প্রাচ্য শিক্ষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষা বিষয়ক দ্বন্দ্ব

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 11/30/2020 - 22:55

প্রাচ্য শিক্ষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষা বিষয়ক দ্বন্দ্ব

 

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলে এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার নীতি নির্ধারণের বিষয়টি তাদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে । গভর্নর জেনারেল লর্ড মিন্টো তাঁর এক প্রতিবেদনে প্রাচ্যশিক্ষা ব্যবস্থার শোচনীয় অবস্থা তুলে ধরে প্রাচ্য জ্ঞান-বিজ্ঞান রক্ষার জন্য কোম্পানির কাছে আর্থিক সাহায্যের আবেদন রাখেন । ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে পাস হওয়া সনদ আইনের দ্বারা ভারতীয় জনশিক্ষার জন্য কোম্পানি প্রতি বছর এক লক্ষ টাকা খরচ করার সিদ্ধান্ত নেয় । এই উদ্দেশ্যে ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে 'জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন' বা 'জনশিক্ষা কমিটি' গঠিত হয় । এই কমিটির সম্পাদক এইচ এইচ উইলসন ও অন্যতম সদস্য এইচ টি প্রিন্সেপ দুজনেই প্রাচ্য বিদ্যার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন । তাই স্বাভাবিক ভাবেই তাঁরা ধ্রুপদি প্রাচ্য বিদ্যা চর্চার জন্যই শিক্ষাখাতে বরাদ্দ সরকারি অর্থের বেশিরভাগ অংশ খরচ করার সিদ্ধান্ত নেন ।

লর্ড বেন্টিঙ্কের শাসনকালে ভারতে প্রাচ্য না পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করা হবে এই প্রশ্নে জনশিক্ষা কমিটির সদস্যরা প্রাচ্যবাদী (Orientalist) এবং পাশ্চাত্যবাদী (Anglicist) নামে দুটি পরস্পরবিরোধী গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে যায় । এভাবে সরকারি শিক্ষানীতি নির্ধারণে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাদীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় । প্রাচ্যবাদীরা ভারতে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ও দর্শন বিষয়ে শিক্ষাদানের পক্ষপাতি ছিলেন । এই গোষ্ঠীর সমর্থকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এইচ টি প্রিন্সেপ, গিলক্রিস্ট, কোলব্রুক ও এইচ এইচ উইলসন প্রমূখ । পাশ্চাত্যবাদীরা ভারতে পাশ্চাত্যশিক্ষা, অর্থাৎ ইংরেজি, আধুনিক বিজ্ঞান প্রভৃতি শিক্ষার প্রসারের দাবি জানায় । এই গোষ্ঠীর সমর্থকদের মধ্যে ছিলেন টমাস ব্যাবিংটন মেকলে, আলেকজান্ডার ডাফ, সন্ডার্স, কলভিন প্রমূখ ।

লর্ড বেন্টিঙ্কের আমলে টমাস ব্যাবিংটন মেকলে ভারতের গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলে আইন সদস্যরূপে যোগদান করেন । তিনি জনশিক্ষা কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন । মেকলে পাশ্চাত্য শিক্ষার সপক্ষে মত প্রকাশ করেন এবং ভারতীয় সভ্যতা ও চিরাচরিত শিক্ষা ব্যবস্থার তীব্র নিন্দা করে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের কাছে এক প্রস্তাব (Minutes) পেশ করেন যা 'মেকলে মিনিট' নামে পরিচিত । ইংরেজি তথা পাশ্চাত্য ভাষা ও সাহিত্যের শ্রেষ্ঠত্ব বোঝাতে তিনি বলেন—"একটি ভালো ইউরোপীয় গ্রন্থাগারের একটি তাক ভারত বা আরবের সমগ্র সাহিত্যের সমকক্ষ ।" মেকলে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার সম্পর্কে চুইয়ে পড়া তথ্য বা 'filtration theory' প্রচার করেন । তিনি বলেন, প্রথম পর্যায়ে ভারতের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে । জল যেভাবে ওপর থেকে নীচের দিকে প্রবাহিত হয় তেমনি এই উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাহায্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা ক্রমে ভারতের সাধারণ ও নিম্নবিত্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে । লর্ড বেন্টিঙ্কের সরকার টমাস ব্যাবিংটন মেকলের প্রস্তাবগুলি গ্রহণ করে । প্রাচ্য-পাশ্চাত্যবাদী দ্বন্দ্বে শেষপর্যন্ত পাশ্চাত্যবাদীরা জয়ী হয় । 

প্রাচ্যবাদীরা এবং বাঙালি বুদ্ধিজীবীর একাংশ মেকলের প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে । প্রাচ্যবাদী সমর্থক উইলসন সমালোচনা করে বলেন সরকারি নীতিতে ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে চূড়ান্ত অজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছে । শেষ পর্যন্ত ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে নভেম্বর লর্ড অকল্যান্ডের মিনিটের মাধ্যমে প্রাচ্যশিক্ষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষাবিষয়ক দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে । অকল্যান্ড মিনিটে ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের প্রচেষ্টার পাশাপাশি প্রাচ্যবাদী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির জন্য বছরে ৩১,০০০ টাকারও অধিক বরাদ্দ করা হয় । সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে পাশ্চাত্য শিক্ষা অর্থাৎ ইংরেজি ভাষা এবং প্রাচ্য অর্থাৎ দেশীয় ভাষা এই দুই মাধ্যমেই শিক্ষাদান করা হবে । এর ফলে ছাত্ররা নিজেদের পছন্দমতো শিক্ষামাধ্যম বেছে নেওয়ার অধিকারী হয় ।

*****

Comments

Related Items

বিংশ শতকের ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা আলোচনা কর ।

প্রশ্ন : বিংশ শতকের ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা আলোচনা কর ।

মানুষ, প্রকৃতি ও শিক্ষার সমন্বয় বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও ।

প্রশ্ন : মানুষ, প্রকৃতি ও শিক্ষার সমন্বয় বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও ।

ঊনিশ শতকের বাংলায় সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজগুলির কীরূপ ভূমিকা ছিল ?

প্রশ্ন : ঊনিশ শতকের বাংলায় সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজগুলির কীরূপ ভূমিকা ছিল ?

হায়দ্রাবাদ রাজ্যটি কীভাবে ভারতভুক্ত হয়েছিল ?

প্রশ্ন : হায়দ্রাবাদ রাজ্যটি কীভাবে ভারতভুক্ত হয়েছিল ?

সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো : দেশবিভাগ (১৯৪৭) জনিত উদবাস্তু সমস্যা ।

প্রশ্ন : সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো : দেশবিভাগ (১৯৪৭) জনিত উদবাস্তু সমস্যা ।