প্রাচীন ভারতের বহির্বাণিজ্য

Submitted by avimanyu pramanik on Sat, 03/31/2012 - 20:07

প্রাচীন ভারতের বহির্বাণিজ্য :

ভারতের বহির্বাণিজ্য –

(১) বৈদিক যুগ : ভারতের অধিকাংশ মানুষের জীবিকা ছিল কৃষি । বেশ কিছু মানুষ ব্যবসাবাণিজ্যও করত । অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্য উভয় কাজেই বণিকরা নিযুক্ত থাকত । ম্যাক্সমূলার, ল্যাসেন এবং জিমারের মতো পণ্ডিতগণের মতে ঋকবৈদিক যুগে আর্যরা সামুদ্রিক বাণিজ্যে অংশ নিতেন । কিথের মতে ঋকবেদে যাকে সমুদ্র বলা হয়েছে, আসলে তা সিন্ধুনদের মোহনার বিস্তৃত জলরাশি । তবে ঋকবেদে সিন্ধুকে সমুদ্রগামী বলে উল্লেখ করায় মনে হয় আর্যরা সমুদ্র ও নদীর মোহনার পার্থক্য বুঝতেন । অনেকেই তাই মনে করেন ঋকবৈদিক যুগে আর্যরা সামুদ্রিক বাণিজ্যে অংশ নিতেন । এই বাণিজ্য চলত উপকূল ধরে । অর্থাৎ, সাগর পাড়ি দেওয়ার কোনো ব্যাপার ছিল না । পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’ -এ সমুদ্রের উল্লেখ আছে । প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্যে বহির্বাণিজ্যের উল্লেখ আছে । প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে জানা যায় নাবিকেরা সমুদ্রপথ চেনার জন্য ‘দিশাকাক’ নামে এক পাখির সাহায্য নিত । ‘শঙ্খজাত’ থেকে জানা যায়, ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামুদ্রিক বাণিজ্য চলত । প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথা জানা যায় । এই বাণিজ্য চলত জল এবং স্থলপথে । ভারত থেকে বনৌষধি, মুক্তা, হিরা, প্রবাল, লোহা, তামা, চন্দন কাঠ, পশুচর্ম, গজদন্ত প্রভৃতি রপ্তানি হত । আর সুগন্ধি, কাচ, টিন, দামি পাথর, রং ইত্যাদি আমদানি করা হত ।

(২) মৌর্য যুগ : মৌর্য যুগে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ও সেই সঙ্গে ব্যাবসাবাণিজ্যেরও যথেষ্ট প্রসার ঘটেছিল । স্থল ও জল উভয় পথেই বহির্বাণিজ্য চলত । মেগাস্থিনিস একটি সুদীর্ঘ রাজপথের কথা বলেছেন, যার সঙ্গে মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার কোনো এক প্রধান সড়কের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বলে অনেকে মনে করেন । অনেকেই অনুমান করেন যে, এই সময় ভারতের বাণিজ্যতরী এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিত । অর্থশাস্ত্রে বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে । এই সময় কার্পাসরেশমের বস্ত্র, মশলা, মূল্যবান পাথর, মুক্তা, হাতির দাঁত প্রভৃতি দ্রব্য ভারত থেকে রপ্তানি করা হত । এই সময় তিনটি বন্দরের কথা জানা যায় । সেগুলি হল— তাম্রলিপ্ত, ভৃগুকচ্ছ এবং শূর্পারক । এর মধ্যে শেষের দুটি বন্দর পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত ছিল । মৌর্য যুগে ব্যবসাবাণিজ্যের ওপর নানাবিধ সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকলেও বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রতি রাষ্ট্র খুব সম্ভবত কিছুটা নরম নীতি অনুসরণ করত । বৈদেশিক বাণিজ্যে সরকারের উৎসাহ ছিল বলে মনে হয় । মৌর্য যুগে যে ব্যবসাবাণিজ্যের বিপুল প্রসার ঘটেছিল, তার প্রমাণ মেলে মুদ্রার ব্যাপক উপস্থিতি ।

