ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

Submitted by Nandarani Pramanik on Sat, 09/26/2020 - 08:17

Ishwar Chandraভূমিকা :- যুগে যুগে বাংলার বুকে যে সকল ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ জন্মেছেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁদের মধ্যে অন্যতম । ঈশ্বরচন্দ্রের পাণ্ডিত্য, চারিত্রিক দৃঢ়তা, কর্মনিষ্ঠা, নির্ভীকতা, হৃদয়বত্তা মানবসমাজে এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত । হিমালয়ের মতো বিশাল ও উন্নত মনের মানুষ ঈশ্বরচন্দ্র শুধুমাত্র বিদ্যাসাগর ছিলেন না, করুণার সিন্ধুও ছিলেন ।

জন্ম, পারিবারিক পরিচিতি ও শিক্ষাজীবন :- মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে সেপ্টেম্বরে ঈশ্বরচন্দ্রের জন্ম হয় । পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মা ভগবতী দেবীর সংসার ছিল দরিদ্র কিন্তু মা ভগবতী ছিলেন করুণার প্রতিমূর্তি । শিশু ঈশ্বরচন্দ্র দারিদ্র্যকে সঙ্গী করেই বড় হয়ে ওঠেন । গ্রামে কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের পাঠশালায় প্রাথমিক পাঠ শেষ করে মাত্র ৮ বছর বয়সে বাবার হাত ধরে পড়াশুনা করতে কোলকাতায় চলে আসেন । ভর্তি হন সংস্কৃত কলেজে । অসাধারণ মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি । এই মেধার স্বীকৃতি হিসেবে ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে 'বিদ্যাসাগর' উপাধি দেয়া হয় । সংস্কৃত ছাড়াও ইংরেজি শিক্ষাতেও তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী ।

কর্মজীবন :- কর্মই মানুষের শ্রেষ্ঠ পরিচিতি । কর্মজীবনের শুরুতে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে প্রধান পণ্ডিতের পদ অলংকৃত করেন । সেখানে বিলেত থেকে আগত সিভিলিয়ানদের বাংলা শিক্ষা দিতেন । পরে তিনি সংস্কৃত কলেজে সহকারী সম্পাদক পদে যোগদান করেন । এরপর অধ্যক্ষের পদেও আসীন হন । তিনি স্কুল পরিদর্শকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন । শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকাকালীন তিনি অনুভব করেছিলেন প্রথাগত শিক্ষার বদলে আধুনিক শিক্ষাই হল যথাযথ শিক্ষা । শিক্ষাক্ষেত্রে যে সকল সংস্কার করেছিলেন সেগুলি হল- পাঠক্রম সংস্কার, গণিতে ইংরেজির ব্যবহার, দর্শনে পাশ্চাত্য লজিকের প্রবর্তন, মাহিনা প্রবর্তন, বিরতি দিবসের পরিবর্তন প্রভৃতি । তিনি স্কুল বিভাগের সর্বস্তরের জন্য নতুন করে বাংলা ভাষায় পাঠ্যবই লিখলেন - বর্ণপরিচয়, কথামালা, বোধোদয়, শকুন্তলা, সীতার বনবাস, ঋজুপাঠ প্রভৃতি পুস্তক । বাংলা গদ্য সাহিত্যের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে তাঁর হাত ধরেই । পদ্যের মতো গদ্যেও তিনি যতি চিহ্ন ব্যবহার করে গদ্য সাহিত্যকে ছন্দবদ্ধ করেছেন ।

সমাজ সংস্কারক বিদ্যাসাগর :-  বিদ্যাসাগর শুধুমাত্র একজন শিক্ষাসংস্কারক নন, তিনি একজন প্রকৃত মানবপ্রেমিক ছিলেন । রাজা রামমোহন রায় যেমন 'সতীদাহ প্রথা' বন্ধ করতে চেয়েছিলেন, বিদ্যাসাগরও চেয়েছিলেন বাল্যবিবাহ ও কৌলিন্য প্রথা বন্ধ করে দিতে এবং বিধবা বিবাহ চালু করতে । বহু শাস্ত্র অধ্যয়ন করে তিনি বিধবা বিবাহ চালু করার জন্য শাস্ত্রীয় সমর্থন খুঁজে পেয়েছিলেন । রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের শত বাধা অতিক্রম করে তিনি বড়লাটের সহায়তায় ১৮৫৬ সালে ২৮শে জুলাই 'বিধবা বিবাহ আইন' পাস করালেন ও প্রবর্তন করলেন । মেয়েদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করাও ছিল তাঁর একটা ব্রত । আজকে মেয়েরা শিক্ষার অধিকার পেয়েছে । এর পিছনে যে মানুষটির সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ছিল, তিনি হলেন ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর । দুস্থ মানুষ, অসহায় মানুষ, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার তিনি ছিলেন অনাহুত বন্ধু । এ বিষয়ে মাইকেল মধুসূদন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলেছেন —

          "বিদ্যার সাগর তুমি, বিখ্যাত ভারতে ।

               করুণার সিন্ধু তুমি, সেইজনে জানে,

                   দীন যে দীনের বন্ধু ।"

