সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতা (The Indus Valley Civilisation)

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 04/17/2012 - 10:19

সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতা (The Indus Valley Civilization or the Harappan Civilization) :

আবিষ্কার : ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে বাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাম্র-প্রস্তর যুগের সভ্যতার সবচেয়ে উন্নত নিদর্শন আবিষ্কার করেন । তিনি জন মার্শালের তত্ত্বাবধানে সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় মহেন-জো-দরোতে মাটি খুঁড়ে ভারতীয় সভ্যতার উন্মেষকে কয়েক হাজার বছর পিছিয়ে দেন । প্রায় একই সময়ে দয়ারাম সাহানি পাঞ্জাবের মন্টগোমারি জেলার হরপ্পায় এই সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কার করেন । পরবর্তীকালে মার্টিমার হুইলার, রফিক মুঘল, ম্যাকে, রেইকস্‌, দিলীপকুমার চক্রবর্তী প্রভৃতি সিন্ধু সভ্যতার ওপর ব্যাপক গবেষণা চালান । বর্তমানে মহেন-জো-দরো, কালিবঙ্গান, কোটডিজি, বনোয়ালি, লোথাল, ধোলিবিরা প্রভৃতি নানা স্থানে এই সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে । সিন্ধু সভ্যতার অসংখ্য কেন্দ্র আবিষ্কৃত হলেও শহর বলতে অবশ্য মাত্র পাঁচ-ছয়টি বোঝায় । কিন্তু কোনো লিখিত সাহিত্যিক উপাদান পাওয়া যায়নি বলে এর রাজনৈতিক ইতিহাস কিছুই জানা যায় না । সিন্ধুলিপির পাঠোদ্ধার আজও সম্ভব হয়নি বলে এর ধ্বংসাবশেষ থেকেই এর পরিচয় পাওয়া যায় । সিন্ধু জনগণ পাথর ও তামা উভয়েরই ব্যবহার জানত । এই সভ্যতা কারা নির্মাণ করেছিল তা আজও রহস্যাবৃত । সম্ভবত ভারতীয়রাই এই সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল । এই প্রাচীন সভ্যতার সময়সীমা সম্ভবত খ্রিস্টপূব ২৫০০ অব্দ থেকে ১৫০০ অব্দ পর্যন্ত (পরিণত পর্য়ায়) স্থায়ী ছিল ।

সিন্ধু সভ্যতার বৈশিষ্ঠ্য (The main features of the Harappan Civilisation) :

(১) নাগরিক চরিত্র ও নগর পরিকল্পনা (Urban Culture and Town-Planning) : সিন্ধু সভ্যতা নগরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল । এই সভ্যতার প্রধান বৈশিষ্ঠ্য ছিল উন্নত মানের নগর পরিকল্পনা ও গৃহনির্মাণশৈলী । নগরগুলির মধ্যে হরপ্পা ও মহেন-জো-দরো উল্লেখযোগ্য । নগরগুলির পরিকল্পনা ছিল প্রায় একই ধরনের । নগরগুলি দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল— দূর্গ ও সাধারণ মানুষের জন্য নীচের শহরাঞ্চল । দূর্গগুলি ইটের তৈরি, উঁচু চাতালের উপর অবস্থিত এবং মূল শহর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল । ফলে শহরে বন্যা হলেও দূর্গে জল ঢুকত না । শাসকশ্রেণি এখানেই বাস করত । মহেন-জো-দরোতে একটি বিশাল স্নানাগার আবিষ্কৃত হয়েছে । এটি উত্তর-দক্ষিণে ১১.৮৯ মি., পূর্ব-পশ্চিমে ৭.০১ মি. এবং গভীরতা ২.৪৪ মি. । জলাশয়ের তিন দিকে খোলা বারান্দা । তারপর ঘর । জলাশয়টিতে জল ভর্তির জন্য একটি ঘরে ইট দিয়ে বাঁধানো কূপ ছিল । পৃথিবীর আর কোথাও এত বড়ো স্নানাগার আবিষ্কৃত হয়নি । আর একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হল ৪৫.৭২ × ২২.৮৬ মি. জায়গা জুড়ে এক শস্যাগার ।

