পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন শিল্প

Submitted by Nandarani Pramanik on Wed, 09/30/2020 - 21:35

 

ভূমিকা :-

"বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি ।

দেশে দেশে কত-না নগর রাজধানী —

মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু,

কত-না অজানা জীব, কত-না অপরিচিত তরু

রয়ে গেল অগোচরে । বিশাল বিশ্বের আয়োজন ;

মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ ।"

                                                                  — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বিশাল পৃথিবীর এক ক্ষুদ্র কোণে রয়েছে আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গ । ভৌগলিক দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গে পর্যটনের জন্য রয়েছে এক বিশাল সম্ভাবনা । এর উত্তরে রয়েছে শুভ্র তুষার কিরীট শোভিত হিমালয় পর্বত । দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিমে রয়েছে ছোট ছোট অনুচ্চ পাহাড়, অরণ্য, নদ-নদী । প্রাকৃতিক বৈচিত্রে পশ্চিমবঙ্গ অনন্য । কিন্তু পর্যটনে তেমন গুরুত্ব পায় নি প্রথম থেকে । আমরা বাঙালিরা অনেক পয়সা খরচ করে সময় ব্যয় করে দেশে-বিদেশে বেড়াতে যাই প্রতিবছর । কিন্তু নিজের বাড়ির কাছে দু-পা ফেলে একটি ধানের শিষের ওপর একটি শিশির বিন্দুর ওপর সূর্যকরোজ্জ্বল সৌন্দর্য উপভোগ করার কথা ভাবি না । অথচ পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে অনেক দর্শনীয় স্থান, অনেক ঐতিহাসিক স্থান ।

পশ্চিমবঙ্গের দর্শনীয় স্থান — পশ্চিমবঙ্গের দর্শনীয় স্থান গুলির মধ্যে অন্যতম হল উত্তরবঙ্গের শৈল শহর দার্জিলিং, কালিম্পং, যেখান থেকে দেখা যায় সাদা বরফে ঢাকা হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা, মিরিক লেক, ডুয়ার্সের অভয় অরণ্য প্রভৃতি । দক্ষিণে রয়েছে সৈকতাবাস দীঘা, মন্দারমণি, বকখালি, ফ্রেজারগঞ্জ, গঙ্গাসাগর আর রয়েছে পৃথিবী বিখ্যাত সুন্দরবন । যেখানে গভীর অরণ্যে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, ম্যানগ্রোভের জঙ্গল । ঐতিহাসিক স্থানগুলির মধ্যে রয়েছে মুর্শিদাবাদ, মালদহ, পাণ্ডুয়া, বিষ্ণুপুর, নবদ্বীপ প্রভৃতি অঞ্চলের প্রাচীন প্রাসাদ, মন্দির, মসজিদ, স্মৃতিসৌধগুলি । স্থাপত্যশিল্প, টেরাকোটার সূক্ষ্ম কারুকার্য যে-কোনো ভ্রমণপিপাসুর মন ভরিয়ে দেয় । নয়ন ভোলানো এই রূপের কোনো তুলনা করা যায় না । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে গড়া শান্তিনিকেতন আশ্রম যা আজ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় । তা শুধু কবিতীর্থ নয়, অন্যতম ভ্রমণতীর্থও বটে । শান্তিনিকেতনের কাছে-পিঠে রয়েছে বক্রেশ্বর, তারাপীঠ । বীরভূম-পুরুলিয়ায় অযোধ্যা পাহাড়, মামা-ভাগ্নে পাহাড়, মুকুটমণিপুর, শুশুনিয়া পাহাড় প্রভৃতি ভ্রমণার্থীদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় । এই সমস্ত ভ্রমণ কেন্দ্রগুলি ছাড়াও রয়েছে আমাদের মহানগরী রাজধানী কলকাতা । যেখানে রয়েছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল, জাদুঘর, চিড়িয়াখানা, বিড়লা তারামণ্ডল, পরেশনাথের মন্দির, সায়েন্সসিটি, হাওড়া ব্রিজ, দ্বিতীয় হুগলি সেতু, কালীঘাটের কালী মন্দির, দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দির, বেলুড় মঠ প্রভৃতি । কম খরচে, কম সময়ে, অনায়াসে বেরিয়ে এই সমস্ত স্থানগুলি দেখে নেওয়া যায় ।

