'রবীন্দ্র সাহিত্যে সাধারণ মানুষ'— এ বিষয়ে একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 07/24/2018 - 15:23

১৩০২ সালে লেখা রবীন্দ্রনাথের 'দুই বিঘা জমি' কবিতাটি নিয়ে আলোচনা শুরু করা যাক । এটিই প্রথম কবিতা যেখানে বাংলা সাহিত্য প্রথম এক ভূমিহীন কৃষকের জন্য দু ফোঁটা চোখের জল ফেলেছে । জন্মসূত্রে রবীন্দ্রনাথ পরশ্রমজীবী মানব গোষ্ঠীর অন্তর্গত । শ্রমজীবী মানুষের প্রতি তাঁর সহানুভূতি না থাকাই স্বাভাবিক । তার ওপর জীবনের একটি পর্বে তাঁকে আমরা পেয়েছি জমিদারের ভূমিকায় । তাই উৎখাত ভূমিহীন কৃষককে ঘিরে তার সহানুভূতি প্রত্যাশিত ছিল না । কিন্তু 'দুই বিঘা জমি' কবিতায় আমরা দেখি ভিটেমাটি ছেড়ে যে মানুষটি বিশ্ব নিখিলের উদাস ঠিকানা হাতে নিয়ে ভবঘুরে হয়ে যায় তাকেই তিনি পনেরো-ষোলো বছর পরে মাটির টানে নিজ গ্রামে ফিরিয়ে আনেন । তৃষ্ণাতুর সেই মানুষটি এসে পৌঁছায় তার ছেলে বেলার স্মৃতি ঘেরা আমগাছটার নিচে । আশ্চর্য হঠাৎ হওয়ায় দুটি পাকা আম তার কোলের কাছে এসে পড়ে । আর এই ঘটনার পরিণতিতে তাকেই উপনীত হতে হয় পুকুর ঘাটে পারিষদ-পরিবেষ্টিত ছিপ হাতে উপবিষ্ট জমিদারের কাছে । জমিদার তাকে চিনতে চাইলেন না । শুধু বললেন 'পাকা চোর অতিশয়' । ভূমিহীন কৃষক ও উপেনের মনোকথন, "তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ আমি আজ চোর বটে ।"

এই কাহিনী থেকে কবিতা-কথিত একটি সার্বিক উক্তি উঠে আসে. "এ জগতে হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি— / রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি" । শুধু 'দুই বিঘা জমি' কবিতাটি নয়, ১৩০০ বঙ্গাব্দে লেখা 'এবার ফিরাও মোরে' কবিতায় বাংলার কৃষকের ললাট লিখন : "ওই যে দাঁড়ায়ে নত শির / মুক সবে—ম্লানমুখে লেখা শুধু শত শতাব্দীর / বেদনার করুণ কাহিনী" ......../ শুধু দুটি অন্ন খুঁটি কোনোমতে কষ্টক্লিষ্ট প্রাণ / রেখে দেয় বাঁচাইয়া "। উল্লিখিত পংক্তি গুলিতে কৃষকের মুখে শত শতাব্দীর বেদনার যে করুণ কাহিনী আমরা পাঠ করি, বাস্তবতার সেই ব্যাপক প্রেক্ষাপট আর কোন বাংলা কবিতায় রচিত হয়েছে কিনা সন্দেহ । নিঃস্ব অবহেলিত মানুষের প্রতি গভীর অনুভব তাঁর কবিতায় এভাবেই বারবার ফিরে এসেছে । ভজন, পূজন, আরাধনারত পূজারীকে ধিক্কার দিয়ে 'গীতাঞ্জলি'র কবি জানিয়েছেন "নয়ন মেলে দেখ দেখি তুই চেয়ে / দেবতা নাই ঘরে ।"  দেবতা তবে কোথায় গেলেন ? কবির সুস্পষ্ট উত্তর — "তিনি গেছেন সেথায় মাটি ভেঙে করছে চাষা চাষ / পাথর ভেঙে কাটছে যেথায় পথ, খাটছে বারো মাস ।" ধুলিমলিন মানুষের মধ্যেই কবি ঈশ্বরের উপস্থিতি অনুভব করেন ।  অধ্যাথ ভাবনা অনুপ্রাণিত কবি জীবনের অপরূপ অন্তিম মাটির পৃথিবী পানে আঁখি মেলে আবারো সেই মেহনতী জনতার পদধ্বনিত দুর্বার গতি ধারাকে প্রত্যক্ষ করলেন । অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের সমুদ্র নদীর ঘাটে ঘাটে যে গুরু গুরু গর্জন গুনগুন স্বর ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে তার মধ্যে কবি দেখলেন চিরন্তনতাকে । তার পাশে রাজার রক্তচক্ষু কালের তর্জনী সংকেতে শিশু পাঠ্য কাহিনীতে আশ্রয় খোঁজে । কত রাজার রাজছত্র ভেঙে পড়ে, রণডঙ্কা নিঃশব্দে নির্বাক হয়ে যায়, কত দম্ভের স্তম্ভ মাটিতে বিলীন । আর সমালোচনার তীক্ষ্ণ তীর নিজের দিকে ফিরিয়ে দিয়ে কবি অতঃপর জানালেন :

