবর্ত ক্রিয়ার উদাহরণ । উত্পত্তি অনুসারে সহজাত প্রতিবর্ত ক্রিয়া দু'রকমের হয়, যেমন :  [i]  উপরিগত বা সুপারফসিয়াল প্রতিবর্ত ক্রিয়া এবং  [ii]  গভীর বা ডীপ প্রতিবর্ত ক্রিয়া ।

[i] উপরিগত বা সুপারফসিয়াল প্রতিবর্ত ক্রিয়া [Superficial reflex action]:-  প্রতিবর্ত ক্রিয়ার উদ্দীপনা যখন দেহের প্রান্তদেশ অর্থাৎ ত্বক, চোখ ইত্যাদি থেকে আসে ।

উদাহরণ : উজ্জ্বল আলোতে চোখ বন্ধ হওয়া, পায়ের তালে সুড়সুড়ি দিলে পায়ের পাতা সংকুচিত হওয়া ইত্যাদি ।

[ii] গভীর বা ডীপ প্রতিবর্ত ক্রিয়া [Deep reflex action]:- প্রতিবর্ত ক্রিয়ার উদ্দীপনা যখন দেহাভ্যন্তরস্থ কোনো পেশি, টেনডন ইত্যাদি থেকে উত্পন্ন হয় । যেমন: হাঁটু ঝাঁকুনি, চোয়াল ঝাঁকুনি, বাইসেপস ঝাঁকুনি ইত্যাদি ।

(2) অভ্যাসগত বা শর্তাধীন প্রতিবর্ত ক্রিয়া [Habitual or Conditional reflex action]:- যেসব প্রতিবর্ত ক্রিয়া জন্মের পর বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত হয়, তাকে অভ্যাসগত প্রতিবর্ত ক্রিয়া বলে । যেমন: কোনো কাজ বারবার অনুশীলন করলে কিছুদিন পর মস্তিষ্কের সাহায্য ছাড়াই ওই কাজটি করা সম্ভব হয় । এই রকম প্রতিবর্ত ক্রিয়া শর্ত সাপেক্ষ হওয়ায় একে শর্তাধীন প্রতিবর্ত ক্রিয়াও বলে । বিজ্ঞানী প্যাভলভ প্রতিদিন নির্দিষ্ট এক সময়ে ঘন্টাধ্বনি করে একটি কুকুরকে খাবার দিতেন । এইভাবে কয়েকদিন অনুশীলনের পর কুকুরটিকে খাবার না দিয়ে কেবল ঘন্টাধ্বনি করে দেখলেন যে, কুকুরটির লালা নিঃসরণ হয়েছে । এরকম প্রতিবর্ত ক্রিয়াকে তিনি অভ্যাসগত প্রতিবর্ত ক্রিয়া বা শর্তাপেক্ষ প্রতিবর্ত ক্রিয়ারূপে অভিহিত করেন । শিশুদের হাঁটতে শেখা, কথা বলতে শেখা ইত্যাদি এই জাতীয় প্রতিবর্ত ক্রিয়ার উদাহরণ ।

সহজাত প্রতিবর্ত এবং অভ্যাসগত প্রতিবর্তের পার্থক্য

SL সহজাত প্রতিবর্ত অভ্যাসগত প্রতিবর্ত
1 এই প্রতিবর্ত জন্মগত । এই প্রতিবর্ত জন্মগত নয়, অভ্যাসের দ্বারা অর্জিত ।
2 এই প্রতিবর্ত শর্তনিরপেক্ষ । এই প্রতিবর্ত শর্ত সাপেক্ষ ।
3 এই রকম প্রতিবর্তের জন্য পূর্ব অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় না । এই রকম প্রতিবর্তের জন্য পূর্ব অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় ।
4 এই রকম প্রতিবর্তের স্নায়ুপথ সরল এই রকম প্রতিবর্তের স্নায়ুপথ অপেক্ষাকৃত জটিল ।

উৎস অনুসারে প্রতিবর্ত ক্রিয়ার শ্রেণিবিভাগ : উত্স অনুসারে প্রতিবর্ত ক্রিয়াকে দু'ভাবে ভাগ করা হয়েছে, যেমন -

