সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতা (The Indus Valley Civilisation)

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 04/17/2012 - 10:19

সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতা (The Indus Valley Civilization or the Harappan Civilization) :

আবিষ্কার : ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে বাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাম্র-প্রস্তর যুগের সভ্যতার সবচেয়ে উন্নত নিদর্শন আবিষ্কার করেন । তিনি জন মার্শালের তত্ত্বাবধানে সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় মহেন-জো-দরোতে মাটি খুঁড়ে ভারতীয় সভ্যতার উন্মেষকে কয়েক হাজার বছর পিছিয়ে দেন । প্রায় একই সময়ে দয়ারাম সাহানি পাঞ্জাবের মন্টগোমারি জেলার হরপ্পায় এই সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কার করেন । পরবর্তীকালে মার্টিমার হুইলার, রফিক মুঘল, ম্যাকে, রেইকস্‌, দিলীপকুমার চক্রবর্তী প্রভৃতি সিন্ধু সভ্যতার ওপর ব্যাপক গবেষণা চালান । বর্তমানে মহেন-জো-দরো, কালিবঙ্গান, কোটডিজি, বনোয়ালি, লোথাল, ধোলিবিরা প্রভৃতি নানা স্থানে এই সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে । সিন্ধু সভ্যতার অসংখ্য কেন্দ্র আবিষ্কৃত হলেও শহর বলতে অবশ্য মাত্র পাঁচ-ছয়টি বোঝায় । কিন্তু কোনো লিখিত সাহিত্যিক উপাদান পাওয়া যায়নি বলে এর রাজনৈতিক ইতিহাস কিছুই জানা যায় না । সিন্ধুলিপির পাঠোদ্ধার আজও সম্ভব হয়নি বলে এর ধ্বংসাবশেষ থেকেই এর পরিচয় পাওয়া যায় । সিন্ধু জনগণ পাথর ও তামা উভয়েরই ব্যবহার জানত । এই সভ্যতা কারা নির্মাণ করেছিল তা আজও রহস্যাবৃত । সম্ভবত ভারতীয়রাই এই সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল । এই প্রাচীন সভ্যতার সময়সীমা সম্ভবত খ্রিস্টপূব ২৫০০ অব্দ থেকে ১৫০০ অব্দ পর্যন্ত (পরিণত পর্য়ায়) স্থায়ী ছিল ।

সিন্ধু সভ্যতার বৈশিষ্ঠ্য (The main features of the Harappan Civilisation) :

(১) নাগরিক চরিত্র ও নগর পরিকল্পনা (Urban Culture and Town-Planning) : সিন্ধু সভ্যতা নগরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল । এই সভ্যতার প্রধান বৈশিষ্ঠ্য ছিল উন্নত মানের নগর পরিকল্পনা ও গৃহনির্মাণশৈলী । নগরগুলির মধ্যে হরপ্পা ও মহেন-জো-দরো উল্লেখযোগ্য । নগরগুলির পরিকল্পনা ছিল প্রায় একই ধরনের । নগরগুলি দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল— দূর্গ ও সাধারণ মানুষের জন্য নীচের শহরাঞ্চল । দূর্গগুলি ইটের তৈরি, উঁচু চাতালের উপর অবস্থিত এবং মূল শহর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল । ফলে শহরে বন্যা হলেও দূর্গে জল ঢুকত না । শাসকশ্রেণি এখানেই বাস করত । মহেন-জো-দরোতে একটি বিশাল স্নানাগার আবিষ্কৃত হয়েছে । এটি উত্তর-দক্ষিণে ১১.৮৯ মি., পূর্ব-পশ্চিমে ৭.০১ মি. এবং গভীরতা ২.৪৪ মি. । জলাশয়ের তিন দিকে খোলা বারান্দা । তারপর ঘর । জলাশয়টিতে জল ভর্তির জন্য একটি ঘরে ইট দিয়ে বাঁধানো কূপ ছিল । পৃথিবীর আর কোথাও এত বড়ো স্নানাগার আবিষ্কৃত হয়নি । আর একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হল ৪৫.৭২ × ২২.৮৬ মি. জায়গা জুড়ে এক শস্যাগার ।