অজেয় পুরুষ:-  ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন "দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রের প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষত্ব ।" তাঁর অজেয় পৌরুষের জন্য তিনি একান্ত নির্ভীক, বড়ো বড়ো রাজা মহারাজা থেকে হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ কারসাহেব পর্যন্ত সকলেই তালতলার চটির কাছে অবনত । তিনি ছিলেন সকল সংকীর্ণতার উর্ধ্বে । কোন ক্ষুদ্রতা, নীচতা, নিষ্ফল আড়ম্বর তাঁর মনুষত্বকে কখনো খর্ব করতে পারে নি । তাই দুশো বছর অতিক্রান্ত হয়েও তিনি আজ সমান ভাবে অম্লান, অমর হয়ে আছেন বাঙালী জাতির হৃদয়ে ও মননে ।

উপসংহার :- মানবজীবন চিরস্থায়ী নয় । "জন্মিলে মরিতে হবে । অমর কে কোথা কবে ?" জন্ম ও মৃত্যু অমোঘ সত্য । কিন্তু দৈহিক মৃত্যুতে সব কিছু শেষ হয়ে যায় না । কর্মই মানুষকে অমর ও চিরস্থায়ী করে রাখে । ১৮৯১ সালের ২৯শে জুলাই শ্রাবণের এক সন্ধ্যায় পৃথিবীকে শোক সাগরে ভাসিয়ে ঋষিতুল্য এই মহামানব চলে গেলেন অমৃতলোকের পথে । মানুষের জন্য রেখে গেলেন চলার পথের দিশা ও মানবতা । তার চারিত্রিক দৃঢ়তা, কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় আর মানবদরদী হৃদয় প্রত্যেক মানুষকে অনুপ্রাণিত করে নির্দিষ্ট পথে চলতে ।

******

Comments

Related Items

বাংলার উৎসব

উৎসব হল মানবজীবনের একটি অপরিহার্য অঙ্গ । মানুষ শুধু খেয়ে-পরে বেঁচেই সন্তুষ্ট থাকে না । সে অনেকের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দিতে চায় । মানুষ দৈনন্দিন জীবনের গতানুগতিক একঘেয়েমির জীবন থেকে মুক্তি চায় । শ্রমক্লান্ত জীবনে পেতে চায় সহজ অনাবিল আনন্দ । আর তাই মানুষ উৎসবে মেতে ওঠে ।

মিড ডে মিল (Mid-Day-Meal)

শিশুদের শিক্ষার অধিকার সবচেয়ে বড় অধিকার । দারিদ্র্য পীড়িত ভারতে বেশির ভাগ শিশু এই অধিকার থেকে বঞ্চিত । পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য বেশির ভাগ শিশু, শিশুশ্রমিকে পরিণত হয় । শিশুদের শৈশবকে সুরক্ষিত করার জন্য ভারত সরকার এক জনমুখি প্রকল্প গ্রহণ করেন । এই প্রকল্পের নাম মিড-ডে-মিল ।

বিজ্ঞানের জয়যাত্রা

মানব সভ্যতার বিজয়রথের চালক হল বিজ্ঞান । সমগ্র মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে বিজ্ঞানের অবদান অপরিসীম । মানব সভ্যতার হাহক হল বিজ্ঞান । গুহাবাসী মানুষ যেদিন আগুন জ্বালাতে শিখল, যেদিন নগ্ন গায়ে গাছের ছালকে পরিধেয় হিসাবে ব্যবহার করতে শিখল, সেদিন থেকেই শুরু হল বিজ্ঞানের জয়যাত্রা ।

মানব জীবনে মেলার প্রয়োজনীয়তা

'মেলা' কথাটির মধ্যে আছে মিলনের ইঙ্গিত । জাতি ধর্ম নির্বিশেষে আমরা গিয়ে এক জায়গায় মিলিত হই । সম্মিলিত মানুষের সমাবেশেকেই মেলা বলে । প্রত্যেক মেলার একটা উপলক্ষ থাকে ঠিকই, কিন্তু একসময় সেটা একেবারেই গৌণ হয়ে যায় । লক্ষ্য হয়ে ওঠে পরস্পরের মধ্যে মিলেমিশে কিছু দেওয়া-নেওয়া বা আদান-প্রদান । মেলা হল মিলনের ক্ষেত্রে । মিলনের মধ্যে মানুষ নিজেকে খুঁজে পায় ।

মোবাইল ফোন ব্যবহারের সুফল ও কুফল/ভালোমন্দ

ভূমিকা:— আধুনিক প্রযুক্তি বিদ্যার নবতম আবিষ্কার হল ইন্টারনেট, ই-মেল ও মোবাইল ফোন । যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম হাতিয়ার হল মোবাইল ফোন । আজকের দিনে কোনো আত্মীয় পরিজন, বন্ধু-বান্ধব বা অন্য কাউকে চিঠি লিখি তার উত্তরের প্রতীক্ষায় ডাক-পিয়নের পথ চেয়ে বসে থাকতে হয় না ।