[i] সরল প্রতিবর্ত ক্রিয়া [Simple reflex action]:- যে প্রতিবর্ত ক্রিয়া কেবলমাত্র সুষুম্নাকান্ড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, এবং প্রতিবর্ত পথ অল্প সংখ্যক স্নায়ুকোষ দিয়ে গঠিত থাকে তাকে সরল প্রতিবর্ত ক্রিয়া বলে । যেমন : চোখে কিছু পড়ার উপক্রম হলে চোখ    দুটি আপনা থেকেই বুজে যায় ।     

[ii]  জটিল প্রতিবর্ত ক্রিয়া [Complex reflex action]:-  যে প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় সুষুম্নাকান্ড ছাড়াও মস্তিষ্কের সাহায্যের প্রয়োজন হয়, এবং প্রতিবর্ত পথে বহুসংখ্যক স্নায়ুকোষ থাকে, তাকে জটিল প্রতিবর্ত ক্রিয়া বলে । যেমন: হাঁটা-চলা, সাইকেল চালানো ব্যাঙের শিকার ধারা ইত্যাদি ।

*****

Related Items

অভিব্যক্তির সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা

যে মন্থর গতিশীল প্রক্রিয়ায় ধারাবাহিক পরিবর্তন ও ক্রমিক রুপান্তরের মাধ্যমে পূর্বপুরুষ অর্থাৎ সরল উদবংশীয় জীব থেকে নতুন ও অপেক্ষাকৃত জটিল জীবের উদ্ভব এবং ক্রমবিকাশ ঘটে, তাকে জৈব অভিব্যক্তি বা জৈব বিবর্তন বলে । চার্লস ডারউইন অভিব্যক্তিকে ...

মানুষের লিঙ্গ নির্ধারণ

দেহ গঠন ও লিঙ্গ নির্ধারণের বৈশিষ্ট্য অনুসারে ক্রোমোজোম দু-ধরণের হয়, - অটোজোম, সেক্স-ক্রোমোজোম । জীবের দেহজ বৈশিষ্ট্য নির্ধারক ক্রোমোজোমদের অটোজোম বলা হয় । মানুষের 46টি ক্রোমোজোমের মধ্যে 44টি অটোজোম থাকে । এই ক্রোমোজোমগুলি মানবদেহের ...

মেন্ডেলের বংশগতি সূত্র

মেন্ডেল বংশগতির দুটি সূত্র প্রবর্তন করেন । প্রথম সূত্রটি একসংকর জনন থেকে প্রাপ্ত এবং দ্বিতীয় সূত্রটি দ্বিসংকর জনন থেকে প্রাপ্ত । মেন্ডেলের প্রথম সূত্রটি 'পৃথকীভবনের সূত্র নামে পরিচিত । এই সূত্রানুযায়ী "কোনও জীবের একজোড়া বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্য একটি জনু থেকে আর ...

ড্রসোফিলার দ্বি-সংকর জননের পরীক্ষা

একটা হোমোজাইগাস ধূসর রং -এর লম্বা ডানাযুক্ত ড্রসোফিলার সাথে অপর একটি হোমোজাইগাস কালো রং -এর লুপ্তপ্রায় ডানাযুক্ত ড্রসোফিলার সংকরায়ণ ঘটালে F1 জনুতে প্রাপ্ত সব মাছিই ধূসর রং -এর এবং লম্বা ডানাযুক্ত হয়; অর্থাৎ ধূসর রং এবং লম্বা ডানার বৈশিষ্ট্যগুলি প্রকট । ...

ড্রসোফিলার একসংকর জননের পরীক্ষা

একটি ধূসর বর্ণের পুরুষ ড্রসোফিলার সাথে একটি কালো রং -এর স্ত্রীর সংকরায়ণের ফলে F1 -এ সব অপত্যই ধূসর রং -এর হয় এবং তাদের সংকরায়ণের ফলে F2 জনুতে ধূসর এবং কালো রঙের ড্রসোফিলা 3 : 1 অনুপাতে পাওয়া যায় । অর্থাৎ অপরপক্ষে, কালো রং - এর পুরুষের সাথে ধূসর ...