শহরে নগর পরিকল্পনা ছিল অত্যন্ত উন্নতমানের । শহরের রাস্তাগুলি উত্তর-দক্ষিণে এবং পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত ছিল । রাস্তাগুলি প্রায় সোজা ও দশ মিটার চওড়া । ছোট ছোট সরু গলিপথ এইসব রাস্তায় এসে মিশত । রাস্তার দু-ধারে ছিল বড়ো বড়ো তিনতলা পর্যন্ত বাড়ি । আগুনে পোড়া ইট দিয়ে বাড়িগুলি তৈরি হত । সিন্ধুবাসী কাঠের তৈরি দরজা ব্যবহার করত । কিন্তু জানালার কোনো ব্যবস্থা ছিল না । দেওয়ালের ওপরে ছিদ্র দিয়ে আলো-বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা ছিল । প্রত্যেক বাড়িতে রান্নাঘর ও উঠনের জন্য স্থান সংরক্ষিত ছিল । শহরের গরিব ও খেটে-খাওয়া মানুষ ছোটো ছোটো অস্বাস্থ্যকর কুঁড়েঘরে বাস করত । এইসব এলাকা ছিল বস্তিতুল্য । নগর পরিকল্পনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় শহরবাসীর মধ্যে ব্যপক ধনবৈষম্য ছিল । শহরে জল সরবরাহ ও নিকাশি ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত উন্নত মানের । প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই নিজস্ব কূপ ছিল । তা ছাড়া জনগণের ব্যবহারের জন্য রাস্তাতেও কূপ খনন করা হত । ময়লা জল বার করার জন্য প্রত্যেক বাড়িতেই নর্দমার ব্যাবস্থা ছিল এবং সেই জল রাস্তার বড়ো নর্দমায় পড়ত । রাস্তার ধারে গর্ত করে নর্দমা তৈরি করা হত এবং তা নিয়মিত পরিষ্কার করা হত । অধ্যাপক এ. এল.বাসামের মতে রোমান সভ্যতার আগে অন্য কোনো সভ্যতায় এত উন্নত মানের পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা ছিল না । গবেষক ডি. ডি. কোশাম্বি মনে করেন- উন্নত পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থাই হরপ্পাকে মেসোপটেমিয়ার সভ্যতা থেকে পৃথক করেছে । অধিকাংশ শহরের পরিকল্পনা প্রায় এক ধরনের হলেও লোথালের বৈশিষ্ঠ্য হল- এখানে একটি পোতাশ্রয় ছিল ।

(২) অর্থনৈতিক জীবন (Economic Life) :

(ক) কৃষি (Agriculture) : সিন্ধু সভ্যতা নগরকেন্দ্রিক হলেও অধিকাংশ মানুষ গ্রামে থাকত । কৃষিই ছিল প্রধান উপজীবিকা । গম, জব, সরিষা, তিল প্রভৃতি ছিল প্রধান শস্য । সিন্ধু জনগণ সম্ভবত ধানের চাষ করত না । তবে লোথালে ধানের নিদর্শন পাওয়া গেছে । সিন্ধুনদের বন্যার জল জমিকে উর্বর করত । জলসেচের ব্যাবস্থাও ছিল । অনেকের মতে, তারা লাঙলের ব্যবহার জানত না । এই ধারনা সত্য নয় । কালিবঙ্গানে লাঙল ব্যবহারের চিহ্ন পাওয়া গেছে ।

(খ) পশুপালন (Animal Husbandry) : কৃষিকার্যের পাশাপাশি সিন্ধুজনগণ পশুপালন করত । মেষ, গোরু, ছাগল, কুকুর ছিল প্রধান গৃহ পালিত পশু । তারা হাতিকেও পোষ মানাত; তবে ঘোড়ার ব্যবহার জানত কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ আছে । দিলীপকুমার চক্রবর্তী মনে করেন ঘোড়াও গৃহ পালিত জন্তু ছিল । গাধা ও উট ছিল ভারবাহী পশু ।