শহরে নগর পরিকল্পনা ছিল অত্যন্ত উন্নতমানের । শহরের রাস্তাগুলি উত্তর-দক্ষিণে এবং পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত ছিল । রাস্তাগুলি প্রায় সোজা ও দশ মিটার চওড়া । ছোট ছোট সরু গলিপথ এইসব রাস্তায় এসে মিশত । রাস্তার দু-ধারে ছিল বড়ো বড়ো তিনতলা পর্যন্ত বাড়ি । আগুনে পোড়া ইট দিয়ে বাড়িগুলি তৈরি হত । সিন্ধুবাসী কাঠের তৈরি দরজা ব্যবহার করত । কিন্তু জানালার কোনো ব্যবস্থা ছিল না । দেওয়ালের ওপরে ছিদ্র দিয়ে আলো-বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা ছিল । প্রত্যেক বাড়িতে রান্নাঘর ও উঠনের জন্য স্থান সংরক্ষিত ছিল । শহরের গরিব ও খেটে-খাওয়া মানুষ ছোটো ছোটো অস্বাস্থ্যকর কুঁড়েঘরে বাস করত । এইসব এলাকা ছিল বস্তিতুল্য । নগর পরিকল্পনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় শহরবাসীর মধ্যে ব্যপক ধনবৈষম্য ছিল । শহরে জল সরবরাহ ও নিকাশি ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত উন্নত মানের । প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই নিজস্ব কূপ ছিল । তা ছাড়া জনগণের ব্যবহারের জন্য রাস্তাতেও কূপ খনন করা হত । ময়লা জল বার করার জন্য প্রত্যেক বাড়িতেই নর্দমার ব্যাবস্থা ছিল এবং সেই জল রাস্তার বড়ো নর্দমায় পড়ত । রাস্তার ধারে গর্ত করে নর্দমা তৈরি করা হত এবং তা নিয়মিত পরিষ্কার করা হত । অধ্যাপক এ. এল.বাসামের মতে রোমান সভ্যতার আগে অন্য কোনো সভ্যতায় এত উন্নত মানের পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা ছিল না । গবেষক ডি. ডি. কোশাম্বি মনে করেন- উন্নত পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থাই হরপ্পাকে মেসোপটেমিয়ার সভ্যতা থেকে পৃথক করেছে । অধিকাংশ শহরের পরিকল্পনা প্রায় এক ধরনের হলেও লোথালের বৈশিষ্ঠ্য হল- এখানে একটি পোতাশ্রয় ছিল ।

(২) অর্থনৈতিক জীবন (Economic Life) :

(ক) কৃষি (Agriculture) : সিন্ধু সভ্যতা নগরকেন্দ্রিক হলেও অধিকাংশ মানুষ গ্রামে থাকত । কৃষিই ছিল প্রধান উপজীবিকা । গম, জব, সরিষা, তিল প্রভৃতি ছিল প্রধান শস্য । সিন্ধু জনগণ সম্ভবত ধানের চাষ করত না । তবে লোথালে ধানের নিদর্শন পাওয়া গেছে । সিন্ধুনদের বন্যার জল জমিকে উর্বর করত । জলসেচের ব্যাবস্থাও ছিল । অনেকের মতে, তারা লাঙলের ব্যবহার জানত না । এই ধারনা সত্য নয় । কালিবঙ্গানে লাঙল ব্যবহারের চিহ্ন পাওয়া গেছে ।

(খ) পশুপালন (Animal Husbandry) : কৃষিকার্যের পাশাপাশি সিন্ধুজনগণ পশুপালন করত । মেষ, গোরু, ছাগল, কুকুর ছিল প্রধান গৃহ পালিত পশু । তারা হাতিকেও পোষ মানাত; তবে ঘোড়ার ব্যবহার জানত কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ আছে । দিলীপকুমার চক্রবর্তী মনে করেন ঘোড়াও গৃহ পালিত জন্তু ছিল । গাধা ও উট ছিল ভারবাহী পশু ।