(৩) মৌর্যোত্তর যুগ : মৌর্যোত্তর যুগে বহির্বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্যভাবে প্রসার ঘটেছিল । পশ্চিম ভারতের সিন্ধু ও গুজরাট অঞ্চলের সঙ্গে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ইউরোপের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল । চিন ও পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল । শক ও পহ্লব রাজাদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল । কিছুটা আকস্মিকভাবে পরিস্থিতির চাপে ভারতের সঙ্গে রোমের বাণিজ্যিক সম্বন্ধ স্থাপিত হয়েছিল । রোমের সঙ্গে স্থলপথে চিনের সরাসরি বাণিজ্য চলত । চিনের বিলাসসামগ্রী, বিশেষত রেশমের বিপুল চাহিদা ছিল রোমে । স্থলপথে দীর্ঘতম পথ অতিক্রম করে এই বাণিজ্য চলত বলে একে বলা হত ‘রেশম পথ’ । কিন্তু স্থলপথে ব্যবসা করবার বিরাট ঝুঁকি এবং নানা অসুবিধা ছিল । তাই বিকল্প পথের অনুসন্ধান শুরু হয় । আর এই বিকল্প পথ অনুসন্ধান করতে গিয়েই ভারত এই বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে । ৪৫ খ্রিস্টাব্দে হিপ্পালাস ভারত মহাসাগরে মৌসুমি বায়ুর গতি-প্রকৃতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন । এর ফলে ভূমধ্যসাগরের বন্দর থেকে প্রথমে লোহিত সাগর ও পরে আরব সাগরের মধ্য দিয়ে নৌ-চলাচল সম্ভব হয় । এর ফলে স্থলপথের উপর নির্ভরতা অনেকাংশে হ্রাস পায়, যাতায়াতের সময়ও হ্রাস হয় । এইভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভারতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে । কয়েকটি বন্দরও গড়ে ওঠে, যার নাম পেরিপ্লাস ও টলেমির ভূগোলে পাওয়া যায় । এইসব বন্দরের মধ্যে সিন্ধু নদের মোহনায় অবস্থিত বারবারিকাম বন্দর বিখ্যাত ছিল । গুজরাট উপকূলে ছিল সুরষ্ট্রিনি (সুরাট) এবং বারুগাজা বন্দর নর্মদার মোহনায় অবস্থিত । কোঙ্কন উপকূলে তিনটি বন্দরের নাম জানা যায় । সেগুলি হল সুপ্পারা (সোপারা), সিমুল্লা (মুম্বাইয়ের ২৩ মেইল দক্ষিণে চৌল) ও ক্যালিয়েনা (কল্যাণ) । কোঙ্কনের দক্ষিণেও কয়েকটি বন্দরের নাম জানা যায় । তবে এইসব বন্দরের গুরুত্ব অপেক্ষাকৃত কম ছিল । রোমের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল । এখান থেকেই মশলা রপ্তানি হত ।

চন্দন, সেগুন, আবলুস কাঠ, নানাবিধ মশলা (গোলমরিচ, লঙ্কা, তালচিনি), চাল, মাখন, বিভিন্ন ধরনের প্রসাধন সামগ্রী, হিরা, মুক্তামূল্যবান পাথর, সুক্ষমোটা সুতিবস্ত্র প্রভৃতি ভারত থেকে বিদেশে রপ্তানি হত । রোমে ভারতীয় জীবজন্তু, যেমন— বাঘ, সিংহ, বানর, তোতাপাখি -র খুব চাহিদা ছিল । এগুলি রপ্তানি হত স্থলপথে । বিদেশ থেকে যেসব দ্রব্য আমদানি করা হত, তারমধ্যে ছিল ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের প্রবাল, আরবের খেঁজুর, রোমের মদ, পশ্চিম এশিয়ার ধূপপ্রসাধন সামগ্রী, পশ্চিম এশিয়া ও মিশরের বস্ত্র, আরবের রূপোতামা, চিনের রেশমপশমের বস্ত্র ইত্যাদি ছিল প্রধান । বেশিরভাগ বাণিজ্য চলত রোমের সঙ্গে । প্লিনির গ্রন্থ থেকে জানা যায় রোম ভারত থেকে বিভিন্ন ধরনের বিলাস দ্রব্য কেনবার জন্য প্রচুর মুদ্রা খরচ করত । ভারতে প্রাপ্ত রোমের মুদ্রা প্লিনির বক্তব্যকে সমর্থন করে । রোম-ভারত বাণিজ্যে বাণিজ্যিক ভারসাম্যতা ছিল ভারতের দিকে । প্লিনির রচনা থেকে এও জানা যায় যে, ভারতীয় দ্রব্যসামগ্রী কেনবার জন্য রোমকে প্রতি বছর ৫৫০,০০০,০০০ মুদ্রা খরচ করতে হত । খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত রোমের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল । তবে পশ্চিম রোমের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকেই শেষ হয়ে গিয়েছিল । খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের পর থেকেই যে বৈদেশিক বাণিজ্যের অবনতি ঘটেছিল, তার প্রমাণ এই সময়ে স্বর্ণমুদ্রা প্রায় সম্পূর্ণ বিলোপ হয়ে যায় । সপ্তম শতকে স্থলপথ ও জলপথ উভয় দিকের কর্তৃত্বই চলে যায় আরবদের হাতে ।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্কের পরিচয় পাওয়া যায় । গঙ্গা নদীর মোহনা থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত ভারতের উপকূলে অনেক বন্দরের কথা ‘পেরিপ্লাস’ থেকে জানা যায় । এইসব বন্দরগুলির মধ্যে কামারা, পোডুকা এবং সোপাটমা উল্লেখযোগ্য । পেরিপ্লাস -এর লেখক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিকে সুবর্ণভূমি বলে উল্লেখ করেছেন । প্লিনি ও বৌদ্ধ সাহিত্যগ্রন্থ থেকেও এই অঞ্চলের বাণিজ্য সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া যায় । টলেমির রচনা থেকে জানা যায় তখন সমুদ্রপথে মালয়ের সঙ্গে চিকাকোল ও গঞ্জাম সন্নিহিত পলুরার সরাসরি যোগাযোগ ছিল । জাতকের কাহিনি ‘কথাসরিৎসাগর’ থেকে জানা যায় যে, ভারতীয় বণিকেরা ঘন ঘন সুবর্ণভূমিতে যাতায়াত করত এবং প্রচুর ধনরত্ন নিয়ে ভারতে ফিরত । এইসব দুঃসাহসিক সমুদ্র যাত্রায় যথেষ্ঠ ঝুঁকি ছিল এবং মাঝে মাঝে বাণিজ্য-পোতগুলি জলমগ্ন হত । ব্রোচ, বারাণসী ও ভাগলপুর থেকে ভারতীয় বণিকেরা ব্রহ্মদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল । বহু ভারতীয় বণিক স্থলপথে মালয়স্থিত থাক্কালা বন্দর থেকে চিন সাগর পর্যন্ত পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ চিনের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য করত । তাঙ যুগে (৬১৭ - ৯০৭) বহু ভারতীয় বণিক ক্যান্টন বন্দরে বসবাস করত এবং দক্ষিণ ভারতে এই যুগের বহু চিনা মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে । চোল রাজাদের আমলে ভারতের সঙ্গে চিনের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল । চোল আমলে প্রথমে মামল্লাপুরম ও পরে নাগাপট্টনম খুব বিখ্যত বন্দর ছিল ।