(গ) ব্যবসাবাণিজ্য (Trade and Commerce) : অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য ছিল তাদের উপজীবিকা । মাল পরিবহণের জন্য দু-চাকার গাড়ির ব্যবস্থা ছিল । স্থল ও জল উভয় পথেই ব্যবসা চলত । লোথালে একটি পোতাশ্রয় ছিল । হরপ্পার সঙ্গে মেসোপটেমিয়ার ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিল । জলপথে নৌকা ব্যবহার করা হত । তামা, ময়ূর, হাতির দাঁত, চিরুনি, বস্ত্র প্রভৃতি ছিল প্রধান রপ্তানি দ্রব্য । আমদানি হত রুপো ও অন্যান্য ধাতু । সিলমোহর গুলি সম্ভবত বাণিজ্যের কাজে ব্যবহৃত হত । তবে সিন্ধু জনগণ মুদ্রার ব্যবহার জানত না । সম্ভবত বিনিময় প্রথার মাধ্যমে কেনাবেচা হত ।

(ঘ) কারিগরি শিল্প (Handicraft) : শহরের জনগণের একটা বড় অংশ ছিল শিল্পী ও কারিগর । বস্ত্রবয়ন শিল্প ছিল খুবই উন্নত । তাছাড়া অনেক মানুষ মৃৎশিল্প, ধাতুশিল্প ও অলঙ্কার শিল্পেও নিযুক্ত ছিল । সোনা ও রুপো উভয় প্রকারের অলংকারেরই প্রচলন ছিল । গুজরাট ও রাজপুতানা থেকে দামি পাথর আনা হত এবং এগুলি অলঙ্কার নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত হত । তাছাড়া কাস্তে, কুঠার, বর্শা, ছুঁচ, ইত্যাদিও তৈরি হত । এই সব দ্রব্য তৈরি করতে তামা ও ব্রোঞ্জ ব্যবহৃত হত । লোহার ব্যবহার সিন্ধু জনগণ জানত না । তবে সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্বে লোথালে লোহার ব্যবহারের কিছু নিদর্শন পাওয়া গেছে । কিন্তু লোহার ব্যাপক প্রচলন ছিল না ।

(৩) সামাজিক জীবন (Social Life) : সিন্ধু সমাজে ধনবৈষম্য ও শ্রেণিবৈষম্য প্রকট ছিল । সিন্ধু সমাজ বিভিন্ন গোষ্টীতে বিভক্ত ছিল, যথা— পুরোহিত সম্প্রদায়, বণিক, কৃষক, দক্ষকারিগর এবং শ্রমিক । সিন্ধু জনগণের জীবনযাত্রার মান খুব উন্নত ছিল । তাদের প্রধান খাদ্য ছিল গম, যব, তরি-তরকারি ও খেজুর । তা-ছাড়া তাদের খাদ্য তালিকায় মাছ, মাংস ও ডিম অন্তর্ভুক্ত ছিল । সুতিবস্ত্র ছিল তাদের প্রধান পোশাক । শীতের দিনে তারা পশমের পোশাক পরত । নারী-পুরুষ উভয়েই অলংকার পরত । সিন্ধু জনগণ যেসব জিনিস ব্যবহার করত, তার মধ্যে মাটির তৈরি নানা বাসন, যেমন— থালা, জালা, কলসি, বাটি ইত্যাদি প্রধান । কখনো-কখনো এইসব মাটির পাত্রে নানারকম আলপনা আঁকা থাকত । এ ছাড়া তামা, রুপো, ব্রোঞ্জ ও চিনামাটির তৈরি জিনিসপত্রও পাওয়া গেছে । ছুরি, হাতির দাঁত অথবা হাড়ের তৈরি চিরুনি, কাস্তে, কুড়ুল, চারচৌকো পাথর (ওজনের মাপ) ইত্যাদিও ব্যবহৃত হত । সিন্ধু জনগণ লেখাপড়া জানত; যার প্রমান লিপি । সিন্ধু লিপির পাঠোদ্ধার অবশ্য আজও সম্ভব হয়নি । সিন্ধু জনগণ মৃত দেহ কবর দিত । তবে কখনও মৃতদেহের কঙ্কাল আবার কখনও মৃত দেহ দাহ করে তার ছাই কবর দেওয়া হত । কবরের মধ্যে মৃতের ব্যবহার্য জিনিসও দেওয়া হত ।