(গ) ব্যবসাবাণিজ্য (Trade and Commerce) : অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য ছিল তাদের উপজীবিকা । মাল পরিবহণের জন্য দু-চাকার গাড়ির ব্যবস্থা ছিল । স্থল ও জল উভয় পথেই ব্যবসা চলত । লোথালে একটি পোতাশ্রয় ছিল । হরপ্পার সঙ্গে মেসোপটেমিয়ার ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিল । জলপথে নৌকা ব্যবহার করা হত । তামা, ময়ূর, হাতির দাঁত, চিরুনি, বস্ত্র প্রভৃতি ছিল প্রধান রপ্তানি দ্রব্য । আমদানি হত রুপো ও অন্যান্য ধাতু । সিলমোহর গুলি সম্ভবত বাণিজ্যের কাজে ব্যবহৃত হত । তবে সিন্ধু জনগণ মুদ্রার ব্যবহার জানত না । সম্ভবত বিনিময় প্রথার মাধ্যমে কেনাবেচা হত ।

(ঘ) কারিগরি শিল্প (Handicraft) : শহরের জনগণের একটা বড় অংশ ছিল শিল্পী ও কারিগর । বস্ত্রবয়ন শিল্প ছিল খুবই উন্নত । তাছাড়া অনেক মানুষ মৃৎশিল্প, ধাতুশিল্প ও অলঙ্কার শিল্পেও নিযুক্ত ছিল । সোনা ও রুপো উভয় প্রকারের অলংকারেরই প্রচলন ছিল । গুজরাট ও রাজপুতানা থেকে দামি পাথর আনা হত এবং এগুলি অলঙ্কার নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত হত । তাছাড়া কাস্তে, কুঠার, বর্শা, ছুঁচ, ইত্যাদিও তৈরি হত । এই সব দ্রব্য তৈরি করতে তামা ও ব্রোঞ্জ ব্যবহৃত হত । লোহার ব্যবহার সিন্ধু জনগণ জানত না । তবে সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্বে লোথালে লোহার ব্যবহারের কিছু নিদর্শন পাওয়া গেছে । কিন্তু লোহার ব্যাপক প্রচলন ছিল না ।

(৩) সামাজিক জীবন (Social Life) : সিন্ধু সমাজে ধনবৈষম্য ও শ্রেণিবৈষম্য প্রকট ছিল । সিন্ধু সমাজ বিভিন্ন গোষ্টীতে বিভক্ত ছিল, যথা— পুরোহিত সম্প্রদায়, বণিক, কৃষক, দক্ষকারিগর এবং শ্রমিক । সিন্ধু জনগণের জীবনযাত্রার মান খুব উন্নত ছিল । তাদের প্রধান খাদ্য ছিল গম, যব, তরি-তরকারি ও খেজুর । তা-ছাড়া তাদের খাদ্য তালিকায় মাছ, মাংস ও ডিম অন্তর্ভুক্ত ছিল । সুতিবস্ত্র ছিল তাদের প্রধান পোশাক । শীতের দিনে তারা পশমের পোশাক পরত । নারী-পুরুষ উভয়েই অলংকার পরত । সিন্ধু জনগণ যেসব জিনিস ব্যবহার করত, তার মধ্যে মাটির তৈরি নানা বাসন, যেমন— থালা, জালা, কলসি, বাটি ইত্যাদি প্রধান । কখনো-কখনো এইসব মাটির পাত্রে নানারকম আলপনা আঁকা থাকত । এ ছাড়া তামা, রুপো, ব্রোঞ্জ ও চিনামাটির তৈরি জিনিসপত্রও পাওয়া গেছে । ছুরি, হাতির দাঁত অথবা হাড়ের তৈরি চিরুনি, কাস্তে, কুড়ুল, চারচৌকো পাথর (ওজনের মাপ) ইত্যাদিও ব্যবহৃত হত । সিন্ধু জনগণ লেখাপড়া জানত; যার প্রমান লিপি । সিন্ধু লিপির পাঠোদ্ধার অবশ্য আজও সম্ভব হয়নি । সিন্ধু জনগণ মৃত দেহ কবর দিত । তবে কখনও মৃতদেহের কঙ্কাল আবার কখনও মৃত দেহ দাহ করে তার ছাই কবর দেওয়া হত । কবরের মধ্যে মৃতের ব্যবহার্য জিনিসও দেওয়া হত ।