*****

Related Items

মিরজাফর (Mir Jafar)

চক্রান্ত, শঠতা ও বিশ্বাসঘাতকতার পথ ধরে বাংলার মসনদ দখল করলেও মিরজাফর গোড়া থেকেই তাঁর অসহায় এবং অক্ষম অবস্থার কথা বুঝতে পেরেছিলেন । আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সমস্যার চাপে তিনি ইংরেজদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন । তাঁর বিরুদ্ধে যে সব বিদ্রোহ হয়েছিল ...

নবাব সিরাজের সাফল্য ও ব্যর্থতা এবং পলাশির যুদ্ধের গুরুত্ব

প্রথমদিকে সিরাজ-উদ-দৌলার সাফল্য ছিল আশাতিত । তিনি বিনা রক্তপাতে মাসি ঘসেটি বেগমকে মুর্শিদাবাদ প্রাসাদে নজরবন্দি করেন । অপর প্রতিদ্বন্দ্বী আলিবর্দি খানের দ্বিতীয় কন্যার পুত্র পূর্ণিয়ার নবাব সৌকত জঙ্গকে মনিহারির যুদ্ধে পরাজিত করে সিংহাসন নিষ্কণ্টক করেন । তার আগেই তিনি ...

সিরাজ-উদ-দৌলা ও পলাশির যুদ্ধ

পলাশির যুদ্ধের দুটি দিক ছিল । (১) ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজের বিরোধ ও (২) বাংলার মসনদ দখলে মিরজাফরের উচ্চাকাঙ্খা । সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের সংঘর্ষের জন্য ইংরেজ ঐতিহাসিকরা সিরাজকেই দায়ী করেছেন । তাঁদের মতে, সিরাজের অহমিকা ও দম্ভ, অপরিমিত ...

বাংলার রাজনৈতিক পট পরিবর্তন

বাংলার রাজনৈতিক পট পরিবর্তন :- কর্ণাটকে যখন ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্ব চলছিল, মোটামুটি প্রায় সেই সময় বাংলায় রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হচ্ছিল । ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৭৬৫ খ্রীষ্টব্দের মধ্যে বাংলার কর্তৃত্ব স্বাধীন নবাবদের হাত থেকে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে যায় ...

তৃতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধ

সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে ভারতেও ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয় । কিন্তু ডুপ্লের মতো কোন যোগ্য নেতার অনুপস্থিতিতে ফরাসিরা যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছিল । এই সময়ে কর্ণাটকে যুদ্ধের দায়িত্বে ছিলেন লালি । কিন্তু সহকর্মীদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার ভালো ছিল না । ফলে ফরাসিদের মধ্যে ...