(৪) ধর্মীয় জীবন (Religious Life) : সিলমোহরে খোদিত মুর্তি থেকে সিন্ধু জনগণের ধর্মজীবনের আভাস পাওয়া যায় । সিন্ধুজনগণের মধ্যে মাতৃপূজার প্রচলন ছিল । তা ছাড়া যোগাসনে ধ্যানমগ্ন পশুপরিবেষ্টিত তিনমুখবিশিষ্ট একটি পুরুষ দেবমূর্তিও পাওয়া গেছে । এই মুর্তির সঙ্গে শিবের সাদৃশ্য আছে, তাই মার্টিমার হুইলার এই দেবতাকে শিবের পূর্ব সংস্করণ বলে মনে করেন । কয়েকটি শিব লিঙ্গের আবিষ্কার এই অনুমানকে জোরদার করেছে । মূর্তিপূজা ছাড়া শক্তির আরাধ্যরূপে পাথর, গাছ ও জীবজন্তুর পূজাও প্রচলিত ছিল । তবে কোথাও মন্দিরের কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি ।

সিন্ধু সভ্যতার সমস্যা (The Problem of the Harappan Civilisation) : সিন্ধু সভ্যতাকে কেন্দ্র করে চারটি সমস্যা আছে- (১) বিস্তৃতি,  (২) নির্মাতা,  (৩) সময়সীমা এবং  (৪) অবলুপ্তি ও ধ্বংসের কারণ । এর মধ্যে প্রথমটি ছাড়া বাকি সমস্যাগুলির সমাধান এখনও হয়নি । তিনটি প্রশ্নই অত্যন্ত বিতর্কিত ।

প্রথম প্রশ্নটি নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই, কারণ এ যাবত যেসব কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে তাদের অবস্থান থেকে সিন্ধু সভ্যতার সীমানা সম্পর্কে একটা ধারনা করা যায় । এর অর্থ অবশ্য এটা নয় যে, বর্তমান সীমারেখাই চূড়ান্ত । ভবিষ্যতে নতুন নতুন কেন্দ্র আবিষ্কৃত হলে এই সিমারেখা অবশ্যই পালটে যাবে ।

(১) সিন্ধু সভ্যতার বিস্তৃতি (The Extent of the Harappan Civilisation) : এ পর্যন্ত সিন্ধু সভ্যতার যত কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে তার ভিত্তিতে বলা যায় বর্তমান ভারত ও পাকিস্থানের এক বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল । পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, গুজরাট, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশের পশ্চিম অংশের কিছু অঞ্চল জুড়ে এই সভ্যতা বিস্তার লাভ করেছিল । এই সভ্যতা পশ্চিমে বালুচিস্তানের সুত্‌কাগেন্‌দর থেকে পূর্বে মিরাট জেলার আলমগির পর্যন্ত প্রায় ১৬০০ কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । উত্তরে সিমলা পাহাড়ের নীচে রূপার থেকে দক্ষিণে গুজরাটের ভোগাবর পর্যন্ত ১১০০ কিমি. এলাকা এই সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত ছিল । যেহেতু সিন্ধু নদের তীরবর্তী অঞ্চল ছাড়াও আরও বিস্তৃত এলাকা জুড়ে এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তাই সিন্ধু সভ্যতা নামটি বর্তমানে অনেকাংশে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে । তবুও সাধারণ ভাবে এই সভ্যতাকে এখনও আমরা সিন্ধু সভ্যতা বলেই অভিহিত করে থাকি ।