(৪) ধর্মীয় জীবন (Religious Life) : সিলমোহরে খোদিত মুর্তি থেকে সিন্ধু জনগণের ধর্মজীবনের আভাস পাওয়া যায় । সিন্ধুজনগণের মধ্যে মাতৃপূজার প্রচলন ছিল । তা ছাড়া যোগাসনে ধ্যানমগ্ন পশুপরিবেষ্টিত তিনমুখবিশিষ্ট একটি পুরুষ দেবমূর্তিও পাওয়া গেছে । এই মুর্তির সঙ্গে শিবের সাদৃশ্য আছে, তাই মার্টিমার হুইলার এই দেবতাকে শিবের পূর্ব সংস্করণ বলে মনে করেন । কয়েকটি শিব লিঙ্গের আবিষ্কার এই অনুমানকে জোরদার করেছে । মূর্তিপূজা ছাড়া শক্তির আরাধ্যরূপে পাথর, গাছ ও জীবজন্তুর পূজাও প্রচলিত ছিল । তবে কোথাও মন্দিরের কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি ।

সিন্ধু সভ্যতার সমস্যা (The Problem of the Harappan Civilisation) : সিন্ধু সভ্যতাকে কেন্দ্র করে চারটি সমস্যা আছে- (১) বিস্তৃতি,  (২) নির্মাতা,  (৩) সময়সীমা এবং  (৪) অবলুপ্তি ও ধ্বংসের কারণ । এর মধ্যে প্রথমটি ছাড়া বাকি সমস্যাগুলির সমাধান এখনও হয়নি । তিনটি প্রশ্নই অত্যন্ত বিতর্কিত ।

প্রথম প্রশ্নটি নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই, কারণ এ যাবত যেসব কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে তাদের অবস্থান থেকে সিন্ধু সভ্যতার সীমানা সম্পর্কে একটা ধারনা করা যায় । এর অর্থ অবশ্য এটা নয় যে, বর্তমান সীমারেখাই চূড়ান্ত । ভবিষ্যতে নতুন নতুন কেন্দ্র আবিষ্কৃত হলে এই সিমারেখা অবশ্যই পালটে যাবে ।

(১) সিন্ধু সভ্যতার বিস্তৃতি (The Extent of the Harappan Civilisation) : এ পর্যন্ত সিন্ধু সভ্যতার যত কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে তার ভিত্তিতে বলা যায় বর্তমান ভারত ও পাকিস্থানের এক বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল । পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, গুজরাট, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশের পশ্চিম অংশের কিছু অঞ্চল জুড়ে এই সভ্যতা বিস্তার লাভ করেছিল । এই সভ্যতা পশ্চিমে বালুচিস্তানের সুত্‌কাগেন্‌দর থেকে পূর্বে মিরাট জেলার আলমগির পর্যন্ত প্রায় ১৬০০ কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । উত্তরে সিমলা পাহাড়ের নীচে রূপার থেকে দক্ষিণে গুজরাটের ভোগাবর পর্যন্ত ১১০০ কিমি. এলাকা এই সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত ছিল । যেহেতু সিন্ধু নদের তীরবর্তী অঞ্চল ছাড়াও আরও বিস্তৃত এলাকা জুড়ে এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তাই সিন্ধু সভ্যতা নামটি বর্তমানে অনেকাংশে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে । তবুও সাধারণ ভাবে এই সভ্যতাকে এখনও আমরা সিন্ধু সভ্যতা বলেই অভিহিত করে থাকি ।