"মাঝে মাঝে গেছি আমি ওপাড়ার প্রাঙ্গণের ধারে / ভিতরে প্রবেশ করি সে শক্তি ছিল না একেবারে ।" পরশ্রমজীবী মানুষের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেও পরিশ্রমজীবী মানুষের প্রতি এই যে দরদ, সেটা সম্ভব হয়েছিল উদার মানবিকতার কারণেই । এই মানবিকতা ছিল বলেই তিনি জমিদারীর গন্ডি পেরিয়ে এসে ভূমিহীন উপেনের মনোভূমি প্রত্যক্ষ করেছেন । তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছে 'দুই বিঘা জমি'র মতো কবিতা লেখা । এই মানবিকতাই তাঁকে পৌঁছে গিয়েছে 'রাশিয়ার চিঠি'র সেই অবিস্মরণীয় পংক্তিমালায় যেখানে তিনি লেখেন, "ওরা সভ্যতার পিলসুজ, মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে— ওপরের সবাই আলো পায়, ওদের গা বেয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে ।"

শত শতাব্দী-ব্যাপী মানুষের বেদনার এই করুণ কাহিনী কবি-মানসে কি গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল তার জ্বলন্ত স্বাক্ষী হয়ে আছে ১৩০০ সালে লেখা একটি ছোট গল্প— 'শাস্তি' । জমিদারের অত্যাচারে নিপীড়িত নিঃসহায় একটি কৃষি শ্রমিক পরিবারের মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি এই গল্পের বিষয়বস্তু । জমিদার অবশ্য রঙ্গমঞ্চে সাক্ষাৎ পদার্পণ করেন নি, তিনি নিয়তির মতোই নেপথ্যচারী । গল্পকার লিখেছেন "দুখীরাম এবং ছিদাম সেদিন জমিদারের কাছারির ঘরে কাজ করতে গিয়েছিল । ..... উচিত মত পাওনা মজুরি পায় নাই এবং তাহার পরিবর্তে যে সকল অন্যায় কটুকথা শুনিতে হইয়াছে সে তাহাদের পাওয়ার অনেক অতিরিক্ত ।" পথের কাদা ও জল ভেঙ্গে সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি এসে দু-ভাই দেখলো ছোট জা চন্দরা ভূমিতে আঁচল পেতে চুপ করে শুয়ে আছে আর বড় জা রাধা দাওয়ায় বসে রয়েছে । ক্ষুদিত দুখীরাম কাল বিলম্ব না করে ভাত চায় । বড় বৌ বারুদের বস্তায় স্ফুলিঙ্গপাথের মতোই জ্বলে ওঠে বলে, "ভাত কোথায় পাব যে ভাত দিব, তুই কি চাল দিয়া গিয়াছিলি । আমি কি নিজে রোজগার করিয়া আনিব ।"

সারাদিনের শ্রান্তি ও লাঞ্ছনার পর অন্নহীন নিরানন্দ ঘরে প্রজ্জ্বলিত ক্ষুধানলে গৃহিণীর রুক্ষ বচন দুখীরামের কাছে অসহ্য হয়ে উঠল । ক্রুদ্ধ গর্জনে সে বলে উঠল, "কি বললি" । তারপর মুহূর্তে দা হাতে কিছু না ভেবে একেবারে স্ত্রীর মাথায় সে বসিয়ে দিল ও তার মৃত্যু হতে মুহূর্ত বিলম্ব হইল না ।