(২) সিন্ধু সভ্যতার নির্মাতা (Founder of the Harappan Civilisation) : সিন্ধু সভ্যতা ভারতীয় সভ্যতা, না বিদেশিরা, অর্থাৎ, মেসোপটেমিয়ার জনগণ এই সভ্যতার সৃষ্টিকর্তা, তা নিয়ে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে । অন্যদিকে এই সভ্যতা আর্যসৃষ্ট না অনার্যসৃষ্ট, অর্থাৎ, দ্রাবিড়দের তৈরি, তা নিয়েও বিস্তর বিতর্ক আছে । ফাদার হেরাস ও অন্যান্য পন্ডিত সিন্ধু সভ্যতার নির্মাতা হিসাবে দ্রাবিড়দের পক্ষে যেমন কয়েকটি জোরালো যুক্তি দিয়েছেন, তেমনই দ্রাবিড়দের দাবির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ঐতিহাসিক যে যুক্তি দিয়েছেন, তাও কম জোরালো নয় । এই অবস্থায় দ্রাবিড়দের দাবির পক্ষে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয় । তবে সিন্ধু সভ্যতার নির্মাতা হিসেবে আর্যদের দাবি খুবই দুর্বল বলে মনে হয় । সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে সুমেরীয় বা মেসোপটেমিয়া সভ্যতার বহু সাদৃশ্য আছে বলে অনেকে সুমেরীয়দের এই সভ্যতার সৃষ্টিকর্তা বলে মনে করেন । বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ মার্টিমার হুইলার উভয় সভ্যতার মধ্যে বহু বৈসাদৃশ্যের কথা উল্লেখ করে সুমেরীয়দের দাবি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন । তাঁর মতে, সিন্ধুগণ হয়তো সভ্যতার আদর্শ বা ধারণা সুমেরীয়দের কাছ থেকে ধার করেছিল । কিন্তু এই সভ্যতা আসলে ভারতীয়রাই তৈরি করেছিল । অধ্যাপক বাসামও হুইলারকেই সমর্থন করেছেন । বিষয়টি এখনও বিতর্ক স্তরে আছে । তাই এ সম্পর্কে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসা সম্ভবপর হয়নি । তবে এই সভ্যতা ভারতীয়রাই সৃষ্টি করেছিল বলে মনে হয় ।

(৩) সিন্ধু সভ্যতার সময়সীমা (Time Limit of the Harappan Civilisation) : সিন্ধু সভ্যতা কবে শুরু হয়েছিল এবং কবে তার ধ্বংস হয়েছিল, এ সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায় না । মার্শালের মতে, এই সভ্যতার স্থায়িত্বকাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩৭৫০ অব্দ থেকে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৭৫০ অব্দ । বর্তমানে মার্শালের এই মত অনেকেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন না । পিগো ও হুইলারের মতে, এই সভ্যতার পরিণত পর্যায়ের স্থায়িত্বকাল খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ । ডি.পি.অগ্রওয়াল, গ্যাড, অলব্রাইট প্রভৃতি পন্ডিতও মোটামুটি একই সিদ্ধান্তে এসেছে । ড. দিলীপকুমার চক্রবর্তী মনে করেন এই সভ্যতার সূত্রপাত খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি এবং শেষ দ্বিতীয় সহস্রাব্দের দ্বিতীয় ভাগে ।

(৪) সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ (Causes of Decline of the Harappan Civilisation) : সিন্ধু সভ্যতা কেন ও কীভাবে ধ্বংশ হয়েছিল তা আমাদের কাছে অজ্ঞাত । সম্ভবত সর্বত্র একই সঙ্গে বা একই কারণে পতন ঘটেনি ।

(১) কারও মতে, নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব মহেন-জো-দরো শহরের পতন ডেকে এনে ছিল ।