(২) সিন্ধু সভ্যতার নির্মাতা (Founder of the Harappan Civilisation) : সিন্ধু সভ্যতা ভারতীয় সভ্যতা, না বিদেশিরা, অর্থাৎ, মেসোপটেমিয়ার জনগণ এই সভ্যতার সৃষ্টিকর্তা, তা নিয়ে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে । অন্যদিকে এই সভ্যতা আর্যসৃষ্ট না অনার্যসৃষ্ট, অর্থাৎ, দ্রাবিড়দের তৈরি, তা নিয়েও বিস্তর বিতর্ক আছে । ফাদার হেরাস ও অন্যান্য পন্ডিত সিন্ধু সভ্যতার নির্মাতা হিসাবে দ্রাবিড়দের পক্ষে যেমন কয়েকটি জোরালো যুক্তি দিয়েছেন, তেমনই দ্রাবিড়দের দাবির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ঐতিহাসিক যে যুক্তি দিয়েছেন, তাও কম জোরালো নয় । এই অবস্থায় দ্রাবিড়দের দাবির পক্ষে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয় । তবে সিন্ধু সভ্যতার নির্মাতা হিসেবে আর্যদের দাবি খুবই দুর্বল বলে মনে হয় । সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে সুমেরীয় বা মেসোপটেমিয়া সভ্যতার বহু সাদৃশ্য আছে বলে অনেকে সুমেরীয়দের এই সভ্যতার সৃষ্টিকর্তা বলে মনে করেন । বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ মার্টিমার হুইলার উভয় সভ্যতার মধ্যে বহু বৈসাদৃশ্যের কথা উল্লেখ করে সুমেরীয়দের দাবি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন । তাঁর মতে, সিন্ধুগণ হয়তো সভ্যতার আদর্শ বা ধারণা সুমেরীয়দের কাছ থেকে ধার করেছিল । কিন্তু এই সভ্যতা আসলে ভারতীয়রাই তৈরি করেছিল । অধ্যাপক বাসামও হুইলারকেই সমর্থন করেছেন । বিষয়টি এখনও বিতর্ক স্তরে আছে । তাই এ সম্পর্কে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসা সম্ভবপর হয়নি । তবে এই সভ্যতা ভারতীয়রাই সৃষ্টি করেছিল বলে মনে হয় ।

(৩) সিন্ধু সভ্যতার সময়সীমা (Time Limit of the Harappan Civilisation) : সিন্ধু সভ্যতা কবে শুরু হয়েছিল এবং কবে তার ধ্বংস হয়েছিল, এ সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায় না । মার্শালের মতে, এই সভ্যতার স্থায়িত্বকাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩৭৫০ অব্দ থেকে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৭৫০ অব্দ । বর্তমানে মার্শালের এই মত অনেকেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন না । পিগো ও হুইলারের মতে, এই সভ্যতার পরিণত পর্যায়ের স্থায়িত্বকাল খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ । ডি.পি.অগ্রওয়াল, গ্যাড, অলব্রাইট প্রভৃতি পন্ডিতও মোটামুটি একই সিদ্ধান্তে এসেছে । ড. দিলীপকুমার চক্রবর্তী মনে করেন এই সভ্যতার সূত্রপাত খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি এবং শেষ দ্বিতীয় সহস্রাব্দের দ্বিতীয় ভাগে ।

(৪) সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ (Causes of Decline of the Harappan Civilisation) : সিন্ধু সভ্যতা কেন ও কীভাবে ধ্বংশ হয়েছিল তা আমাদের কাছে অজ্ঞাত । সম্ভবত সর্বত্র একই সঙ্গে বা একই কারণে পতন ঘটেনি ।

(১) কারও মতে, নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব মহেন-জো-দরো শহরের পতন ডেকে এনে ছিল ।