পর্যটন শিল্পের অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও সম্ভাবনা — অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পর্যটন শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে । পর্যটনের সুবিধার জন্য রাস্তাঘাটের উন্নতি করা হয় । পরিবহনের জন্য প্রচুর সরকারি, বেসরকারি বাসের ব্যবস্থা করা হয় । প্রচুর হোটেল খোলা হয় । পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রচেষ্টায় সমস্ত ভ্রমণার্থীদের জন্য 'পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন বিকাশ নিগম' নামে সরকারি দপ্তর খোলা হয়েছে এবং বহু যাত্রী নিবাসও তৈরি হয়েছে । কিন্তু পর্যটন শিল্পের জন্য সরকারি উদ্যোগ যথেষ্ট নয় । আরও বেশি অর্থ উপার্জন করতে হলে সরকারি উদ্যোগ আরও বাড়াতে হবে । ভ্রমণার্থীদের জন্য সমস্ত সুবিধাযুক্ত হোটেলের ব্যবস্থা করতে হবে । রাস্তাঘাটের উন্নতি করতে হবে । যাতায়াতের সুবিধার জন্য পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে । পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য বিভিন্ন দেশি-বিদেশি পত্রিকার মাধ্যমে প্রচার চালাতে হবে । ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যের পর্যটন বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে । পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন শিল্পের উন্নতির জন্য সরকারকে আরও বেশি উদ্যোগী হতে হবে, তাহলেই অর্থ উপার্জনের পথ সহজ হবে ।

উপসংহার — শস্য-শ্যামলা, সুজলা-সুফলা, নদীমাতৃক বঙ্গভূমি প্রাকৃতিক বৈচিত্রে যেমন ভরপুর তেমনি সাংস্কৃতিক বৈচিত্রেও বাংলা অনন্য । এখাকার 'বারো মাসে তেরো পার্বণ' যেমন- রথের মেলা, দুর্গাপূজা, কালীপূজা, ভাতৃদ্বিতীয়া, নবান্ন উৎসব, শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা, দোলযাত্রা প্রভৃতি পর্যটনশিল্পের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নিয়েছে । এই উৎসবগুলিতে বাংলার বাইরে থেকে বহু মানুষ এখানে আসেন এবং উপভোগ করেন । বাঙালীর জাতীয় উৎসব দুর্গাপূজা যা শুধু বাঙালিদেরকে আনন্দে ভাসায় তা নয়, আপামর বঙ্গবাসীও আনন্দে মেতে ওঠে । পশ্চিবঙ্গের বর্ণাঢ্যময় উৎসবগুলোতে বহু দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকরা এসে যেমন পর্যটন শিল্পকে সমৃদ্ধ করে তেমনি এখানে এক মহামিলনের ক্ষেত্রও তৈরি হয় ।

***

Comments

Related Items

মহামানব যীশুখ্রীষ্ট

সবলদের অত্যাচারে দুর্বলদের জীবন যখন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, যখন সাধারণ মানুষের জীবন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায় তখনই কোনো এক মহামানবের আবির্ভাব ঘটে ।

বিজ্ঞান ও কুসংস্কার

ভূমিকা :- প্রাচীনকালে গৃহবন্দী মানুষ আত্মরক্ষার জন্য এবং প্রকৃতির রোষ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়েছে । নিজের অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি এবং বিচারবোধ থেকে সে ক্রমশ প্রকৃতির স্বরূপ উপলব্ধি করতে পেরেছে । জানতে পেরেছে প্রত্যেকটি ঘটনার পিছনে কিছু

সমাজ সচেতনতায় বিজ্ঞানের ভূমিকা

"বিজ্ঞান চায় সবার মাঝে প্রাণের কথা বলতে, অন্ধ আবেগ সরিয়ে দিয়ে আলোর পথে চলতে ।"

প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও তার প্রতিকার

"মন্বন্তরে মরিনি আমরা, মারি নিয়ে ঘর করি"— বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, মহামারী মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে । অথচ বিজ্ঞানের বলে বলিয়ান আমরা সদর্পে বলে চলেছি যে, প্রকৃতি আমাদের হাতের মুঠোয়, প্রকৃতি আমাদের কাছে বশীভূত । কিন্তু এ দর্প বা ধারণা সত্য নয় । মাঝে মধ্যেই প্রকৃতির রুদ্ররোষের কাছে মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে । প্রাকৃতিক বিপর্যয় ।

দেশ ভ্রমণের প্রয়োজনীয়তা

"হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি ।" মানুষ চির যাযাবর । মানুষের রক্তে রয়েছে ভ্রমণের নেশা । অজানাকে জানার অদেখাকে দেখার কৌতুহল মানুষের চিরন্তন ।