(২) অনেকের মতে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এই সভ্যতার পতনের জন্য দায়ী । প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত বৃষ্টি ও বন্যা । মার্শাল, ম্যাকে, রেইক্স, ডেল্‌স প্রভৃতিরা মনে করেন বন্যাই এই সভ্যতার পতনের কারণ ।

(৩) অনেকে আবার মনে করেন বন্যা নয়, অনাবৃষ্টির জন্যই এই সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায় । বৃষ্টিপাতের তারতম্য ও জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনের কারণ ব্যাপক বৃক্ষচ্ছেদন বলে অনেকে মনে করেন ।

(৪) রেইক্স সহ কেউ কেউ নদীর গতিপথের পরিবর্তনের মধ্যে পতনের কারণ অনুসন্ধান করেছেন । এর ফলে মরুভূমির মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল ।

(৫) কেউ কেউ মনে করেন ভূমিকম্প এই সভ্যতার পতন ডেকে এনে ছিল ।

(৬) অনেকের মতে, বিদেশি শত্রুর আগমন এই সভ্যতার অন্যতম প্রধান কারণ । বিদেশি শত্রু বলতে অনেকেই আর্যদের চিহ্নিত করেছেন । এই মতের প্রবক্তা গর্ডন চাইল্ড ও ড.হুইলার । বর্তমানে অবশ্য এই বিষয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন ।

*****

Related Items

মিরজাফর (Mir Jafar)

চক্রান্ত, শঠতা ও বিশ্বাসঘাতকতার পথ ধরে বাংলার মসনদ দখল করলেও মিরজাফর গোড়া থেকেই তাঁর অসহায় এবং অক্ষম অবস্থার কথা বুঝতে পেরেছিলেন । আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সমস্যার চাপে তিনি ইংরেজদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন । তাঁর বিরুদ্ধে যে সব বিদ্রোহ হয়েছিল ...

নবাব সিরাজের সাফল্য ও ব্যর্থতা এবং পলাশির যুদ্ধের গুরুত্ব

প্রথমদিকে সিরাজ-উদ-দৌলার সাফল্য ছিল আশাতিত । তিনি বিনা রক্তপাতে মাসি ঘসেটি বেগমকে মুর্শিদাবাদ প্রাসাদে নজরবন্দি করেন । অপর প্রতিদ্বন্দ্বী আলিবর্দি খানের দ্বিতীয় কন্যার পুত্র পূর্ণিয়ার নবাব সৌকত জঙ্গকে মনিহারির যুদ্ধে পরাজিত করে সিংহাসন নিষ্কণ্টক করেন । তার আগেই তিনি ...

সিরাজ-উদ-দৌলা ও পলাশির যুদ্ধ

পলাশির যুদ্ধের দুটি দিক ছিল । (১) ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজের বিরোধ ও (২) বাংলার মসনদ দখলে মিরজাফরের উচ্চাকাঙ্খা । সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের সংঘর্ষের জন্য ইংরেজ ঐতিহাসিকরা সিরাজকেই দায়ী করেছেন । তাঁদের মতে, সিরাজের অহমিকা ও দম্ভ, অপরিমিত ...

বাংলার রাজনৈতিক পট পরিবর্তন

বাংলার রাজনৈতিক পট পরিবর্তন :- কর্ণাটকে যখন ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্ব চলছিল, মোটামুটি প্রায় সেই সময় বাংলায় রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হচ্ছিল । ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৭৬৫ খ্রীষ্টব্দের মধ্যে বাংলার কর্তৃত্ব স্বাধীন নবাবদের হাত থেকে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে যায় ...

তৃতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধ

সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে ভারতেও ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয় । কিন্তু ডুপ্লের মতো কোন যোগ্য নেতার অনুপস্থিতিতে ফরাসিরা যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছিল । এই সময়ে কর্ণাটকে যুদ্ধের দায়িত্বে ছিলেন লালি । কিন্তু সহকর্মীদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার ভালো ছিল না । ফলে ফরাসিদের মধ্যে ...