(২) অনেকের মতে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এই সভ্যতার পতনের জন্য দায়ী । প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত বৃষ্টি ও বন্যা । মার্শাল, ম্যাকে, রেইক্স, ডেল্‌স প্রভৃতিরা মনে করেন বন্যাই এই সভ্যতার পতনের কারণ ।

(৩) অনেকে আবার মনে করেন বন্যা নয়, অনাবৃষ্টির জন্যই এই সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায় । বৃষ্টিপাতের তারতম্য ও জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনের কারণ ব্যাপক বৃক্ষচ্ছেদন বলে অনেকে মনে করেন ।

(৪) রেইক্স সহ কেউ কেউ নদীর গতিপথের পরিবর্তনের মধ্যে পতনের কারণ অনুসন্ধান করেছেন । এর ফলে মরুভূমির মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল ।

(৫) কেউ কেউ মনে করেন ভূমিকম্প এই সভ্যতার পতন ডেকে এনে ছিল ।

(৬) অনেকের মতে, বিদেশি শত্রুর আগমন এই সভ্যতার অন্যতম প্রধান কারণ । বিদেশি শত্রু বলতে অনেকেই আর্যদের চিহ্নিত করেছেন । এই মতের প্রবক্তা গর্ডন চাইল্ড ও ড.হুইলার । বর্তমানে অবশ্য এই বিষয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন ।

*****

Related Items

ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের কারণ ও তার ফলাফল

ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার নানাবিধ কারণের মধ্যে একটি বড়ো কারণ ছিল পুঁজির জোগান । এই পুঁজির অনেকটাই এসেছিল ঔপনিবেশিক ব্যবসাবাণিজ্য থেকে । ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলে দুটি সমস্যা দেখা দেয় ...

ইউরোপীয় ধনতন্ত্র ও ঔপনিবেশিক অর্থনীতি

ভারত ইতিহাসে ইংরেজ শাসনের তাৎপর্য অনুধাবন করতে হলে ধনতন্ত্র ও ঔপনিবেশিক অর্থনীতি সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার । কারণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মানদণ্ড অচিরেই রাজদণ্ডে পরিণত হয়েছিল । আগে যেসব বহিরাগত জাতি ভারতে এসেছিল, তাদের সঙ্গে ...

দেওয়ানি লাভ ও দেওয়ানি লাভের গুরুত্ব

বক্সারের যুদ্ধে ত্রিশক্তির পরাজয়ের পর প্রায় সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে ইংরেজদের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য স্থাপনের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে । এই অবস্থায় ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দের মে মাসে বাংলায় ক্লাইভের পুনরাগমন ঘটে । ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের এলাহাবাদ চুক্তিতে ৫০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে কারা ও এলাহাবাদ ছাড়া ...

বক্সারের যুদ্ধ ও বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব

কাটোয়া, মুর্শিদাবাদ, গিরিয়া, সুটি, মুঙ্গের ও উদয়নালায় পরপর ছয়টি যুদ্ধে মিরকাশিম পরাজিত হন । এই অবস্থায় ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে মিরকাশিমকে সিংহাসনচ্যুত করে ইংরেজরা মিরজাফরকে আবার বাংলার মসনদে বসান । কিন্তু মিরকাশিম হাল না ছেড়ে মুঘল সম্রাট শাহ আলম ...

মির কাশিম (Mir Kasim)

কোম্পানির প্রাপ্য অর্থ পরিশোধ এবং বর্ধমান, মেদিনীপুর, চট্টোগ্রামের জমিদারি প্রদানের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে মিরকাশিম বাংলার মসনদ লাভ করেন । ইংরেজদের সাহায্যে বাংলার মসনদ দখল করলেও তিনি ব্যক্তিত্বহীন পুরুষ ছিলেন না, বরং বাস্তববাদী ছিলেন । অহেতুক ইংরেজ বিরোধিতা তাঁর ...