এখানেই গল্পের প্রথমাংশের শেষ । দ্বিতীয়াংশে দেখা গেল এই বিড়ম্বিত মানুষগুলি কি ন্যায় কি অন্যায়, কি আচরণীয় কি অনাচরণীয় তাও বুঝতে পারে না । দাদাকে হত্যার দায় থেকে বাঁচাতে গিয়ে ছোট ভাই দোষ চাপালো চন্দরার ওপর । আদালতের বিচারে নিরপরাধ চন্দরাই দোষী বলে সাব্যস্ত হল । তার প্রাণদণ্ডের আদেশ হল । চন্দরা তার স্বামীর সাথে দেখা করতে চায় কিনা সে প্রশ্নের জবাবে সে শুধু বলল— 'মরণ !' । মৃত্যুর পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে অভিমান ক্ষুব্ধ নারীর এই ধিক্কার বাণীতে গল্পটি শেষ হয়েছে । রবীন্দ্রনাথের 'কালের যাত্রা'র নাটকে দেখা যায় মেহনতী মানুষ তাদের গন্ডি অতিক্রম করে পথে নেমেছে, সভ্যতার নিশ্চল রথচক্র সমাজের অচ্ছুৎ শূদ্রের স্পর্শে সচল হয়ে উঠেছে । 'সমাজতন্ত্র' প্রবন্ধে স্বামী বিবেকানন্দ এই সিদ্ধান্তে আসেন — "ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যতন্ত্রের পর আসবে শূদ্র-শ্রমিকচালিত শ্রম তান্ত্রিক রাষ্ট্র ।" রবীন্দ্রনাথ শোনালেন সেই সমাজবাদী বিপ্লবের আগমন বার্তা । "আজকের মতো বলো সবাই মিলে / যারা এতদিন মরে ছিল তারা উঠুক বেঁচে / যারা যুগে যুগে ছিল খাটো হয়ে /  দাঁড়াক একবার মাথা তুলে ।" রবীন্দ্র সাহিত্যে সাধারণ মানুষ আসে জীবনযাপনের নানা পরিস্থিতিতে । কিন্তু যেদিকটা আমাদের বিশেষভাবে মুগ্ধ করে তা হল সাধারণ মানুষের মধ্যে অসাধারণ মনুষ্যত্বের প্রকাশ । রায়চরণ, কেষ্টা এরা সবাই ভৃত্য কিন্তু কোথাও তাদের দৈন্যর বিবরণ নেই । বরং এদের মনুষ্যত্বের পরিচয়টাই মুখ্য উপপাদ্য বিষয় । এই দিকটাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অপরিসীম সহানুভূতির সঙ্গে এঁকেছেন । সত্য থেকে বিদায় নেওয়ার আগে মাত্র বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কবি বললেন— "আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন ।"  ১৩৪৩ লেখা পত্রপুটের ১৯ সংখ্যক কবিতায় লিখলেন ; "সকল মন্দিরের বাইরে / আমার পূজা আজ সমাপ্ত হলো / দেবলোক থেকে মানবলোকে / আকাশে জ্যোতির্ময় পুরুষে / আর মনের মানুষে আমার অন্তরতম আনন্দে ।"

***

Comments

Related Items

চরিতসাহিত্য ও চরিতামৃত —এই দু'য়ের মধ্যে পার্থক্য ও চৈতন্য জীবনী কাব্যকে কোন শ্রেণির রচনা হিসাবে গণ্য করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করুন ।

শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের পর এক অভূতপূর্ব স্রোত বঙ্গভুমিকে প্লাবিত করে । কাব্যে, সঙ্গীতে, জীবনে— সেই প্রাণপ্রৈতির প্রকাশ যে রূপে ও স্বরূপে ঘটে, তাকে আমরা সে যুগের শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলতে পারি । ভারতীয় ভাষা সাহিত্যে অপূর্ব জীবনী সাহিত্য শ্রীচৈতন্যের জীবনালোকে লিপিবদ্ধ হয় ।

বাংলা সাময়িক পত্রের উদ্ভবকাল থেকে "বঙ্গদর্শন" পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ সাময়িক পত্রিকাগুলির পরিচয় দিন ও এই পত্রপত্রিকার আশ্রয়ে বাংলা গদ্য কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে সে সম্পর্কে আলোচনা করুন ।

মুদ্রণযন্ত্র, বারুদ আর চুম্বক দুনিয়ার চেহারা বদলে দিয়েছে — এই কথাটি প্রথম ফ্রান্সিস বেকন বলেছিলেন । ভারতবর্ষে পান্ডুলিপির একচ্ছত্র রাজত্বে মুদ্রণের উদ্ভাবন ঐতিহাসিক কারণেই বিলম্বিত ছিল । ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে নাথানিয়েল ব্রাসী হ্যালহেড রচিত "A grammar of the Bengal Language" নামক গ্রন্থ প্রকাশ করার সময় বাংলা হরফের ধাতব আত্মপ্রকাশ ঘটে ।

সাধু ও চলিত ভাষার বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে একটি রচনা করুন ।

বাংলা ভাষার লেখ্যরীতিকে দু'ভাগে ভাগ করা হয়— সাধু ও চলিত ভাষা । বাংলা গদ্যের সূত্রপাত থেকে এই দুই রীতি পাশাপাশি চলে এসেছে । কাব্যে ব্যবহৃত মধ্যযুগের বাংলা থেকেই যে আধুনিক সাধু ভাষার ক্রমিক উন্নয়ন, ভাষাচার্য ডঃ সুকুমার সেন তার চমৎকার দৃষ্টান্ত দিয়েছেন ।

বাংলা ভাষার ধ্বনি পরিবর্তনের কারণগুলি উল্লেখ কর, তৎসহ ধ্বনি পরিবর্তনের ধারাগুলির পরিচয় দাও এবং এ প্রসঙ্গে অপিনিহিতি, স্বরসঙ্গতি এবং সমীভবন বিষয়ে টীকা লেখ ।

বাংলা একটা প্রাণবন্ত চলমান ভাষা । বহু বছরের ধীর ও ধারাবাহিক বিবর্তনে বাংলা ভাষার বর্ণ ও সংযুক্ত বর্ণের মূল ধ্বনির নানা পরিবর্তন ঘটেছে । ধ্বনির পরিবর্তনশীলতা বাংলা ভাষাকে আরো আন্তরিক ও প্রাণবন্ত করে তুলেছে । এই পরিবর্তনের পিছনে যে যে কারণগুলি রয়েছে সেগুলি হল